॥এক॥
জামায়াতে ইসলামী তার অস্তিত্ব বজায় রাখবে নাকি নিজেকে বিলোপ করে দেবে এবং আর একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করবে এই নিয়ে সাম্প্রতিককালে একশ্রেণীর পত্র পত্রিকায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার আগে দেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন। একই সাথে পাক-ভারত উপমহাদেশের বিগত অর্ধ শতাব্দীর রাজনীতির একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রয়োজন।
॥দুই॥
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল দুটি রাজনৈতিক দল। একটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এটি অবিভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। পক্ষান্তরে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত সেদিন স্বাধীন হয় এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ বিভক্ত করে আজাদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই দুটি সংগঠনে দুই রকম স্রোত সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস একদিকে যেমন ভারতের কেন্দ্রে এবং রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় ছিল অন্যদিকে তেমনি ক্ষমতায় থেকে দলীয় সাংগঠনিক কর্মকান্ড ও তৎপরতার দিকেও তারা অবহেলা করেনি। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ এতটাই ক্ষমতা কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে যে তারা সংগঠনের প্রতি এবং সংগঠণের কর্মীদের প্রতি কোনো নজর দেয়নি। আজ ৭১ বছর পর দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস যদিও ভারতের বিরোধী দলে রয়েছে তবুও তারা ২৯টি রাজ্যে নিখিল ভারত সংগঠন হিসাবে বিরাজ করছে এবং সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে মুসলিম লীগের অস্তিত্ব অন্তত সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের বা সেদিনের পূর্ব বাংলার জনগণের ভোটে। জনগণ থেকে এবং রাজপথ থেকে মুসলিম লীগ এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নেতৃত্ব একক ভাবে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে চলে গিয়েছিল। মুসলিম লীগ সাংগঠনিক ভাবে সেখানে দাঁড়াতেই পারেনি।
এখানে এসে পড়ে আর একজন ক্ষণজন্মা পুরুষের নাম। তিনি মরহুম শেরে-বাংলা এ.কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ শাসনামলে যে ৩ জন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন তাদের একজন হলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। উল্লেখ্য যে ব্রিটিশ আমলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সরকার প্রধানকে বলা হতো মূখ্য মন্ত্রী বা চিফ মিনিষ্টার। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার সরকার প্রধানকে বলা হতো প্রধান মন্ত্রী বা প্রাইম মিনিষ্টার। তো বাংলার একজন প্রাইম মিনিষ্টার ছিলেন ফজলুল হক। অপর দুজন প্রাইম মিনিষ্টার ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। ফজলুল হকের দলের নাম ছিল কৃষক প্রজা পার্টি। পরবর্তীতে ঐ দলটির নাম হয় কৃষক শ্রমিক পার্টি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। তখন পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল আমিন এবং তিনিই পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার আগে পর্যন্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে বলা হতো পূর্ব বাংলা এবং ১৯৫৬ সালের শাসন তন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার নাম বদলে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান।
॥তিন॥
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। ৪ নেতার নামে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এই ৪ নেতা ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক,আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মওলানা আতাহার আলী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন পেলেও নেতা হিসাবে ব্যক্তিগত ভাবে অসাধারণ জনপ্রিয় ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। তাই সেই প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ভোট পেলেও তাকেই করা হয় পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী। নাজিমুদ্দিন নুরুল আমিন তথা মুসলিম লীগ এবং মওলানা ভাসানী ন্যাপের সাংগঠনিক কার্যক্রমের প্রতি কোনো রূপ নজর দেননি ফলে এই দলগুলিকে আজ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়।
॥চার॥
এখন আসা যাক স্বাধীন বাংলাদেশে। শেখ মুজিব স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ছাড়াও আর যারা সংশ্লিষ্ট ছিল তারা হলো মওলানা ভাসানীর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। ২০১৯ সালের রাজনীতি দেখে মনে হচ্ছে যে, দেশে দল আছে মনে হয় একটিই। সেটি হলো আওয়ামী লীগ আর নেত্রীও আছেন একজনই। তিনি হলেন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। এর কারণ হলো এই যে, এই ৪৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক অথবা বিরোধী দলে থাকুক, তারা তাদের সংগঠনের প্রতি এতটুকু অবহেলা দেখায়নি বরং সরকারে থেকেও সংগঠনের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই অনেক গুলি দল বিরোধী দলের ভূমিকা নেয় যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে সর্ব প্রথমে উল্লেখ করতে হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদকে। জাসদের নেপথ্যে ছিলেন রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খান এবং সামনে ছিলেন ফায়ারব্রান্ড আসম আব্দুর রব। সংগঠন হিসাবে জাসদের শক্তিমত্তাএবং আসম আব্দুর রবের অনল বর্ষী বক্তৃতা শুনে জনগণ তখন আসম আব্দুর রবকে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধান মন্ত্রী হিসাবে কল্পনা করতেন। ৪৭ বছর পর সেই জাসদের কি করুন দশা। আদর্শিক দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের কলহ এবং ক্ষমতার লোভে জাসদ আজ ছয় টুকরা। দেশের রাজনীতিতে তারা আজ আর কোনো উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর নয়।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল আর একটি দল। সেটির নাম ছিল মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ন্যাপ। পাকিস্তান আমলে একটি সময় ছিল যখন শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীর শীষ্য ছিলেন। কিন্তু ৬ দফা এবং স্বায়ত্ব শাসনের আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীকে ছাপিয়ে উপরে উঠে যান। এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তারপরেও মওলানা ভাসানী ছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। কিন্তু মওলানা ভাসানী তার সংগঠনকে মজবুত করার দিকে কোনো দিন নজর দেননি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ভাসানী ন্যাপ আজ অস্তিত্বহীন। এই দলের অধিকাংশ নেতা ও কর্মী বিএনপিতে চলে গেছে। অন্যেরা কে কি করছে সে খবর আজ আর পাওয়া যায় না।
বাম রাজনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।কিন্তু স্বাধীনতার পর বাম রাজনীতিকরা একটি সংহত এককে পরিণত হতে পারেনি। তাই বাম রাজনীতিতে একদিকে ছিল মওলানা ভাসানী অন্যদিকে বিভিন্ন নামে ছিলেন কাজী জাফরের ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পাটি।অন্যান্য বামদের মধ্যে খালেকুজ্জামানের বাসদ এবং মনিসিংয়ের উত্তরাধিকারী মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
এরা এখন সব স্পিলন্টার পার্টি এবং মার্জিনালাইজড। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো ইমপ্যাক্ট নাই।॥পাঁচ॥
২০১৮ সালে আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি মুসলিম লীগ, ভাসানীর ন্যাপ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদূরিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরং নতুন কিছু ডেভেলপমেন্ট ঘটেছে। ১৯৪৯ সালে যে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় এবং পরবর্তীকালে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি ছাঁটাই করে আওয়ামী লীগ বানানো হয় সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও অত্যন্ত দাপটের সাথে দেশ শাসন করছে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যেসব দল সক্রিয় ছিল তাদের প্রায় সবগুলিই আজ মার্জিনালাইজড বা ঝরে পড়েছে। সেখানে জন্ম হয়েছে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের। দলটির নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি।
বিএনপির জন্ম একটু ভিন্ন প্রকৃতির। আমরা সাধারণত দেখি যে, মুসলিম লীগের জঠোর থেকে জন্ম নিয়েছে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের জঠোর থেকে জন্ম নিয়েছে প্রথমে ন্যাপ এবং পরে জাসদ। কিন্তু বিএনপি কারো জঠোর থেকে জন্ম নেয়নি। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট পট পরিবর্তনের পর একটি মারাত্মক শূন্যতা দেখা দেয়। সেই শূন্যতা পূরণ করেন একজন সোলজার। তিনি হলেন মেজর জেনারেল মরহুম জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর রাজনীতি তাৎক্ষণিকভাবে হাল ছাড়া জাহাজের মতো হয়ে পড়ে। কারণ স্বায়ত্ব শাসনের আন্দোলন তুঙ্গে তুলে, পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করলেও যখন আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে তখন শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। একদিকে যেমন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল অন্যদিকে তখন ঢাকায় সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁনের সাথে প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানের একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে বৈঠক হয়। ২৩শে মার্চ সেই বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং ২৫শে মার্চের মধ্যেই মিলিটারি শাসক জেনারেল জিয়াউল হক এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান তার দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং দেশবাসীর কাছে আন্দোলনের পরবর্তী দিক নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই বলে যাননি। এমন একটি দিক নির্দেশনাহীন অবস্থায় ৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত এমএলএ ও এমপিরা এবং কিছু বাঙ্গালী সামরিক অফিসার ভারতে চলে যান। তৎকালীন বাঙ্গালী সামরিক অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান জেড ফোর্স নামে একটি বাহিনী গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানীর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এই সেই মেজর জিয়াউর রহমান যিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীকে মুহুর্তের মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ করে এবং বাংলাদেশে এবং ভারতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা এবং বেসামরিক নাগরিকগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
॥ছয়॥
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার বাংলাদেশে ইসলামী তথা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করেন। অর্থনৈতিক ফ্রন্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয় এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় এবং প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যান।
এমন একটি নৈরাশ্যজনক রাজনৈতিক পটভূমিকায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয় সেখানে জেনারেল জিয়াউর রহমান একটি নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেন। সেই দলটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বিএনপি এদেশের ৯২ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলামী মূল্যবোধকে তার রাজনৈতিক দলের অন্যতম ভিত্তি করেন, সমাজতন্ত্র উঠিয়ে দেন এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি ধর্মীয় রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ফলে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত হয়।
॥সাত॥
১৯৭৯ সালে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ব্যাপক ভাবে একদিকে ইসলামের দাওয়াতী কাজে আত্ম নিয়োগ করে অন্যদিকে সংগঠন শক্তিশালী ও মজবুত করার দিকে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে। দেখতে দেখতে জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসাবে উত্থিত হয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসাবে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠা করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তার কার্যকলাপ চালিয়ে যায় এবং দেশের প্রতিটি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে।
১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল। এই ২৮ বছরে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দেখা গেছে এক বিশাল পরিবর্তন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং আজ ২০১৯ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত ১১ বছর একটানা ক্ষমতায় আছে।
॥আট॥
আওয়ামী লীগের এই ১১ বছরের শাসনামলে ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন। যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর ৫ জন এবং বিএনপির ২ জন নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এখনও অনেকের বিচার চলছে। আশংকা করা হচ্ছে যে, আরো অনেকের ফাঁসি হবে। বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তথা কথিত দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছর জেল দেওয়া হয়েছে। বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারা দন্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। মাদক ও সন্ত্রাস দমণের নাম করে অসংখ্য মানুষকে ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে ও রিমান্ডে অমানুসিক নির্যাতনের ফলে তাদের অনেককে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা কারার অন্ধ প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরছেন। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মামালা দেওয়া হয়েছে এবং হুলিয়া জারি করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে তারা ঘর ছাড়া এবং গৃহ হারা এবং পলাতক জীবন যাপন করছেন। বিএনপি নেতার হিসাব মতে ৫ লক্ষ মামলায় ১৮ লক্ষ আসামী করা হয়েছে। ২০১৪ সালে একটি প্রতারণামূলক নির্বাচনে ১৫৩ ব্যক্তিকে বিনা ভোটে বিনা ইলেকশনে এমপি বানানো হয়েছিল। অবশিষ্ট ১৪৭ জনকে মাত্র ৫% ভোটে নির্বাচিত করা হয়েছিল। জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রশাসন অর্থাৎ আমলা ও পুলিশের সহযোগিতায় ২০১৪ সালের হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসেছিল।
ক্ষমতায় এসে তারা জনগণের সমস্ত মৌলিক অধিকার হরণ করে এবং সভা-সমিতি মিছিল মিটিংসহ সমস্ত রাজনৈতিক কর্ম তৎপরতা বন্ধ করে দেয়। অতীতের সামরিক সরকার গুলো যেখানে ঘরোয়া রাজনীতি চালু করেছিল ২০১৪ সালের পর আওয়ামী সরকার সেই ঘরোয়া রাজনীতিও আর চালু রাখে নাই।
॥নয়॥
এভাবেই কেটে গেছে ৫টি বছর। তার পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ধার্য্য করা হয় বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচন। দেশ এবং বিদেশী অনেক বন্ধুর অনুরোধে এবং তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট অংশ গ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। বিএনপি বিগত এক বছর হলো হাজার বার বলেছে যে বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। বরং তাকে ছাড়া নির্বাচনের চেষ্টাও করা হলে সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করা হবে। বেগম জিয়ার মুক্তি হলো না, বিএনপি নির্বাচনে গেল এবং প্রতিহতের কোনো চেষ্টাও করলো না। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতারা প্রধান মন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসে। ঐ সংলাপে ৭ দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্য পেশ করা হয়। কিন্তু সরকার ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা ও ১১ দফার একটি দাবিও মানে নাই। তারপরেও বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যায়। তারা নির্বাচনে যাওয়ার কারণে জামায়াতও তাদের সাথেই নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়। প্রধান মন্ত্রীর সাথে সংলাপে শত শত গায়েবি মামলায় গ্রেফতারকৃত হাজার হাজার কর্মীর মুক্তি দাবি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই ধরণের বন্দীর একটি তালিকা চান। ঐক্যফ্রন্টের তরফ থেকে একটি তালিকাও দেওয়া হয়। কিন্তু একজনকেও মুক্তি দেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল তফসিল ঘোষণার পর আর কোনো গ্রেফতার করা হবে না।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তালিকা দেওয়ার পরেও কাউকে মুক্তি দেওয়া হয়নি বরং তফসিল ঘোষণার পর আরও নতুন করে গ্রেফতার শুরু হয়। তার পরেও বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যায়। একাধিক প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তারা কারাগারের অভ্যন্তরে থেকেই নির্বাচন করেন। নির্বাচনের ৭ দিন আগে থেকে অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এবং উপজেলায় বিরোধী দলীয় প্রার্থীর বিশেষ করে ধানের শীষের লক্ষ লক্ষ পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়। সারা বাংলাদেশের ঐক্যফ্রন্টের ৩০০ জন প্রার্থীর কেউই নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারেননি। যেখানেই নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষ্যে তারা সভা ও মিছিল বের করার চেষ্টা করেছেন সেখানেই পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর নৃশংসভাবে এলোপাথারী হামলা করেছে। এই হামলার ফলে ঢাকায় গয়েশ^র চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস থেকে শুরু করে নোয়াখালীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমাদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, পাবনার হাবিবুর রহমান হাবিব পর্যন্ত কেউই রেহাই পাননি। এই পরিস্থিতিতে প্রায় সমস্ত প্রার্থী নির্বাচন বয়কটের জন্য বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ওপর চাপ দেয়। কিন্তু ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ তাদের আবেদনে কর্ণপাত করেনি এবং ৩০ ডিসেম্বর বেলা ৫টা পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে বলেন।
৩০০ জন প্রার্থীর ভেতরে ধানের শীষের অন্তত ১৪০ জন প্রার্থীর নির্বাচনী গণসংযোগ সভায় হামলা করা হয়। ইলেকশনের ৩ দিন আগে অর্থাৎ ২৬,২৭ ও ২৮ তারিখে বলতে গেলে কোনো প্রার্থীই জনসংযোগে বেরোতে পারেননি। এমনকি যেসব প্রার্থী নিরাপত্তার জন্য ৪ তারা বা ৫ তারা হোটেলে থেকে জনসংযোগ করতে চেয়েছেন তাদেরকেও ডিবি পুলিশ ৩ দিন ধরে হোটেলে আটকে রেখেছেন। তখন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে থেকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাদেরকে নির্বাচন বর্জনের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
এই পটভূমিতেই তথাকথিত নির্বাচন হয়ে গেল।কিন্তু সেই নির্বাচন নির্ধারিত ৩০ তারিখে হয়নি। হয়েছে আগের রাত অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাতে। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই শুধু মাত্র পুলিশ প্রটেকশনেই আওয়ামী বাহিনী ব্যালট পেপারে সীল মারেনি, পুলিশ স্বয়ং সমানে ব্যালট পেপারে নৌকার সীল মেরেছে। ৩০ তারিখ বেলা ১১টার মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর ২৫ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে মোট ১৬৯ জন প্রার্থী সরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তার পরেও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে যায়নি।
এসব ঘটনা দেশের ১৭ কোটি মানুষ স্বচক্ষে দেখেছেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে যে গণশুনানি হয়েছে সেই গণশুনানিতে ৪২ জন প্রার্থী দলিল প্রমাণ সহ ভোট ডাকাতির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
॥দশ॥
এভাবেই সমাপ্ত হয়েছে একটি নির্বাচন। ৩০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়েছে এক নতুন রাজনীতি। বড় অদ্ভুত সেই রাজনীতি। নির্বাচনের পর ২ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। জনগণ দেখছেন যে এখন দেশে এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়েছে যেখানে ভোটের প্রয়োজন পড়ে না, জনগণের কোনো প্রয়োজনও পড়েনা। ১৭ কোটি মানুষের সাথে সেই নির্বাচনের নাটকের কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ, বিজিবি, আনসার এবং সরকারি আমলারা হাতে থাকলেই নির্বাচনে জয় শত ভাগ। আমেরিকায় বসবাসকারী ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নিখোঁজ হয়েছে। নির্বাচনে জনগণের আর কোনো আস্থা নাই। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো এই যে, রাষ্ট্র সরকার এবং শাসক দলের মধ্যে যে সীমা রেখা ছিল সেটা ঘুচে গেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকাশ বলেছেন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, র্যাবের ডিজি, এসপি এবং ডিসি হাতে থাকলেই নির্বাচনে বাজিমাত করা যায়।
এতো গেল সরকারি দিক। বিরোধী দল সমূহের অবস্থা আরও করুণ। আজ থেকে ৫ বছর আগে জনগণ বিএনপি বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের ওপর তাদের সমস্ত আস্থা অর্পণ করেছিলেন। ভেবে ছিলেন যে এই জোট বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজপথে আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রকে মোকাবেলা করে তাহলে স্বৈরতন্ত্র বেশি দিন টিকবে না। সরকার বিরোধী দলকে দমন করার জন্য কৌশলে অগ্রসর হয়। প্রথমে তারা টার্গেট করে জামায়াতে ইসলামীকে। যুদ্ধাপরাধ, পাকিস্তানের দালাল, মৌলবাদী, রাজাকার ইত্যাদি বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে তারা জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক এবং শারিরীক উভয় ভাবেই নিশ্চিহ্ন করা শুরু করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকার যখন সাড়াশি আক্রমণ চালায় তখন বিএনপি সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে। তারা ভেবেছিল, ঝড় ঝাপটা যাই আসুক না কেন সেটা জামায়াতের ওপর দিয়েই যাক। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে, স্বৈরতন্ত্র এক আঘাতে দুই সাপ মারে না। দুই দলকে এক সাথে আঘাত না করে তারা এক এক করে আঘাত হানতে শুরু করে। জামায়াতের ৫ জন শীর্ষ নেতাকে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অপবাদে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলায়, হাজার হাজার নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকায়, হাজার হাজার নেতাকে ঘর ছাড়া করে এবং শত শত নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেয়। জামায়াতে ইসলামীকে ঘরে বাইরে কোথাও একত্রিত হতে দেয়না। কোনো একটি বাসায় বা বৈঠক খানায় ৪/৫ জন জামায়াত বা শিবির কর্মী একত্রিত হলে সেখানেও পুলিশ হামলা করে এবং তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এভাবে সরকার প্রথমে জামায়াতকে ধরাশায়ী করে দেয়।
তারপর তারা হাত দেয় বিএনপির ওপর। বিএনপির ২ জন নেতাকে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। এরপর বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে যথাক্রমে ১৭ বছর এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। বিএনপিরও হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার, হাজার হাজার কর্মীকে ঘর ছাড়া এবং শত শত নেতা-কর্মীকে রিমান্ডে দেওয়া হয়। তাদেরকে রাস্তায় কোনো বিক্ষোভ সমাবেশ বা মিছিল করতে দেওয়া হয় না। তবে বিএনপির ক্ষেত্রে একটি অবাক ব্যাপার হলো এই যে বিএনপির সমর্থক সংখ্যা লাখ লাখ। তারা যদি তাদের কর্মীদেরকে রাজপথে নামার জন্য সিরিয়াসলি রাস্তায় ডাক দিতো তাহলে পুলিশ তাদের ওপর হামলা করেও কুলিয়ে উঠতে পারতো না। জনতার পাল্টা রাজনৈতিক আঘাতে পুলিশই পিছু হটতে বাধ্য হতো। র্যাব এবং বিজিবি যদি জনগণকে দমনের জন্য রাস্তায় নামতো এবং বিএনপি নেতা কর্মীরাও যদি শহীদি স্পিরিট নিয়ে রাস্তায় থাকতেন তাহলে শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় হতো না, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বৈপ্লবিক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতো।
কিন্তু এটি অত্যন্ত রহস্যময় ব্যাপার যে, ২০১৬ সাল থেকে বিএনপি রাজপথ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়েছে। কোনো ব্যাপারেই তারা কোনো প্রতিবাদ করে না। তাদের প্রতিবাদ এখন নয়াপল্টন অফিসে এবং কোনো কোনো সময় গুলশান চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক অফিসে সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। নির্বাচনের আগেও তারা নিষ্ক্রিয়তা এবং নীরবতা অবলম্বন করেছিল এবং নির্বাচনের পরেও তারা সেই দুর্বোধ্য এবং রহস্যময় নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে যাচ্ছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন মানিনা এবং পুননির্বাচন চাই, এই কথা মুখে মুখে বলেই তারা খালাশ। আজ ২মাস ৩দিন হয়ে গেল ঐ মহা ভোটডাকাতির বিরুদ্ধে তারা একটি ন্যূন্যতম কর্মসূচিও দেয়নি। এখন জনগণ ধারণা করছেন যে, আওয়ামী লীগ সনরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মসূচি দেওয়ার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা কোনোটাই বিএনপির নাই। এই প্রবণতা যদি আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকে তাহলে বিএনপির অবস্থা কৃষক শ্রমিক পার্টি বা মুসলিম লীগের মতই হবে।
॥এগারো॥
এমন একটি পরিণতিতে জনগণের একমাত্র আশা ভরসা রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ওপর। যুদ্ধাপরাধ, পাকিস্তানি দালাল বা রাজাকার নিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যতই চিল্লা পাল্লা করুক না কেন, তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বাইরে জনগণের মাঝে এর কোনো ইমপ্যাক্ট নাই। আওয়ামী লীগের বিগত ১০ বছরের জুলুমে জামায়াতের কিছু নেতা এবং কর্মীর শারিরীক এবং বৈষয়িক ক্ষতি হয়েছে সন্দেহ নাই, কিন্তু জনগণের মধ্যে জামায়াত ও শিবিরের জনপ্রিয়তা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা এক সময় বলতো যে, জামায়াত এবং শিবির ক্যাডার ভিত্তিক রাজনৈতিক দল তারাই আজ বলছে জামায়াত ধীরে ধীরে জনভিত্তিক রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে চলেছে। বিএনপি যতই দুর্বল হবে এবং কার্যকর কর্মসূচির ব্যাপারে জনগণের আশা বিএনপির ওপর থেকে যতই ভঙ্গ হতে থাকবে ততই মানুষ জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করবে। ইতো মধ্যেই সেই আলামত দেখা যাচ্ছে।
এমন একটি পটভূমিতে জামায়াতের বিলোপ এবং নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার চিন্তা ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক এবং অবান্তর। তুরস্ক বা তিউনিশিয়ার উদাহরণ দিয়ে লাভ নাই। বাংলাদেশ তুরস্ক বা তিউনিশিয়া নয়। জামায়াতকে বিলোপ না করে কৌশলগত ভাবে যদি দলটি এই মুহুর্তে মাঠে না নেমে নেতা ও কর্মীদেরকে প্রস্তুত করে তাহলে সেদিন হয়তো বেশী দূরে নয়, যেদিন জামায়াত একক শক্তিবলে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে রাজপথে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক