বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ যখন বাংলাদেশ বৃহৎ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিলো তখন আমার বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ হয় নিই। তদানীন্তন তার নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। আজকের পাকিস্তানের নাম ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান। যখন ১৯৬৯ সালে আমি প্রথম বারের মত পাকিস্তান সফর করি তখন পাকিস্তানের লাহোর শহরে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেছি। লাহোর হলো পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী যেমন করাচী তার বাণিজ্যিক রাজধানী। তখন ইমাম মওদুদি রঃ জীবিত ছিলেন। যদিও তিনি তখন জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব তাঁর সহচর উস্তায তোফায়েল আহমাদের নিকট অর্পণ করেছেন।তখন ইমাম মওদুদি রঃ খুবই চাইতেন আমি যেন পূর্ব পাকিস্তানের ( বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকায় ভ্রমণ করি। অতঃপর বাংলাদেশের অনেক জনগণের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আভাস পাওয়া গেলো, ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো, পৃথক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ পেলো। তখন তদানীন্তন আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ক্ষমতালিপ্সু নেতার সেটাকে সুযোগ হিসাবে ইউজ করলো। পৃথক হওয়ার যুক্তি ছিলো বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িকতা যে যারা পাকিস্তান শাসন করতেছে তারা হলো পাশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী আর পূর্ব পাকিস্তান ( বাংলাদেশ) কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তারা যা কিছু বলতো সেগুলোর কিছু সত্য ছিলো। তবে এমন দুটো দেশ কিংবা জনপদের মাঝে একতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না যারা অনুভব করে যে তারা নিপীডিত ও নির্যাতিত আর তার অপরপক্ষ তাদের উপর জুলুম করতেছে। তারা পাচ্ছে খেজুর বিচি আর তাদের অপরপক্ষ পাচ্ছে খেজুর। দেশীয় জাতীয়তা ও বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা মোকাবেলার জন্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো উত্তম সমাধান। অনেক বড় বড় মুসলিম রাষ্ট যেই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। আর সেটাই ছিলো বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতা। সেটার কারোণেই তাতার ও খ্রিস্টান ক্রোসেড় যোদ্ধারা সেই সকল দেশগুলো দখল করতে পেরেছিলো।
কতিপয় বাংলাদেশী বলতো যে আমাদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে শুধুমাত্র দুটো জিনিস মিল রয়েছ একটা হলো লা ইলাহা ইল্লাহর সাক্ষ্য দেওয়া আর অপরটি হলো পাকিস্তান এয়ার লাইন্স। বৃটিশ উপনিবেশের সময় বাংলাদেশীদের উপর যেসকল জুলুম পতিত হয়েছিলো সেগুলো পাকিস্তান আমলেও ছিলো। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর আবশ্যক ছিলো পূর্ব পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে সামনে চলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা প্রয়োগ করা এবং তাদেরকে উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি প্রতিশ্রতি দেওয়া।
যাতে করে উন্নতির দিক থেকে উভয় অংশ সমান হয়। কমপক্ষে যাতে তার নিকটবর্তী হয়। যেন একেবারে সীমাহীন পিছিয়ে না থাকে। সকল অবস্থাতে উস্তায মওদুদি রঃ এর সেই আকাংখা আর পূরণ হয় নিই যে আমি পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করি। কিন্তু তিনি আমাকে এই বলে উৎসাহ দিতেন যে পূর্ব পাকিস্তান ( বাংলাদেশ) হলো আল্লাহর যমীনে একটা জান্নাত। আর তার নদীগুলো হলো একেকটা সাগর সমতুল্য।
শায়েখ মুহাম্মদ ইউনুস সাহেবের পক্ষ থেকে দাওয়াত :
আল্লাহর ইচ্ছায় কাতারে তৃতীয় বিশ্ব সুন্নাহ ও সীরাত সম্মেলন হলো। সেখানে পৃথিবীর দিগ - দিগন্ত ও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিদিগণ উপস্থিত হলেন। আর এসকল প্রতিনিধিদের একজন হলেন ছিলেন বাংলাদেশের চট্রগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল শায়েখ মুহাম্মদ ইউনুস আব্দুল জব্বার। সম্মেলনে শায়েখের সাথে আমার পরিচয় হলো। তিনি আকাংখা প্রকাশ করলেন যাতে আমি তাদের মাদ্রাসা পরিদর্শন করি। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের সাথে মিলিত হই। সেখানে দু হাজারেরো বেশী ছাত্র আছে। সেটি একটি দ্বিনি মাদ্রাসা যেখানে দেওবন্দি আলেমদের পদ্ধতিতে আরবী ভাষা ও দ্বিনি এলেম শিক্ষা দেওয়া হয়।
শায়েখ বললেন সেটি পরিদর্শনে আপনার ভালো লাগবে এবং আপনার পরিদর্শনে সেখানকার ছাত্ররা আনন্দিত হবে। আমি শায়েখকে বললাম আমিও বাংলাদেশে আপনাদের সাক্ষাতে খুবই আনন্দিত হবো। আর এটা আমার উপর আপনাদের হক। দুনিয়ার অনেক দেশই ভ্রমণ করেছি কিন্তু আপনাদের প্রিয় বাংলাদেশটি আমার ভ্রমণ করার সুযোগ হয় নিই।আল্লাহ চাহে তো আশা করি অতি নিকটেই সেই আকাংখা বাস্তবায়ন হবে। আপনার জন্য দাওয়াতনামা পাঠাবো যাতে আপনি আমাদের বাৎসরিক বিদায়ী ছাত্রদের অনুষ্ঠানে তাশরিফ আনেন। আমি বললাম আল্লাহ বরকত দান করুক। শায়েখ মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর পটিয়া মাদ্রাসা থেকে আমার নিকট একটি দাওয়াতনামা আসলো যাতে করে আমি তাদের মাদ্রাসার বিদায়ী ছাত্রদের বার্ষীক অনুষ্ঠানে তাশরিফ আনি। মনে আছে যে আমার ভ্রমণ ছিলো ভারত হয়ে। সেখান থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকায় দুদিন ছিলাম। সেখানকার মাদ্রাসাগুলো পরিদর্শন করলাম। মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেশের মক্তবখানার মত।তাদেরকে পেলাম তারা চাটায়ে বসে পড়তেছে। আর আমরা কাঠের তেপায়ার উপর বসে কিতাব পডাশুনা করতাম। তারা আমার সামনে ছোট্ট একটি শিশুকে এগিয়ে দিলো। শিশুটির বয়স নয় বছর ও পূর্ণ হয় নিই।শিশুটি এই বয়সেই পুরো কোরআন মাজিদ ভালোভাবে মুখস্ত করে ফেলেছে। তাকে কোরআনে কারীমের বিভিন্ন জায়গা থেকে পরীক্ষা নিলাম দেখলাম একটি হরফ ও এদিক সেদিক হয় না। যদিও সে আরবী ভাষা জানে না। আর এটাই এই কিতাবের বড় মুজেজা। আর যেই আমার ভ্রমণ সম্পর্কে জেনেছেন তিনিই দ্রুত আমার সাক্ষাতে চলে এসেছেন। তাদের একজন হলেন ড. ফুয়াদ আব্দুল হামিদ খতীব। তিনি বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত। আর সত্য হলো তিনি বাংলাদেশে ইসলামের দূত ছিলেন। বাংলাদেশে কোন আলেম বা দায়ি পরিদর্শনে গেলে তিনি তাদের খেদমতে থাকতেন। তিনি বিভিন্ন পরিদর্শনে আমার সাথে ছিলেন। অতঃপর তিনি আমার সাথে চট্টগ্রাম গেলেন একটি গণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে যেখানে বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দাওয়াত করা হয়েছে। অতঃপর দোহার উদ্দেশ্যে আমি ঢাকায় ফিরে আসার পর তিনি একটি বিরাট অনুষ্ঠান করলেন। সেখানে তিনি রাষ্টের বড় বড় ব্যক্তিবর্গ, আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রদূত এবং বড় বড় আলেমদেরকে দাওয়াত করলেন।
ঢাকায় আমার সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিনিধিগণ আমার জন্য আভ্যন্তরীণ বিমানের টিকট বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। শায়েখ ইউনুস ও তার সহচরবৃন্দ মুফতি আব্দুর রহমান ও অন্যান্যরা আমার অপেক্ষায় ছিলেন।বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কথা :
এই মুসলিম দেশে এটি ছিলো আমার সর্বোপ্রথম সফর। যেই দেশটি জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই যার অবস্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে যে কেউ সেটাকে ছোট্ট বাংলাদেশ দেখতে পাবে সংকীর্ণ আকারের ছোট্ট অংশ। তবুও সেখানে সেই সময় বারো কোটি বা এরও বেশী লোক বাস করতো। এদেশের অধিবাসীরা মূলত কৃষির উপর জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাদেরকে ঘনঘন বিরাট বন্যা আক্রান্ত করে। ফলে তাদের শস্য- ফসল বিনষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের দুর্বল বসতিগুলো ধ্বসে যায়। তাদের জন্য পানি প্রতিরোধের বিরাট বিরাট বাধ প্রয়োজন। কিন্তু এগুলোর জন্য লক্ষ লক্ষ অর্থের প্রয়োজন। তাদের সেই অর্থের সামর্থ্য নেই। দারিদ্রতা আরো দারিদ্রতার দিকে ঠেলে দেয়।সেখানে পাটকল ছাড়া কোন কল - কারখানা নেই। পাটকলটি আমি পরিদর্শন করেছি। শিল্পের এই অবহেলা সেখানে বৃটিশ আমল থেকে। অধিবাসীরা সেখানে দারিদ্রতা ও নিরক্ষরতায় কবলিত। যদিও সেটি অতি সুন্দর একটি দেশ যেমনটা উস্তায মওদুদি র : বলেছিলেন। সেটি আল্লাহর কুদরতি হাতে বুনা সবুজ বিছানা। সেখানে রয়েছে নারিকেল গাছ, পেঁপে গাছ ও অন্যান্য বৃক্ষলতা।
জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন সংস্থা, পৃথিবীর উত্তরের উন্নত দেশগুলো, শিল্পে সমৃদ্ধ বড় বড় দেশগুলো, ওআইসি ও মুসলিম দেশগুলো বিশেষকরে উপসাগরীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে এদেশকে সহায়তা করা প্রয়োজন যাতে করে এদেশটি ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হয়। এদেশের অধিবাসীদের রোগ, মূর্খতা ও দারিদ্রতার কারণে খ্রিস্টান মিশনারিগুলো এগুলো সুযোগ হিসাবে বেছে নিয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করেছে যেগুলো তাদের দূরাস্থাগুলোকে সুযোগ হিসাবে ইউজ করবে।যাতে তাদেরকে ধর্ম থেকে বিমুখ করে ফিতনায় ফেলতে পারে যেমনটা তাদের চিরচারিত অভ্যাস। এজন্য ইসলামী এনজিও ও সংস্থাগুলোর উপর জরুরি হলো দ্রুত বাংলাদেশে তাদের মুসলিম ভাইদের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করা এবং তাদেরকে খ্রিস্টান মিশনারীর হিংস্র থাবা থেকে উদ্ধার করা।
পটিয়া মাদ্রাসা :
পটিয়া মাদ্রাসাটি চট্টগ্রামের একটি গ্রামে অবস্থিত। কৃষি জমি ও সবুজ ভূমির মাঝে অবস্থিত কিন্তু সেখানে থাকার হোটেল বা মেহমানদের বিশ্রামের জন্য জায়গা নেই। সেইজন্য তারা আমাকে মাদ্রাসা থেকে দূরে একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করলেন। সেটি অতি সাধারণ একটি হোটেল তবে রাতে ঘুমানোর জন্য উপযোগী। দিনের বেলায় সারাক্ষণ আমি মাদ্রাসাতেই থাকি। আর এই সফরে আমি আরাম আয়েশ চাই না। যাস্ট মানুষের মৌলিক চাহিদার নূন্যতম প্রয়োজন চাই।আর এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আর আলহামদুলিল্লাহ আমি তাদের মত নই যারা সোনার চামচ মুখ নিয়ে বড় হয়েছে।বরং আমি গ্রামে প্রতিপালিত হয়েছি সেখানকার কঠিন জীবনের সাথে অভ্যস্ত হয়েছি যেমনটা বন্দি ও জেলজীবনে অভ্যস্ত হয়েছি। সুতরাং যে হোটেলে তারা আমাকে থাকার ব্যবস্থা করেছে তাতে কোন আশ্চর্যবোধ নেই। মিসরের হারবি কারাগারের জায়গাগুলোর চেয়ে এটা অনেক উত্তম। এই মাদ্রাসাটিকে আমি পেয়েছি তালিবুল ইলমে ভরপুর। তাদের অধিকাংশই মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ ছাত্রাবাসে থাকে। মাদ্রাসা তাদের জন্য থাকা, খাওয়া, কিতাব ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থান করে থাকে মুসলিমদের দান - খয়রাত থেকে। মনে হয় সেখানে ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে যেগুলো সেগুলোর উপর ওয়াকফ করা হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করলাম। তাদের সাথে এলমি ও তারবিয়তি দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম। বিশেষ করে তাদেরকে এ যুগ থেকে অনেক দূরে পেয়েছি। তারা শুধু পুরানো কিতাব পুস্তকের উপর বসবাস করে। তাদের গায়ে এই যুগের হাওয়া লাগে নিই যাতে রয়েছে কত আশ্চর্যজনক বিষয় ও বিবিধ সমস্যা।এমনিভাবে আমি ছাত্রদের সাথে সাক্ষাত করলাম দেখলাম তারা মানুষের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে আছে।আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, যুগের স্রোত ও সমসাময়িক সমস্যা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।সেই জন্য তারা স্বজাতির আধুনিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাসম্পন্নকারী বুদ্ধিজীবীদের থেকে অনেক দূরে থাকে ।তারা শুধু সাধারণ জনগণ ও নিরক্ষর লোকদের সাথে মুআমালত করে। এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমরা জামালুদ্দিন আফগানী সম্পর্কে কিছু জানো।অতঃপর সে মাথা নাড়ালো যে সে এই নাম কখনো শুনে নিই এবং ফিকহ, হাদীস ও তাফসীরের কোন কিতাবে পড়ে নিই। এভাবে ইমাম মুহাম্মদ আবদু, আল্লামা রশীদ রেজা, শায়েখ হাসানুল বান্না, শহীদ সায়্যেদ কুতুব, শায়েখ মুহাম্মদ গাজ্জালির কথা জিজ্ঞাসা করলাম অতঃপর সেই আগের মতই রিপ্লাই পেলাম।
কিন্তু যখন তাদেরকে মওদুদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম তখন তারা ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে গেলো এবং বললো মওদুদি একজন পথভ্রষ্ট ও ইসলাম বিকৃতকারী।
এই আবহাওয়ার উপর সেই মাদ্রাসার ছাত্ররা বাস করতেছে। তারা এই সম্পর্কে কম - বেশী কিছুই জানে না আজহারে যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে মডার্ন সায়িন্স : পদার্থ, রসায়ন, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভৌগোলিক, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ববিদ্যা, নৈতিকবিদ্যা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং দর্শন। নিজেকে এমন একটি বাহ্যিক অবস্থার সামনে পেলাম যেখানে নম্রতা, বুদ্ধিমত্তা ও ধীর - স্থিরতার সাথে আচরণ করা প্রয়োজন।আর তাদেরকে ধাক্কাদিয়ে কঠিনভাবে কিছু বলতে চাই নিই। তাহলে তারা আমার সমগ্র উপদেশ প্রত্যাখান করবে এবং আমার নসীহত থেকে কান বন্ধ করে রাখবে। তাদের কিছু দরসসমূহে উপস্থিত হলাম এবং তাদেরকে আরবী ভাষা ও শরয়ী এলেম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগলাম। তারা আমাকে হাদীসের একটি দরস দিতে বললো আর আমি বুখারীর প্রথম হাদীস ( আমলের প্রতিদান নিয়তের উপর নির্ভর করে, প্রতিটি ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে ..................। তাদের সামনে আমার মুখস্ত থেকে হাদীসটির সনদ বর্ণনা করলাম আর তাদেরকে বললাম হাদীসটি খবরে ওয়াহিদ পর্যায়ের। তবে পরবর্তীতে ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারীর পর হাদীসটি মুতাওয়াতির হয়েছে। আর মুতাওয়াতির হওয়ার শর্ত হলো সাহাবীদের থেকে শুরু হওয়া। তাদের সামনে উলামায়েকেরামের কাছে হাদীসটির গুরুত্ব ও ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব আলোচনা করলাম এবং হাফিজ মুনযিরি রঃ তারগীব তারহীব কিতাবে নিয়তের বিষয়ে যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন সেগুলোও আলোচনা করলাম এবং কোন জায়গাগুলোতে নিয়ত প্রভাব ফেলতে পারে আর কোন জায়গাগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে না সেগুলোও আলোচনা করলাম। এই হাদীসটির ব্যাখ্যা ফাতহুল বারী ও বোখারীর অন্যান্য ব্যাখ্যগ্রন্থে পড়েছি। তেমনিভাবে সেটির ব্যাখ্যা ইবনে রজব হাম্বলির জামিউল উলুম ওয়াল হুকমি ফি শারহে খমছিনা হাদিস মিন জাওয়ামিউল কালিম কিতাবে পড়েছি। শিক্ষক ও ছাত্ররা সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আর আমি হাদীসটি তাফসীর, ফিকহ, আকীদা ও আরবী সাহিত্য মিশিয়ে আমার নিকট বিদ্যমান অত্যাধিক উপাদান দিয়ে ব্যাখ্যা করে চলছি।
তারা আমার নিকট তাফসীর বিষয়ে একটি দরস প্রদানের অনুরোধ করলো আমি তাদের অনুরোধে সাড়া দিলাম। আমার মনে হচ্ছে সেটি ছিলো সূরা ফাতিহার তাফসীর আর কিছু ফিকহের দরসে উপস্থিত হলাম এবং তাদেরকে প্রশ্ন করলাম এবং বললাম আজহারে আমি হানাফি মাজহাব পড়েছি। আর সেটাই আমার রসমি মাজহাব। নুরুল ইজাহ পড়েছি এবং তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ মারাকিয়াল ফালাহ পড়েছি। কুদুরী পড়েছি তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ আললুবাব আলাল কিতাব পড়েছি এবং তার প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ আলমাইদানী আলাল কুদুরী পডেছি এবং ইবনে মওদুদ হানাফীর আলইখতিয়ার ফি শারহিল মুখতার পড়েছি। এই কিতাবগুলো আমি আজহারী মাদ্রাসাগুলোর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেবেলে পড়েছি। এরপর পার্সোনালভাবে আমি অনেক স্টাডি করেছি। যেমন ইবনে হুমামের হিদায়াহ ও তার ব্যাখ্যা, কাসানির আলবাদাইআ, ইবনে নাজিমের আলবাহরুর রইক, রদ্দুল মুহতার আলাদদুররুল মুখতার যেটি হাশিয়াহ ইবনে আবিদিননামে পরিচিত।
এবং নাহুর দরসসমূহে প্রবেশ করলাম এবং তাদেরকে অনেক প্রশ্ন করলাম সেগুলোর মাধ্যমে তারা আমার আরবীর ক্ষেত্রে আমার সক্ষমতা ও দখল জানতে পারলো। তাদেরকে প্রসিদ্ধ আলফিআতে ইবনে মালিক গ্রন্থ থেকে কিছু কবিতার লাইন পড়ে শুনালাম। আর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল শাইখ ইউনুস শিক্ষদের বললেন এই লোক দেখি আল্লাহর এক নিদর্শন। আমরা তাকে যাস্ট অল্প মৌলিক এলেমের অধিকারী সমসাময়িক দায়ী মনে করেছিলাম এখন দেখি তিনি তরঙ্গিত সমুদ্র । পুরানো ও আধুনিক সব এলেম হাসিল করে নিয়েছেন। তার মত কাউকে দেখি নিই। আর এটি আমার উপর আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছুই ছিলো না। তিনি তাদের সামনে আমাকে সুসজ্জিত করেছেন এবং আমার দোষ - ত্রুটি গোপন করেছেন। আর ইবনে আতাউল্লাহ তার প্রজ্ঞাসমূহে বলেছেন যখন কেউ তোমার প্রশংসা করে তখন সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর অনুগ্রহ। এবং অনুগ্রহ তার জন্য যিনি তোমাকে সম্মানিত করেছেন এবং তোমার দোষ গোপন করেছেন। অনুগ্রহ তার জন্য নয় যে তোমার প্রশংসা করেছে এবং কৃতজ্ঞতা করেছে। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা সবাই আমার উপর অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করেছে। তারা আমার পাশে দীর্ঘ সময় বসে থাকতো এবং ইসলাম সম্পর্কে, দাওয়াত সম্পর্কে, উম্মাহ সম্পর্কে এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে শুনতো। যা কোন দিন তাদের চিন্ত - ফিকিরে আসে নিই এবং তারা কোন দিন সেগুলো গুরুত্ব দেয় নিই। আমার ভিজিট থেকে তারা যেগুলো ইস্তাফাদা করেছে সেগুলোর সবচেয়ে গুুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা জেনেছে যে এলেম শুধু কিতাবেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের অধ্যয়নকৃত কিতাব ছাড়াও কিছু কিতাব আছে। তারা যে সকল শায়েখদের কাছে পড়েছে তারা ছাড়াও অনেক আলেম আছে যারা একেম ও ফিকিরে পরিপূর্ণ ছিলেন। এলেম হলো এমন সাগর যার কোন সৈকত নেই। আর আমাদের জন্য দ্বীন বুঝতে সহায়ক এমন কিছু দুনিয়ার নলেজ ও শিখা জরুরি। তাদেরকে একান্ত ভাবে বলেছি যাতে করে তারা মাদ্রাসার পাঠাগারে কিছু কিতাব সংযোজন করে। যেমন তাফসীরে মানার এবং শায়েখ জামালুদ্দিন কাসেমীর তাফসীর এবং আরো কিছু বই যেগুলো তাদের নাহু ও বালাগাত শিখাতে সহজ হবে যেমন আলি জারিম ও মুস্তফা আমিনের আননাহফুল ওয়াদিহ ও আলবালাগাতুল ওয়াদিহা। এছাড়াও তারা যাতে কিছু ইসলামী ম্যাগাজিনো রাখে যেমন কাতারের মাজাল্লাতুল উম্মাহ, কুয়েতের আলওয়াআইউল ইসলামী এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানারুল ইসলাম। তাদের আবদ্ধ পরিবেশে এই কথাগুলো শুনা ছিলো তাদের জন্য নিছক স্পষ্ট বিজয়। হয়তো তারা এগুলোর এক অক্ষরও বাস্তবায়ন করে নিই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ছাত্রদের কর্ণ কুহরে কথাগুলো পৌছানো যাতে তারা উপলব্ধি করতে পারে যে তাদের মাদ্রাসায় ছাড়াও অন্য জায়গায় আলেম আছে।
তাদের দেশেই খ্রিস্টান মিশনারীরা ইসলাম নিয়ে চক্রান্ত করছে যা তারা স্বচক্ষে দেখতেছে। পাশ্চাত্যের চিন্তা - চেতনাধারীরা তাদের চিন্তা - ফিকিরে বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। এর চেয়েও ভয়ংকর হলো পশ্চিমাদের দোসর ধর্মনিরোপেক্ষবাদীরা। এই চক্রান্ত মোকাবেলা করার জন্য আবশ্যক হলো উপকারী এলেম, অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন ফিকির, মুক্ত সংস্কৃতি দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করা। এই আবদ্ধতা শুধু পটিয়া মাদ্রাসার পরিবেশ নয়। বরং এটা বাংলাদেশের সকল দ্বিনি মাদ্রাসাগুলোর পরিবেশ। আমি তার অনেকগুলো পরিদর্শন করেছি।। যেমন হাটহাজারী মাদ্রাসা ও অন্যান্য। সেখানেও আমি একই পরিবেশ পেয়েছি। যদিও এক মাদ্রাসা থেকে অন্য মাদ্রাসার পর্যায়টা ভিন্ন। অনেককাল আগে আজহার ও প্রায় এসকল মাদ্রাসার মত ছিলো। কিন্তু তা সংস্করণের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে এবং তাদের সিলেবাসে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান প্রবেশ করিয়েছে। যেমন : প্রাকৃতিক বিদ্যা, গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞান। এগুলো মূলত আধুনিক জ্ঞান নয়। বরং এগুলোও আমাদের ইলম। অনেক শতাব্দী পর্যন্ত আমরা এসমস্ত বিষয়ে বিশ্বের উস্তাদ ছিলাম।
পাশ্চাত্যরা এগুলো আমাদের থেকে গ্রহণ করেছে আর এখন সেগুলো তাদের থেকে আমরা গ্রহণ করতেছি।
সেগুলো আমাদের পণ্য আমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পটিয়া মাদ্রাসার ভাইয়েরা আমাদের উপস্থিতিকে সুযোগ মনে করলো এবং অনেকগুলো প্রকল্প শুরু করলো এবং আমি নিজে হাতে সেগুলোর ভিত্তি প্রস্তর উদ্ভোধন করলাম। সেগুলোতে আমার নাম স্থাপন করা হলো। কামোনা করি যাতে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেগুলোর মেসেজ পৌঁছানো হয়।
চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন সময়ে আর্থিকভাবে দুর্বল সেখানকার ছোট ছোট অনেক দ্বিনি মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছি। মাদ্রাসাগুলোর আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন যাতে সেগুলো নিজ পায়ে দাড়াতে পারে। কাতারের কিছু ভাই আমাকে তাদের জাকাত ও সদকার মালের দায়িত্ব দিয়েছিলো এবং আমাকে বলা হয়েছিলো আমি যেখানে ভালো মনে করি সেখানে যাতে এগুলো খরচ করি। অতঃপর আমি মনে করলাম। এই সকল জাকাতও সদকার মালের অধিক হকদার হলেন এই সমস্ত মাদ্রাসাওয়ালারা। তারা অল্প পরিমাণেই খুশি হতো এবং স্বল্পতেই তারা তুষ্ট হতো। আল্লাহর তাদের স্বল্প পরিমাণের মাঝে বরকত দান করুক এবং বৃদ্ধি করে দিক।
তারপর গণবক্তৃতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিরাট শহরের পরিদর্শনের সমাপ্তি করলাম যেটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। যেমনটা ইতিপূর্বে ইংগিত দিয়েছি।
তারপর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ইসলাম , তার মেসেজ , তার সভ্যতা ও উম্মাহর সমস্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তারপর পটিয়া মাদ্রাসার ভাইদের থেকে বিদায় নিয়ে তাদের কিছু ভাইদের সঙ্গে চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তারা ঢাকায় একটি বিশাল মসজিদে আমাকে জুমুআর খুতবা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিছু আলেম নামাজের পর খুতবার অনুবাদ করলেন।
আমার জামায়াতে ইসলামীর কার্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ হলো এবং সেখানে আমি ভাষণ দিলাম। তারপর তাদের সাথে বিশেষভাবে সাক্ষাত করলাম। যাতে করে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। আমি তাদেরকে আরব বিশ্বে তাদের ভাইদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থাসমূহ জানালাম। আর জামাতের প্রথম লোক প্রফেসর গোলাম আজম সাহেবের তখনো দেশে প্রবেশের অনুমতি হয় নিই। কেবনা তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক হওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে তারা তার নাগরিক্ত রহিত করেছিলো। অথচ তিনি এই মূল দেশের সন্তান।
এই পরিপূর্ণ অবস্থানের পর বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সে দোহায় ফিরে আসাটা জরুরী ছিলো। ঢাকা থেকে দোহায় সরাসরি ফ্লাইটে প্রায় পাঁচ ঘন্টার সফর ছিলো।
আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন। অনুবাদক : মুফতি আহমাদ শাওকি আফিফিCourtesy- Ahmad Shawki Afifi.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন