ফাঁসি কার্যকর হওয়ার দিনে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট মহামান্য প্রেসিডেন্ট বরাবর তাঁর লিখিত চিঠি, ফাঁসির পূর্বক্ষণে পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎকালে সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট ভিত্তিক বক্তব্য অবশ্যই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অনুগামীদের জন্য যুগ যুগ ধরে অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
পরিবারের সদস্যগণ সর্বশেষ সাক্ষাতের বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন যে রাতে তার ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে সে রাতে একজন মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুপরোয়ানা মাথায় নিয়ে এশার নামাজ শেষে স্বস্তির সাথে গুংরিয়ে গুংরিয়ে ঘুমোচ্ছেন! এ আবার কী ধরনের মানুষ? কীভাবে এটি সম্ভব হতে পারে? কী প্রশান্তির ঘুম এটি? সাধারণত আদেশ শোনার পর ফাঁসির আসামিগণ মৃত্যু পেরেশানিতে খাবার দাবার, ঘুম, গোসল ছেড়ে দেন, আবোল তাবোল বকতে থাকেন, অনেকে পাগল পর্যন্ত হয়ে যান। কিন্তু জনাব মুজাহিদের ফাঁসির পূর্বক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে জায়নামাজ বিছিয়ে ফোরে প্রশান্তির ঘুমের ঘটনা সত্যিই স্বর্গীয়। পরিবারের লোকজন শেষ সাক্ষাতে সেলের সামনে গিয়ে কয়েকবার ডাকার পর তিনি ঘুম থেকে জেগেছেন। আবার ঘুম থেকে জেগে উঠার সাথে সাথে কথা বলতে ছুটে আসেননি। স্বাভাবিক ঘুম থেকে উঠলে পরে মানুষ যেমন ঘুমের রেশ কাটাতে, চোখ স্বাভাবিক করতে একটু সময় নিয়ে থাকেন, তিনি সেদিন মৃত্যু উত্তেজনাকর মুহূর্তেও কিছু সময় পর পরিবারের সদস্যদের সামনে স্বাভাবিকভাবে হাজির হয়েছেন। পরিবারের সাথে সাক্ষাতে তিনি জানতে পারলেন আজ রাতেই তাঁর ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে। তিনি বললেন, “আমাকে তো এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি।” তদোপুরি তিনি “আলহামদুলিল্লাহ, তাওয়াক্বালতু আলালল্লাহু” বলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এ সংবাদ গ্রহণ করে প্রশাসন, জেল কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংগঠনিক বিষয়ের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল আইন, মানবাধিকার, তাঁর বিচারকার্য প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কিত প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তব্য পেশ করলেন। বক্তব্যের শেষদিকে জেল কর্তৃপক্ষ, দেশবাসীকে সালাম জানিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে সত্যের উপর ইসতিকামাত থাকতে এবং তাদের ত্যাগ-কুরবানির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও নিজের শহীদী মৃত্যুর জন্য দোয়া কামনা করেছেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত জনাব মুজাহিদের সর্বশেষ বক্তব্যটি পর্যালোচনা করলে মনে হয়, তিনি যেন একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের ডেলিগেটদের উদ্দেশ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ও অত্যন্ত বিশ্লেষণধর্মী একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য পেশ করে গেছেন। ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা নাটকের ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। পিসিতে রক্ষিত কারাগারের টাকাগুলো সেবকদের মাঝে এবং তাঁর জেলখানায় ব্যবহৃত জিনিপত্রাদি স্মৃতিস্বরূপ বিভিন্নজনের মাঝে নিজেই বণ্টন করে গেছেন। সুদৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেনÑ তাঁকে হত্যা করা হলেও এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ অব্যাহত থাকবে। তাঁর রক্তের বিনিময়ে মানবতার মুক্তির আন্দোলন আরো বেগবান হবে। পরিবারের সদস্যদের হালাল পথে উপার্জন ও হালাল রুজি ভক্ষণের উপদেশ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। দীর্ঘ পাঁচ বছর মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও আমানতদারিতার সাথে পালন করেছেন। এতে তিনি উচ্চকিত করেছেন আন্দোলনের নেতৃত্ব ও ইসলামের সুমহান মর্যাদাকে। তিনি বড় জনসভায়, ওয়ান-ইলেভেনের শুদ্ধি অভিযানে, বিভিন্ন আলাপচারিতায় প্রকাশ্যে স্বীয় আঙ্গুল পেটের দিকে ইঙ্গিত করে বারবার বলেছেন, “এই পেটে কোনো হারাম-অবৈধ একটি পয়সাও ঢুকেনি।” মঈন ফখরুদ্দিন সেনাশাসিত আমলে বিশেষ অভিযানে তাঁর পরিচালিত মন্ত্রণালয়ে ন্যূনতম দুর্নীতি কেহ প্রমাণ করতে পারেনি।
জনাব মুজাহিদের সাথে বিদায় সাক্ষাৎ সমাপ্ত করে পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রিয়জনের লাশ গ্রহণ ও দাফনের জন্য রাতেই রওয়ানা হয়ে গেলেন ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে। পুরো পথেই তাদের মাঝে ছিল শঙ্কা, আতঙ্কÑ তারা কি স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রিয়জনের দাফনে, জানাজায় অংশ নিতে পারবে? পারবে কি শেষবারের মতো শহীদ সিংহ শার্দুল মুজাহিদের চেহারা মুবারক দেখতে? কারণ ইতঃপূর্বে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের উপর ফাঁসির রাতেই হামলা হয়েছে। বাধা দেয়া হয়েছে শহীদ কামরুজ্জামানের জানাজাতেও।
ভোর সাড়ে চারটার দিকে পরিবারের সদস্যগণ পৌঁছলেন জনাব মুজাহিদের স্মৃতিধন্য ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর নিজ বাসস্থানে। এর একটু দূরেই জনাব মুজাহিদের প্রতিষ্ঠিত মাওলানা আব্দুল আলী ফাউন্ডেশনের আদর্শ ক্যাডেট মাদরাসা প্রাঙ্গণে কবর খনন করে রাখা হয়েছে। পুরো শহরের মোড়ে মোড়ে শত শত র্যাব, পুলিশ, বিজিবির সশস্ত্র অবস্থান আর সতর্ক টহল। সারাদিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পশ্চিম খাবাসপুরে জনাব মুজাহিদের এলাকায় কাউকে ঢুকতে দেয়নি। পথে পথে তল্লাশি আর জিজ্ঞাসাবাদ। এতো প্রতিবন্ধকতার পরেও ভোর রাতে পশ্চিম খাবাসপুরে জনাব মুজাহিদের বাড়ি ঘিরে হাজার হাজার নারী-পুরুষের বিনিদ্র অবস্থান। ক্রমেই যেন মানুষের স্রোত বাড়ছে। সকলের চোখে আহাজারি। প্রিয়জন হারানোর বেদনার অশ্রু, মুখে কালিমা শাহাদাতের উচ্চারণ। মসজিদে চলছে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ।
জনাব মুজাহিদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ফজরের আজানের সাথে সাথেই প্রথম জামায়াত সম্পন্ন হলো। মুসল্লিদের অতিরিক্ত ভীড় সামলাতে মূল জামায়াতের পূর্বেই দু’টি জামায়াত করতে হলো। অতঃপর দেখা গেল অন্যরকম দৃশ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিসের ভয়ে যেন বেশ তৎপর হয়ে গেল। মসজিদকে ঘিরে ঐ এলাকায় কোনো মুসল্লিকে মসজিদের মূল জামাতে আসতে দিচ্ছে না। মহল্লার মুসল্লিগণ নামাজের জামাতে আসতে অনেক অনুনয় বিনয় করলো, কিন্তু কে শুনে কার কথা? কোনো কোনো মুসল্লি উঁচু স্বরে বলতে থাকলেন, মুজাহিদকে তো মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত মুজাহিদকে এখনো এত ভয় কেন? আমরা কি আমাদের মহল্লার মসজিদে নামাজও পড়তে পারবো না। হায় আল্লাহ ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভোরের আলো বাড়ার সাথে সাথে পুলিশ র্যাবের ব্যারিকেডের বাইরে অসংখ্য জনতার ঢল ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সকলেই উন্মুখ হয়ে শহীদ মুজাহিদের জানাজা স্থানে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশাসনের লোকেরা সবাইকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে জনস্রোত ঠেকাতে লাঠিপেটা পর্যন্ত করেছে। জনসাধারণকে জানাজায় স্বাভাবিক উপস্থিত হবার সুযোগ দেয়া হলে সেটি হয়তো এ যাবতকালের ফরিদপুরের বৃহত্তর জনসমাগম। এতো কিছুর পরও দেখা গেল কেহ শেষবারের মতো তাদের প্রিয় মুখটিকে দেখতে গ্রেফতার, লাঠিপেটা, সবকিছু উপেক্ষা করে চুপিসারে বিল্ডিং এর এক ছাদ হতে অন্য ছাদে লাফিয়ে সেনিটারি পাইপ বেয়ে, টিনের ঘরের ছাউনির উপর দিয়ে বাঁশ ঝাড় বেয়ে, কেহবা লাউয়ের মাচার উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে জানাজাস্থলে সমবেত হচ্ছে।
সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে একটি সাদা এম্বুলেন্সে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হাজির হলো জনাব মুজাহিদের লাশের কফিন। এ এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। এম্বুলেন্স হতে পরিবারের সদস্যগণ লাশের কফিন কাঁধে নিয়ে জানাজার জন্য মসজিদের সামনে মাঠে রাখলেন। পুরো মাঠে পড়ে গেল কান্নার রোল। উপস্থিত নারী-পুরুষ ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা হাউমাউ করে কেঁদেছে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য। প্রিয় নেতার জন্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরাও কেঁদেছে সকলের সাথে। এ দৃশ্য ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে আসমান-জমিনের মালিকের নিকট ফরিয়াদ করে পাঠিয়েছে এ বিচারের ভার। জানাজা পড়ান শহীদ মুজাহিদের নির্দেশনানুযায়ী তাঁর বড় ভাই জনাব আলী আফজাল মোহাম্মদ খালেছ।
জানাজার মাঠে যখন কান্নার রোল তখন মুজাহিদের সন্তানরা ছিল ইস্পাত কঠিন দৃঢ়চেতা। উপস্থিত জনতাকে উল্টো তারাই সান্ত্বনা দিয়েছেন। গর্বের ধন বাবার জন্য দোয়া চেয়েছেন। পিতৃহারানোর মর্মান্তিক বেদনাকে তারা হজম করেছেন, নিয়েছেন সুসংবাদ হিসেবে। প্রেরণা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন পরকালে জান্নাতের সিঁড়িতে বাবার সাক্ষাতের। এমন একটি পরিবারই প্রকৃত হকদার ‘শহীদ পরিবার’ হওয়ার।
জানাজা শেষে সফেদ সাদা কাপড়ে মোড়ানো বাঁধ খুলে উপস্থিত সকলকে দেখানো হলো শহীদ মুজাহিদের চেহারা মুবারক। পুরো চেহারাটি যেন আজ আরো উজ্জ্বল, শুভ্র, তেজোদীপ্ত। সবাইকে যেন কিছু একটা বলতে চান তিনি, কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। আজ তিনি মহান রবের দিকে না ফেরার দেশের অভিযাত্রী। পুরো গলাটি ব্যান্ডেজের কাপড় দ্বারা পেছানো রক্তে ভেজা, আশেপাশে ছোপ ছোপ রক্ত। ঢুকরে ঢুকরে কেঁেদছে স্বজনেরা, মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে শেষ শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানিয়ে চিরবিদায় জানিয়েছেন তারা।
সকাল দশটায় একই স্থানে গায়েবানা জানাজা ঘোষণা করা হলো। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হলো। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো চতুর্দিক হতে শহীদ মুজাহিদের কবর জিয়ারত করতে মানুষ সমবেত হতে থাকলো। কেহই কারো কান্না থামাতে পারেনি। কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে শাহাদাত কবলিয়াতের দোয়া করেছে, শহীদের রক্তের বিনিময় সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিজয় চেয়েছে সকলে।
শোক বই খোলা হলো শহীদ মুজাহিদের স্মরণে। বিভিন্ন পেশা, দল, মতের লোকেরা কবর জিয়ারত শেষে শোক বইতে লিপিবদ্ধ করেছে তাদের মনের অনেক কথা। বিপুল উপস্থিতির কারণে একই স্থানে পর পর ৫টি গায়েবানা জানাজা করতে হয়েছে। দাফনের দিন থেকে দলে দলে মানুষ আসছে শহীদ মুজাহিদের কবর জিয়ারতে। জিয়ারতের এ ধারা অব্যাহত থাকবে, থামবে না কখনো, থামাতে পারবে না কেহ।
মহান রবের নিকট সবকিছু বলে কয়ে শাহাদাতের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মাটিতে জায়নামাজেই ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। জনাব মুজাহিদের প্রশান্তির ঘুমের ঘোর ভেঙ্গে গেল ছেলেমেয়েদের আব্বু আব্বু ডাকে। জায়নামাজ থেকে উঠলেন, বসলেন স্বাভাবিক হলেন। হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ১৪ শিকের কারাগারের নিজ কক্ষের সামনে। শহীদী মাল্যবরণের সংবাদ শুনে কয়েকবার হামদে বারীতায়ালা উচ্চারণ করে প্রশাসনের লোকদের উপস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ধীরস্থিরভাবে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ পেশ করলেন। তিনি দিয়ে গেলেন মানবতার মুক্তির আজান, গেয়ে গেলেন মজলুম মানবতার মুক্তির জয়গান।
মুছাফাহ করলেন হাত মেলালেন সকলের সাথে। সালাম জানালেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীকে, চলে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে, অনন্তকালের গর্ভে। হাঁসতে হাঁসতে জীবন দিয়ে তিনি তো চলে গেলেন। তাতে কি থেমে যাবে তাঁর সত্য প্রতিষ্ঠার মিশন? ইতিহাস বলে, যুগে যুগে মহাময়দের রক্তপিলারের উপরই নির্মিত হয়েছে শোষিত মানবতার বিজয়ী প্রাসাদ, পরাজিত হয়েছে শোষকের প্রতিহিংসা।
-জুয়েল রহমান