পহেলা বৈশাখ উদযাপন চিত্র:
পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় অবশ্য ৩১ চৈত্র। চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তি মানে চৈত্রের শেষ দিন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চৈত্রকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পিরা রবি ঠাকুরের বৈশাখী গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো.., গেয়ে সূর্যবরণ ও ধানমন্ডী রবীন্দ্র সরোবরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে নববর্ষের সূচনা করে। নববর্ষের সূর্যোদয়ের সময়টিকে কল্যাণের জননী হিসাবে বেছে নিয়ে সূর্যকে আহ্বান করা হয়। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ হাতি, ঘোরা, ময়ূর, পেঁচা ইত্যাদি জীবজন্তু রাক্কস-খোক্কসের মূর্তি, মুখোশ ও প্রতিকৃতি নিয়ে নববর্ষের শুভ কামনায় বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অতীত ব্যর্থতার গ্লানী মুছে নতুন বছর বয়ে আনবে মঙ্গল ও সমৃদ্ধি। এই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ‘মঙ্গলশোভাযাত্রা’। মূর্তি-মুখোশ মিছিলে ঢাক-ঢোল, কাঁসা-তবলার তালে তালে চলতে থাকে সঙ্গীত-নৃত্য, উল্লস-উম্মাদনা। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীদেহের সৌন্দর্য প্রদর্শনী, সহপাঠী সহপাঠিনীদের একে অপরের দেহে চিত্র, আলপনা ও উল্কি অংকন, রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশের ভোজ ইত্যাদি।
নববর্ষ, বর্ষবরণ ও পহেলা বৈশাখ এ সবই হচ্ছে বাংলা নতুন বছরের আগমনে আয়োজিত উৎসব অনুষ্ঠানাদির নাম। জাতীয় প্রচারমাধ্যমসহ এক শ্রেণীর লোক এগুলোকে বাঙ্গালী জাতির ঐতিহ্য, বাংলার আবহমানকালের সর্বজনীন লোকজ সংস্কৃতি ও প্রাণের উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকে, যেন এ সবের প্রতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের জাতিগত বাধ্যবাধকতা অনুভূত হয়। কিন্তু যেহেতু এ দেশের ৯০% মানুষ মুসলিম। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এ সব অনুষ্ঠান-আয়োজন আসলে ইসলামসম্মত কিনা? কারণ, নব্বই শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচারকে বাদ দিয়ে কোন লোকজ সংস্কৃতি বা ঐতিত্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আলোচ্য প্রবন্ধে মূলত: এ বিষয়টিকেই আমরা ইসলামের মানদন্ডে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করব।
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানাদি পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, এগুলো ইসলামের মৌলবিশ্বাস ও জীবনধারার সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। নিচে এ সংঘর্ষের নানা দিক তুলে ধরা হলো:
এক. কাফির-মুশরিকদের সাথে আদর্শ ও বিশ্বাসগত সামঞ্জস্য:
ক. হিন্দুদের পুজা ও দেব-দেবীদের বাহন সাদৃশ্য:
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নামে যা হয়ে থাকে ওগুলো শতভাগ হিন্দুধর্ম চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। বৈশাখের ১তারিখ হিন্দুদের একটি মৌলিক ধর্মীয় উৎসবের দিন। এর আগে দিন তাদের চৈত্রসংক্রান্তি। আর পহেলা বৈশাখ হলো ঘট পুজার দিন। তারা ঐ দিন গণেশ পুজা করে। গনেশের বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করে মঙ্গল শেভাযাত্রা করে।
গত ১৪ এপ্রিল ২০১৩ দৈনিক সমকালে প্রাবান্ধিক মুকুল দাসের একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল “বর্ণ-বিবর্ণ স্মৃতিরেখা”। তিনি এ লেখাতে তার শৈশবের পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে লিখেছেন: “ছেলেবেলার পহেলা বৈশাখের স্মৃতি এখনও ধূসর হয়ে ওঠেনি। মনে পড়ে পহেলা বৈশাখের ভোরেই নতুন জামা-কাপড় গায়ে উঠত। চৈত্রসংক্রান্তিতে হাটখোলায় বিরাট মেলা বসত। মেলা থেকে কেনা হতো সিদ্ধিদাতা গণেশের পট। সকাল ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই গণেশ পূজার আয়োজন করা হতো। …কাঁচা হলুদ দিয়ে লিখা হতো ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গনেশায় নমঃ’। ফল-মিষ্টির উপচার সাজিয়ে পুরহিত মশাই মন্ত্রোচ্চারণ করতেন। ঢাকি ঢাক বাজাত। পূজা শেষে প্রসাদ খেতাম।” তার এ স্মৃতিচারণ মূলক লেখা থেকে সুষ্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহুকাল থেকে এখনো পর্যন্ত হিন্দুদের কাছে ১লা বৈশাখ ধর্মীয় উৎসবের দিন।
তাছাড়া, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য যে সকল কর্মসূচি থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালনো, মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা, ঢাক বাজানো, উলু ধ্বনি দেওয়া, বট গাছের তলায় জমায়েত। আবার এ শোভাযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ থাকে বিভিন্ন পশু-পাখির মূর্তি ও মুখোশ। উল্লিখিত প্রতিটি কাজ হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্ম চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাদের কল্যাণ প্রার্থনার পদ্ধতিতে আমরা মুসলমানরাও কী কল্যাণ প্রার্থনা করব?
তাদের ধর্ম মতে দেব-দেবীদের বিভিন্ন বাহন রয়েছে। যেমন: লক্ষীর বাহন পেঁচা, সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস, গণেশের বাহন ইঁদুর, দুর্গার বাহন সিংহ, মনসার বাহন সাপ, কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর, মহাদেবের বাহন ষাড়, যমরাজের বাহন কুকুর, ইন্দ্রের বাহন হাতি, ব্রক্ষ্মার বাহন পাতিহাঁস, বিশ্বকর্মার বাহন ঢেকি, শীতলার গাধা ইত্যাদি। আর যেহেতু যানবাহন ছাড়া দেব-দেবীদের আগমন-প্রস্থান সম্ভব নয়, অতএব, তাদের পুজাতে, তাদের শোভাযাত্রাতে দেব-দেবীদের যান-বাহনের পুজাও করতে হয়।
খ. সূর্য ও প্রকৃতি পুজারীদের সাথে সাদৃশ্য:
নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে, বছরের প্রথম প্রহরে প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানো। এ ধরনের কর্মকান্ড মূলত সূর্যপুজারী ও প্রকৃতিপুজারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র। সূর্য ও প্রকৃতি পুজা বহু প্রাচীন। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব ১৪ শতকে মিশরীয় “অ্যাটোনিসম” মতবাদে সূর্যের উপাসনা ছিল। এমনিভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো-আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য পুজারীদেরকে পাওয়া যাবে। ১৯ শতাব্দীর উত্তর-আমেরিকায় কিছু সম্প্রদায় গ্রীষ্মের প্রাক্কালে পালন করত সৌর-নৃত্য এবং এই উৎসব উপলক্ষ্যে পৌত্তলিক প্রকৃতি পূজারীরা তাদের ধর্মীয়-বিশ্বাসের পুনর্ঘোষণা দিত। সেই সুদূর প্রাচীনকালে সাবা সম্প্রদায় সূর্যের পুজা করত। হুদহুদ পাখি এসে তা নবী সুলায়মান (আ.) কে অবহিত করেছিল। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে,
وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُونَ لِلشَّمْسِ مِن دُونِ اللَّهِ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ
“আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে” (সূরা আল নামল, ২৭:২৪)
বৈশাখী সূর্যকে স্বাগত জানানো, কুরআনে বর্ণিত সূর্যকে সিজদা করা, আর উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের সৌর-নৃত্য এগুলোর মধ্যে চেতনা ও বিশ্বাসগত কোন পার্থক্য নেই; বরং এ সবই স্রষ্টার দিক থেকে মানুষকে অমনোযোগী করে সৃষ্টির আরাধনার প্রতি তার আকর্ষণ জাগিয়ে তোলার শয়তানী উদ্যোগ।
কবি রবিন্দ্রনাথ স্বীয় ধর্ম বিশ্বাস থেকে তার বৈশাখ কবিতায় রুদ্র বৈশাখের কাছে মিনতি করে অনেক কিছু চেয়েছেন। সেটা তার ধর্ম বিশ্বাস। কিন্তু একজন মুসলমান কিভাবে নিজ ধর্ম বিশ্বাসকে এড়িয়ে তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কিছু চায়?
গ. জন্তুপুজা:
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আরেকটি অনুসঙ্গ হলো: মুখোশ নৃত্য, গম্ভীরা গান ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল। গম্ভীরা উৎসবের যে মুখোশ নৃত্য, তার উৎস হচ্ছে কোচ নৃগোষ্ঠীর প্রাচীন কৃত্যানুষ্ঠান এবং পরবর্তীতে ভারতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ এই নৃত্য আত্তীকরণ করে নিজস্ব সংস্করণ তৈরী করে। জন্তু-পুজার উৎস পাওয়া যাবে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার কিছু ধর্মীয় মতবাদে, যেখানে দেবতাদেরকে জন্তুর প্রতিকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এমনিভাবে নববর্ষের কিছু অনুষ্ঠানে প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্মীয় মতবাদের ছোঁয়া লেগেছে, যা যথারীতি ইসলামবিদ্বেষীদের নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়, এগুলো তাদের আধ্যাত্মিক আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সত্য ধর্মের বিকল্প এক বিকৃত পথ মাত্র।
তাছাড়া, ইতিহাস ঘেটে আরো পাওয়া যায় যে, নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা গাজন এবং হরি উৎসবের সময় এরকম কিছু আচার পালন করে থাকত। গাজনের মেলায় ডোম, মেথর ও চন্ডাল শ্রেণীর হিন্দু লোকেরা নানাবিধ বহুরূপী সঙ সেজে তাদের উৎসব করত। জন্তু জানোয়ারের মুখোশ নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে এর কিছুটা মিল আছে।
ঘ. কল্যাণ-অকল্যাণ সাধনের বিশ্বাসে মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য:
নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে। মুছে দেয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানী। এই বিশ্বাসই হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার মর্ম। এ ধরনের কোন তত্ত¡ ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়। বস্তুত: নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পুজারীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। এ জাতীয় কুসংস্কারের কোন স্থান ইসলামে নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখন্ড, যদি তা আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় হয়।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দাদা তাঁর পিতাকে পারস্যের নওরোযের দিন (নববর্ষের দিন) আলী রা.-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন। (হাদিয়াটি ছিল নওরোয উপলক্ষ্যে। ফলে) আলী রা. বললেন, ‘‘নওরোযুনা কুল্ল ইয়াওম’’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নব উদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলীর (র.) এ ফতোয়া দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিয়মান হচ্ছে যে, নববর্ষ উপলক্ষ্যে পরষ্পরে উপহার বা প্রেজেন্টশন আদান প্রদান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় নাজায়িয।
তাই একজন মুসলমানের কাছে বছরের প্রথম দিনের কোন বিশেষ কোন গুরুত্ব ও তাৎপর্য নেই। এর সাথে জীবনের কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই। এ জন্যই ইসলামে হিজরী নববর্ষ পালনের কোন প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি।
কেউ যদি এ ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোন সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হল । যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ এই উপলক্ষ্য দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হল। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোন কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হল।
আর শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের ওপর কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন:
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ
“নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিবেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি।” (আল-মায়িদাহ:৭২)।
পহেলা বৈশাখের সাথে মঙ্গলময়তার কোন সম্পর্ক নেই। বরং ইসলামের বিশ্বাসে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মহাবিশ্বের স্রষ্টা, মহান ব্যবস্থাপক, নিরঙ্কুশ স্বত্তাধীকারী। জীবন-মৃত্যু, রিযিক ও সৃষ্টিজগতের কল্যাণ অকল্যাণ তাঁরই ইচ্ছাধীন। এ সবের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই। এতে তাঁর কোন শরীক নেই। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
{ وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (১৭) وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ (১৮) } [الأنعام: ১৭، ১৮]
“তিনি যদি তোমার কোন ÿতি করেন তবে তিনি ব্যতীত তা অপসরণকারী আর কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তিনি তোমার মঙ্গল করেন তবে তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান” (সূরা আন‘আম, আয়াত: ১৭)। অন্যত্র আল্লাহ রাসূল স. কে লক্ষ্য করে বলছেন, {قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ} [الأعراف: ১৮৮]
“আপনি বলুন, আমি আমার নিজের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ সাধনের মালিক নই কেবল তা ছাড়া যা আল্লাহ চান” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৮৮)। অনুরূপ অন্য আয়াতে বলেন,
{ قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا (২১) } [الجن: ২১، ২২]
“আপনি তাদের বলুন, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে আনার মালিক নই” (সূরা আল-জিন: ২১)।
এ সব আয়াতের বক্তব্য অনুসারে লাভ-ক্ষতির একমাত্র মালিক আল্লাহ। এমন কি মহানবী (স.)ও কারো কোন কল্যাণ-অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখেন না। সুতরাং কোন প্রদীপ বা শোভাযাত্রা মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখতে পারে, এটা কি কোন মুসলমান কল্পনাও করতে পারে? বিশ্বাসতো দূরের কথা।
সহীহ হাদীসে রয়েছে, একবার ‘ওমার (রা.) হাজরে আসওয়াদ চুমু দিয়ে বলেছিলেন,
إنِّي لأَعْلَمُ أَنَّك حَجَرٌ , لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ , وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ .
“আমি জানি তুমি একটি পাথর। তুমি ক্ষতিও করতে পার না; উপকারও করতে পার না। যদি আমি না দেখতাম যে, রাসূল (স.) তোমাকে চুমু দিচ্ছেন, তাহলে আমি তোমাকে কখনও চুমু দিতাম না”। (বুখারী, হাদীস: ১৫৯৭, মুসলিম, হাদীস: ৩১২৮)।
এই যদি হয় কাবা প্রাঙ্গনে অবস্থিত জান্নাতি পাথরের অবস্থা; তাহলে কোন প্রদীপ ও শোভাযাত্রা কী করে মানুষের কল্যাণ করবে? মানুষ হয়ে ওরা কী ভাবে এ জাতীয় কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়?!
অপর এক হাদীসে আছে, রাসূল (স.) ইবনু আব্বাস (রা.) কে বলেছিলেন,
وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ
“…আর জেনে রেখ, সমগ্র উম্মত যদি একত্রিত হয়ে তোমার কোন অকল্যাণ করতে চায় পারবে না; কেবল ততটুকু ছাড়া যা আল্লাহ তোমার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আর তারা যদি একত্রিত হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় পারবে না; কেবল ততটুকু ছাড়া যা আল্লাহ তোমার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।” (তিরমিযী)।
শুভাশুভ নির্ণয় ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে রাসূল [সা.] বলেন الطِّيَرَةُ شِرْكٌ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক’। [আবু দাউদ হা/৩৯১২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৩৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৫৮৪]
রাসূল [সা.] আরো বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ، أَوْ تُطِيَّرَ لَهُ أَوْ تَكَهَّنَ، أَوْ تُكِهِّنَ لَهُ أَوْ سَحَرَ، أَوْ سُحِرَ لَهُ ‘যে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে বিশ্বাস করায়, যে ভাগ্য গণনা করে এবং যাকে সে ভাগ্য গণনা করে দেয়, যে জাদু করে এবং যাকে সে জাদু করে দেয়- তারা আমাদের (উম্মাতে মুহাম্মাদীর) অন্তর্ভুক্ত নয়। [সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৯৫]
কোন সময়কে অশুভ বা শুভ মনে করা হিন্দু সংস্কৃতিধারী মুসলিম নামধারী মুনাফিকের কাজ। বরং বিশেষ যে সময়ের কথা হাদীছে এসেছে তা নিম্নরূপ :
রাসূল [সা.] বলেন,إِنَّ فِى اللَّيْلِ لَسَاعَةً لاَ يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ.‘রাতের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোন মানুষ সে সময় লাভ করতে পারে, তবে আল্লাহর নিকট ইহকাল ও পরকালের কোন কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে দান করেন। আর এ সময়টি প্রতি রাতেই রয়েছে। [মুসলিম, মিশকাত হা/১২২৪]
মুসলিম জীবনে আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে- ‘যা এক হাযার মাসের চেয়েও উত্তম’ । এটিকে রামাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিতে অনুসন্ধান করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুসলিম জীবনে আর কোন বিশেষ মুহূর্ত নেই- যেটাকে মানুষ অনুসন্ধান করতে পারে। বস্তুত: মানব জীবনের পুরো সময়টাই মহামূল্যবান। যা একবার গত হলে আর কখনো ফিরে আসে না। বরং বিশেষ সময়কে এভাবে উদযাপন করা শিরকী সংস্কৃতি বৈ কিছুই নয়।
সুতরাং প্রমাণিত হলো, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বালন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিরোধী কাজ। প্রদীপ ও শোভাযাত্রার সাথে মঙ্গল শব্দটি জুড়ে দেওয়ায় গোটা বিষয়টি তাওহীদুর রবুবিয়্যাতের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অপসংস্কৃতির স্তর ভেদ করে শিরকী সংস্কৃতি ধারন করেছে। কারণ, একমাত্র কাফির-মুশরিকরাই গাইরুল্লাহকে কল্যাণ-অকল্যাণের নিয়ামক হিসেবে বিশ্বাস করে থাকে। মূলত জাতিকে শিরকের অন্ধকারে ঢুকিয়ে দেবার জন্য এই সব অপপ্রয়াস।
ঙ. কাফির-মুশরিকদের বিনোদন-উৎসবে সাদৃশ্য:
অমুসলিমদের সাথে বিশাসগত ও আদর্শিক সামঞ্জস্য এবং উৎসব বিষয়ে ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:
উৎসব ধর্ম পালনের অংশঃ
উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধেরই অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। একটি জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণাই রক্তধারার মত প্রবাহিত হয় তার উৎসব-আয়োজনে।
যেমন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড় দিন তাদের বিশ্বাসমতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হতো ২৫শে মার্চ, এবং তা পালনের উপলক্ষ্য ছিল, ঐ দিন খ্রিষ্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরীর নিকট এ মর্মে ঐশী বাণী প্রেরিত হয় যে, মেরী ঈশ্বরের পুত্র জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারী নববর্ষ উদযাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এ দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হত।
ইহুদীদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদীদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘সাবাত’ হিসেবে পালিত হয়।
উৎসবের সাথে ধর্মীয় চিন্তাধারার এই গভীর যোগসূত্রের কারণেই ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স.) মুসলিমদের জন্য সুস্পষ্ট ভাষায় উৎসবের দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব-আয়োজনের সাথে ইসলামী উৎসব সংস্কৃতি সংমিশ্রিত বা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী উৎসবের স্বাতন্ত্র তুলে ধরে রাসূল (স.) বলেন:
إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا وَهَذَا عِيدُنَا
“প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী: ৯৫২; মুসলিম: ৮৯২]
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণিত:
قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا ، فَقَالَ : ” مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ ؟ ” قَالُوا : كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَدْ أَبْدَلَكُمْ يَوْمَيْنِ خَيْرًا مِنْهُمَا : يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ ” .
“রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি (সা.) বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এ দিনগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদের উত্তম কিছু দিন দিয়েছেন: কুরবানীর ঈদ ও রোযার ঈদ ।” (সূনান আবু দাউদ)
এ হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।
বিখ্যাত মুসলিম পন্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সম্পর্কে বলেন:
أن الأعياد من جملة الشرع والمناهج والمناسك التي قال الله سبحانه (لكل جعلنا منكم شرعة ومنهاجا) وقال (لكل أمة جعلنا منسكا هم ناسكوه) كالقبلة والصلاة والصيام فلا فرق بين مشاركتهم في العيد وبين مشاركتهم في سائر المناهج
“উৎসব-অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৮) ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান [সময় ও স্থান] নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ (সূরা আল-হাজ্জ্ব, ২২:৬৭)। যেমন, কিবলাহ, সালাত, সিয়াম। তাই তাদের সাথে উৎসবাদিতে অংশগ্রহণ করা তাদের অন্যান্য সমস্ত জীবনধারার সাথে অংশগ্রহণের মতই”।
অতএব, অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কোন সুযোগ কুরআন অনুসারী কোন মুসলমানের জন্য নেই। তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের সাথে একমত পোষণ করা। আর এসবের একাংশের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের শাখাবিশেষের সাথে একমত হওয়া। উৎসব-অনুষ্ঠানাদি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উৎসব দ্বারা ধর্মগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। নিঃসন্দেহে তাদের সাথে এসব অনুষ্ঠান পালনে যোগ দেয়া একজন মুসলমানকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাসূল (স.) বলেন: مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ “য ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত”। (আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪০৩১)।
এ প্রসঙ্গে ইব্ন তাইমিয়াহ (র.) বলেন:
“وهــــذا الحديث أقل أحواله أن يقتضي تحريم التشبه بهم وإن كان ظــاهره يقتضي كفر المتشبه بهم كما في قوله تعالى: {وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
“এ হাদিসের সর্বনিম্ন দাবি তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম, যদিও হাদিসের বাহ্যিক অর্থের দাবি কুফরি। যেমন আল্লাহ র বাণী: “তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত” (আল-মায়িদাহ: ৫১)।”
ইব্নুল কাইয়্যিম (র.) বলেন: “এর রহস্য বাহ্যিক সাদৃশ্য মানুষকে নিয়ত ও আমলের সাদৃশ্যের দিকে ধাবিত করে”। তিনি আরো বলেন: “কিতাবি ও অন্য কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে একাধিক জায়গায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে, কারণ বাহ্যিক সামঞ্জস্য অভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্যের দিকে ধাবিত করে, যখন আদর্শের সাথে আদর্শ মিলে যায়, তখন অন্তরের সাথে অন্তর মিলে যায়”।
এ যুগে কাফিরদের অন্ধানুকরণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে পার্থিব শৌর্য-বীর্য ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির ফলে তারা রীতিমত অনেক মুসলিমের জন্য ফেতনায় পরিণত হয়েছে। ইলেকট্রিক প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ঘরে ঘরে নিমিষে পৌঁছে যাচ্ছে তাদের আচার-অনুষ্ঠান। তারা যাই করে মুসলিমের একাংশ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তাদের উৎসব, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করে, তাতে যোগ দেয় ও আনন্দ করে। কি নববর্ষ, কি মৃত্যু বার্ষিকী, কি জন্ম বার্ষিকী, কি বিবাহ বার্ষিকী, কি বাবা দিবস, কি মা দিবস, কোন কিছুতেই কুণ্ঠাবোধ নেই। তারা করছে তাই আমরা করছি। ভালো-মন্দ, বৈধ-অবৈধ ও কুফর-শিরক ভেবে দেখার ফুরসত নেই। দেড় হাজার বছর আগে নবী (স.) আমাদেরকে এই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
্রلَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ دَخَلُوا فِي جُحْرِ ضَبٍّ لَاتَّبَعْتُمُوهُمْ، قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، آلْيَهُودَ، وَالنَّصَارَى، قَالَ: فَمَنْগ্ধ.
“তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে বিঘতে বিঘতে ও হাতে হাতে। এমন কি তারা যদি গুঁইসাপের গর্তে ঢোকে, তাতে ও তোমরা অবশ্যই তাদের অনুসরণ করবে। আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, ইহুদি ও খৃস্টান? তিনি বললেন: তবে কে”?( বুখারী (৩২২১), মুসলমি: (৪৮২৮),)
দুই. চিত্রাঙ্কন, উল্কা-আল্পনা আঁকা:
পহেলা বৈশাখের আরেকটি অনুসঙ্গ হলো: বিনা প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রাণীর (বিকৃত) ছবি আঁকা। উল্কা-আল্পনা আঁকা। এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
إن أشد الناس عذاباً يوم القيامة المصورون
“কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে [জীবন্ত বস্তুর] ছবি তৈরীকারীরা।” [বুখারী: ৫৯৫০; মুসলিম: ২১০৯]
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা.) বলেছেন:
“যে কেউই ছবি তৈরী করল, আল্লাহ তাকে [কিয়ামতের দিন] ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে, আর সে কখনোই তা করতে সমর্থ হবে না।” [বুখারী:২২২৫; মুসলিম: ২১১০]
অন্য হাদীসে বলা হয়েছে: ﻟﻌﻦ اﻟﻠﻪ اﻟﻮاﺷﻤﺎﺕ ﻭاﻟﻤﺴﺘﻮﺷﻤﺎﺕ
“যারা উল্কা আঁকে বা যাদের গায়ে আঁকা হয়, তাদের উপর আল্লাহ র লানত বর্ষিত হয়েছে” (বুখারী)।
তিন. অশ্লীলতা ও নর-নারীর অবাধ মেলামেশাঃ
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীদের অবিমিশ্রণ জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। নারী নগ্নতার এই অপসংস্কৃতি দেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে গভীর চারিত্রিক অধপতনের দিকে। নতুন প্রজন্মের জন্য চরিত্রবান মায়ের সংকট তৈরী করছে তারা। রাসূল [সা.] বলেছেন,
দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে, যাদের আমি এখনও দেখিনি। এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ উহার সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়’।[মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫২৪।]
অত্র হাদীছে আটসাঁট, অশালীন, অমার্জিত পোষাক পরিধানকারী দুর্বলচিত্ত, মাথার চুল উপরে তুলে বাধা নারীদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাদেরকে জান্নাতহৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
রাসূল [সা.] বলেন, ‘আমি জান্নাত দেখলাম। লক্ষ্য করলাম তাতে অধিকাংশ অধিবাসী দরিদ্র। জাহান্নাম দেখলাম। লক্ষ্য করলাম, তাতে অধিকাংশ অধিবাসী নারী’।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪]
এরূপ বহু হাদীছ রয়েছে, যেগুলোতে অশালীন নারীর নিশ্চিত ক্ষতির হুঁশিয়ার করা হয়েছে। তদ্রুপ, দাইয়্যুস (যে ব্যক্তি পরিবারের সদস্যদেরকে উত্তমভাবে নজরদারি করেন না) কেও জাহান্নামী বলা হয়েছে। রাসূল [সা.] বলেন,ثَلاَثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِمْ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْعَاقُّ وَالدَّيُّوْثُ الَّذِيْ يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপরে জান্নাত হারাম করেছেন; মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য ও দায়ূছ। যে তার পরিবারে অশ্লীলতাকে স্বীকৃতি দেয়’।[ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৫২]
অশ্লীলতা প্রসারের ভয়ঙ্কর পাপ। এর শাস্তিও ভয়ঙ্কর। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন যা তোমরা জান না।’’ (সূরা ২৪ নূর: ১৯ আয়াত)। এ জন্য আল্লাহ অশ্লীলতার কাছেও যেতে নিষেধ করেছেন।
وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ
“তোমরা অশ্লীলতার কাছেও যেওনা। তা প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য” (সূরা আন‘আম: ১৫১ )।
ব্যভিচারের প্রতি আহবান জানানো শয়তানের ক্লাসিকাল ট্রিকগুলোর একটি। যেটাকে কুরআনে “ফাহিশাহ” শব্দের আওতায় আলোচনা করা হয়েছে। শয়তানের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু“। সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ [ব্যভিচার, অবাধ মেলামেশা, মদ্যপান, হত্যা ইত্যাদি] করতে এবং আল্লাহ সম্বন্ধে (ইসলাম সম্বন্ধে) এমন সব বিষয় বলতে যা তোমরা জান না।” (সূরা বাক্বারাহ্, ২:১৬৮-১৬৯)
এছাড়া যা কিছুই মানুষকে ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ ও উদ্যোগী করতে পারে, তার সবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের দ্বারা: “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” (সূরা আল ইসরা, ১৭:৩২)
ব্যভিচারকে উৎসাহিত করে এমন বিষয়, পরিবেশ, কথা ও কাজ এ আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের কর্তব্য অন্তর থেকে ব্যভিচারকে এবং ব্যাভিচারের প্রতি প্ররোচনা দানকারী সব কিছুর চর্চাকে ঘৃণা করা। এ ব্যভিচার বিভিন্ন অঙ্গের দ্বারা হতে পারে, যেমনটি রাসূল (স.) বর্ণনা করেছেন: “চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে।” [বুখারী:৬২৪৩; মুসলিম: ২৬৫৭]
দেখা, ছোঁয়া, শোনা ও কথার দ্বারা সংঘটিত যিনাই মূল ব্যভিচার সংঘটিত হওয়াকে বাস্তবে রূপ দান করে। তাই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য এমন সকল স্থান থেকে শতহাত দূরে থাকা কর্তব্য, যে সকল স্থানে দেখা, ছোঁয়া, শোনা ও কথার ব্যভিচারের সুযোগকে উন্মুক্ত করা হয়।নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। পহেলা বৈশাখের অশ্লীলতা ও অবাধ মেলামেশা যে ব্যভিচারের উদ্দীপক তা বর্ষবরণের নাশে বস্ত্রহরণের কালচার থেকে প্রমাণিত হয়। তারপরও যারা বর্ষবরণবিরোধীতাকে মধ্যযুগীয় বলে তারা শুধু নাস্তিকই নয়; বরং তারাই ধর্ষণ, ব্যভিচারের জনক-জননী। তারা এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জীবনধারা বিদ্বেষী এবং কাফিরদের উচ্ছিষ্টভোগী দালাল।
অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন। এদিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। আর এই কর্মকান্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে বেশ কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ী চালানোর কারণে।
অপরদিকে মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদত। কারণ, ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়; গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুটির জন্য তাঁরই বিধিবিধান দিয় পরিচালিত করার নাম। ইরশাদ হয়েছে: “আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:৫৬)
চার. গান ও বাদ্য-বাজনার ব্যবহার:
বর্ষবরণের এসব অনুষ্ঠানে গান-বাজনা যেন পূর্বশর্ত। ঢেউ খেলানো আনন্দে বাজনা-সঙ্গীত যেন ফেনিল রাশি হয়ে বয়ে চলে। অথচ ইসলামী চেতনাশুন্য গান ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِيْنٌ ‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আলøাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞভাবে অনর্থক কথা ক্রয় করে এবং তাকে আনন্দ-ফূর্তি হিসাবে গ্রহণ করে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি”। (সুরা লুকমান ৩১/৬)।
হযরত ইবনু মাসঊদ অনর্থক কথার তাফসীরে বলছেন:
الغناء، والله الذي لا إله إلا هو، يرددها ثلاث مرات
“যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, তার কসম (তিনবার) অনর্থক কথা হলো গান”।
নাফে‘ [রা.] বলেন, একদিন ইবনু ওমর [রা.] বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেয়ে দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে যান। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে‘ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ [সা.]-এর সাথে ছিলাম তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। [আবূদাঊদ হা/৪৯২৪; সনদ ছহীহ।]
নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকে সংগীত ও বাদ্য। রাসূল (সা.) বলেছেন:
ليكونن من أمتي أقوام يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف
“আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে।” [বুখারী:৫৫৯০]
পাঁচ: মানবতার অপমান:
আশরাফুল মাখলূকাত হয়ে পেঁচা, হনুমান, সিংহ, ষাঁড়, হাতি ইত্যাদি জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরা মানবতার জন্য অপমান নয় কি? অথচ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে বিশেস সম্মান।
ছয়: অপচয়:
নববর্ষ উদযাপনে যাবতীয় আয়োজন বিশ্লেষণ করলে অপচয়ের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ আল্লাহ অপচয় হারাম করেছেন। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সাত. জঘন্য মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র:
পহেলা বৈশাখকে বাঙ্গালী জাতির সর্বজনীন উৎসব। এটি বাঙ্গালীর আবহমানকাল তথা হাজার বছরের শাশ্বত ঐতিহ্য। এ জাতীয় অনেক অভিধা দিয়ে এটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা চলছে। মূলত এ সবই হচ্ছে জঘন্য মিথ্যাচার। ইতিহাসের ভয়াবহ বিকৃতি। সত্যের মারাত্মক অপলাপ। উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতিতে পৌত্তলিক বানানো। কিংবা পৌত্তলিকদের সেবাদাস বানানো। এগুলো যে মিথ্যা, তা নিম্নের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হবে।
ক. বাংলা সনের জন্মকথা:
মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। রাজ্যের সব কাজ হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে করা হলেও কৃষিকাজের জন্য যে হিজরি সনকে অনুকরণ করে চলা কিছুটা কঠিন, এই ব্যাপারটা মোগল সম্রাট আকবর বেশ ভাল করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর তাই কৃষিকাজ এবং খাজনা আদায়ে সুবিধার্থে তিনি আলাদা একটা পঞ্জিকা প্রবর্তনের আদেশ করেন।এর আগে মোগল বাদশাহগণ রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরী সন। আকবরের নির্দেশে তার নবরত্ন সভার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম প্রচলন করেন হিজরী ৯৬৩ সনে। অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ । তবে সিংহাসনে আরোহনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সন থেকে। হিজরী চন্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌর বছর পূর্ণ হয় ন্যূনধিক ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিনের পার্থক্য হওয়ায় হিজরী সন প্রতি ৩৩ বছরের মাথয় সৌর বছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ বা ‘বাংলা বর্ষ’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে বৈশাখ নামটি নেয়া হয় নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। মোটকথা, চন্দ্র সনকে সৌর সনে রূপান্তর করে বাংলা সনের প্রচলন করা হয়।
এই অর্থে বাংলা সন হিজরী সনের সন্তান। যার জন্ম মাত্র ৪৬২ বছর আগে। তাহলে তা হাজার বছরের ঐতিহ্য হয় কিভাবে?
খ. মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্ম:
পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তার ইতিহাস মাত্র ২৭ বছর। ১৯৮৯ সালের আগে এরকম কিছু হতো না। ’আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান চালু করে চারুকলার কিছু ছাত্র। এর অন্যতম সংগঠক ছিলো শিল্পী তরুণ ঘোষ। পশ্চিম বাংলার বরোদায় আর্ট ইনিইটউটের ছাত্র ছিল সে। বরোদায় যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানা ফোক মোটিফ, মুখোশ ও খেলনার আয়োজন করে, সেই কনসেপ্ট আদমানী করে তরুণ ঘোষ এবার সাজায়। প্রথমে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেবার কিছু মুখোশ আর জীবজন্তুর প্রতীক ছিলো। পরে এটাকে আরো হিন্দুয়ানী করে নাম বদলে দেয়া হলো ”মঙ্গল শোভাযাত্রা।” এখন সেখানে হিন্দুদের প্রায় দেবদেবী, গনেশের বিভিন্ন প্রতিমা, রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, আবার রাজাকার প্রতিকৃতি/মুখোশ বহন করা হয়। তাহলে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি করে আবহমানকালের ঐহিত্য হয়? আসলে শেয়াল-কুকুর আর ভুত-পেত্নীর মুখোশ পরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার এই ব্যর্থ চেষ্টা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।
গ. পান্তা ইলিশ :
আর পান্তা-ইলিশও বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৮৩ সালের বৈশাখের সময়। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সহ কিছু তরুণ সাংবাদিক কবি প্রথম পান্তা ইলিশের আয়োজন করে রমনার বটমুল। জনপ্রতি পঁচ টাকা চাঁদা দিয়ে পান্তা ভাত, ভর্তা আর ডিম দিয়ে খাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডিম বদল করে দেযা হয় ইলিশ ভাজা। সেই থেকে চালু হয়ে গেলো পান্তা ইলিশ কালচার । এর আগে পান্তা ইলিশ দিয়ে বর্ষবরনের কথা শোনা যায়নি। বর্তমানে এই পান্তা-ইলিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি চলছে, যে মনে হয় এটা না খেলে বুঝি বর্ষবরন হবে না। এর চাপ পড়েছে মাছের বাজারে এবং নদীতে। ইলিশের হালি ৪০ হাজার টাকা গিয়ে ঠেকেছে, এমনকি দিনাজপুরে তিন মন ধানে এক কেজি ইলিশ! ঢাকা শহরের ধনীর দুলাল দুলালীরা ‘পান্তা-ইলিশ’ দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করতে যায়, যেখানে থালার রেট হাজার টাকাও ওপরে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি চর্চা নয়, সাধারণ গরীব মানুষদের উপহাস করা হচ্ছে!
ঘ. সর্বজনীন নয়; হিন্দুজনীন:
ওরা বলছে, পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনিন বাঙালী উৎসব। ঐ দিনের সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে রয়েছে: হিন্দুদের ঘটপুজা, গণেশ পুজা, সিদ্ধেশ্বরী পুজা, হিন্দুদের ঘোড়ামেলা, হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তি পুজা-অর্চনা, হিন্দুদের চড়ক বা নীল পুজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লিষ্ট মেলা, গম্ভীরা পুজা, কুমীরের পুজা, অগ্নিনৃত্য, ত্রিপুরাদের বৈশুখ মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব, চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পুজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি), হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপুজা, মজুসি তথা অগ্নি পূজকদের নওরোজ, হিন্দুদের বউমেলা, মঙ্গলযাত্রা এবং সুর্যপুজা।
একটু ভাবুন, ইসলাম সূর্যপুজারীদের সাথে সময়ের সামঞ্জস্য হয়ে যাবে বলে তিন সময় নামায পড়া হারাম করেছে। আর কাফেরদের পুজাকে এখন বানানো হচ্ছে সর্বজনীন!!!
ঙ. বাঙ্গালী বনাম মুসলমান:
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা ১৯৬৭ সাল থেকে এবং শোভাযাত্রার সূচনা ১৯৮৯ সাল থেকে। তাহলে এ আয়োজনকে কিভাবে বাঙালীর সংস্কৃতি দাবি করা হয়? আজ থেকে ১০০ বছর আগের বাঙালী কোন মা, বধু, কণ্যা কী স্বপ্ন দেখতেন যে, কোন পর পুরুষ তার শরীরের লোভনীয় অঙ্গে আলপনা এঁকে দিবে, সে কোন পর পুরুষকে মুখে তোলে ইলিশ-পান্তা খাওয়াবে? বিগত হাজার বছরের বাঙালী নারী সমাজ পরপুরুষের সান্নিধ্যকে ঘৃণা করে এসেছে। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য হচ্ছে পর্দা ও শালীনতা বোধের গর্বিত ইতিহাস। ছেলে-মেয়ে এক সাথ বটতলায় বসা বাঙালীর সংস্কৃতি নয়। হ্যাঁ, শরৎ চন্দ্রের ভাষায় ভাষা মিলিয়ে কেউ যদি বলেন, ‘আজ বিকেলে বাঙালী বনাম মুসলমান ছেলেদের মাঝে ফুটবল খেলা হবে’ তবে তিনি বর্ষবরণের প্রচলিত আয়োজনগুলোকে বলতে পারেন বাঙালী সংস্কৃতি। কিন্তু একজন মুসলমান কখনো বর্ষবরণের এ আয়োজনগুলোকে “আমাদের সংস্কৃতি” বলতে পারে না। আমরা ভাষায় বাঙালী, এ কথা সত্য। এর চেয়েও বড় সত্য কথা হচ্ছে, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে আমরা মুসলমান। আমাদের সব চেয়ে বড় পরিচয় আমরা মুসলমান। আমাদের সব কিছুই অন্যদের থেকে আলাদা। জন্ম থেকে নিয়ে বিবাহ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সকল কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, রীতি-রেওয়াজ ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত। ধর্ম ভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হবেই। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسلام دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“যে ব্যক্তি ইসলামের বাইরে যেয়ে অন্য কিছুর চর্চা করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।” (আলে ইমরান ৩:৮৫) তাই সকল ধর্মের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য সর্বজনীন সংস্কৃতি বলতে উদ্ভট কোন কিছুর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে নেই।
চ. আকবর ও তার পরবর্তীযুগে পহেলা বৈশাখ:
আকবারের সময় থেকেই বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির সেই মালিকেরা তাদের কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। হালখাতা মানে হিসাব রক্ষণের পুরাতন বই হালনাগাদ করে নতুন বই খোলা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন।
পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে পুরনাঙ্গ ধারনা পেতে চাইলে প্রথমেই যেই ব্যাপারটা আপনাকে একদম ভুলে যেতে হবে সেটা হল – পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি। বাংলা সন প্রচলন হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, আজকে থেকে ৪৩৪ বছর আগে। যদি আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকেই হিসাব করা হয় তাহলেও সেটা মাত্র (১৫৫৬-২০১৮) ৪৬২ বছরের পুরনো হয়। একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি তো ঠিক, তবে সেটা প্রায় ৬০০ বছর কম হাজার বছরের সংস্কৃতি।
এবার চলুন এই ৬০০ বছর টাকেও আরও বাড়িয়ে দেয়া যাক!
“আধুনিক পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে ওই বছর পহেলা বৈশাখে ‘হোম কীর্তন’ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।” (প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ, মুহাম্মদ লুৎফুর হক দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)
১৯১৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত বছর ১০১; হাজার নয়।
ছ. ছায়ানট ও পহেলা বৈশাখ:
এখন কিছু ‘হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি’র সাথেও পরিচিত হই। ছায়ানট আর রমনাবটমূল দিয়েই শুরু করি:
পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানটাই হল ছায়ানটের শিল্পীদের গান দিয়ে বর্ষকে বরণ করে নেয়া। তবে গানের মাধ্যমে বৈশাখ বরনের এই চল ছায়ানট কবে থেকে শুরুকরল সেই ব্যাপারে দুটো মত পাওয়া যায়ঃ
একটি মত হলো, ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়াানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে। অন্য একটি মতে, ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। এই দুটো মতের মধ্যে দ্বিতীয় ম মতটা অধিক গ্রহণযোগ্য। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের তীব্র অভিপ্রায়ে কিছু রবীন্দ্র ভক্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠত হয় ছায়ানট। ছায়ানটের জন্মই যেখানে ৫৭ বছর আগে, সেখানে গানের মাধ্যমে রমনাবটমূলে বর্ষবরণ করাকে হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া প্রথম শ্রেণির একটা কৌতুক।
জ. পহেলা বৈশাখ না কি রবীন্দ্র বন্দনা:
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদস্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে।” অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপারটাকে টেনে-টুনে বড়জোর ৬০’এর দশকে নেয়া যায় । তবে এর সঙ্গে আকবরের প্রবর্তিত বাংলা সনের সম্পর্ক যতটাই একবারে নেই ঠিক ততটাই আছে রবীন্দ্রনাথের সাথে, রবীন্দ্রবন্দনার সাথে।
ঝ. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন/দস্যুপনা:
আবহমানকাল ধরে একটি দেশের মানুষের রুচি, সামাজিক কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বিশ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠা রীতিনীতিই হলো দেশীয়, লোকজ সংস্কৃতি। এতে মূলত ধর্মীয় বিধি-নিষেধেরই প্রতিফলন ঘটে থাকে। এ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের জীবনধারা ইসলামের অনুসারী হওয়ায় ইসলামই হচ্ছে এদের লোকজ সংস্কৃতির প্রাণশক্তি।
এ জন্য প্রকৃত দেশজ সংস্কৃতির সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। কারণ, তা মূলত ইসলামী সংস্কৃতি। যেমন, আজান, নামায, ঈদ, কুরবানী ইত্যাদি। কিš‘ দেশজ সংস্কৃতির নামে যখন অন্য একটি পৌত্তলিক ধর্মের পুজা-পার্বন ও সংস্কৃতির অনুসরণ ও মিশ্রণের অপচেষ্টা করা হয়, তখন তা প্রতিহত করা অনিবার্য হয়ে যায়। অন্যথায়, জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। হাজার বছরের সংস্কৃতির সাথে কিছু প্রাণী মূর্তির মঙ্গলযাত্রা যোগ করলেই তা দেশজ সংস্কৃতি হয়ে যায় না। বরং তা হচেছ মূলত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। একটি সুস্থ সংস্কৃতির ভেতরে কৌশলে অন্যধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ঐ ধর্মের দেউলিপনাকেই প্রমাণ করা। এটা সাংস্কৃতির দস্যুপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর দ্বারা কিভাবে আমাদের কোমলমতি শিশু ও আগামী প্রজন্ম মুশরিক হয়ে যাচ্ছে, তার একটি নমুনা দেখুন। একটি পত্রিকা ছেপেছে, “পয়লা বৈশাখের কদিন আগেই ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলপড়–য়া অনি তার মায়ের সঙ্গে চারুকলা ঘুরে গেছে। একটা লক্ষীসরাও কিনেছে। মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনে তখনই সে মাকে বলেছে, এবারই নতুন পোশাক পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। অনিকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন সে এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবে? ছোট্ট অনি বলেছে, ‘এটা এক ধরনের প্রার্থনা। মা বলেছে, এই শোভাযাত্রায় অংশ নিলে ভালো হবে।’
উপসংহার:
পহেলা বৈশাখকে উৎসব দিবসের মর্যাদা দিয়ে সর্বজনীননতার নামে ইদানিং যা হচ্ছে, তা আমাদের ঈমান ও ইবাদাতের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ; কুফুর ও শিরিকে পরিপূর্ণ। বৈশাখ বরণের নামে এসব অনুষ্ঠান কখনো মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়; হতে পারে না। বর্ষবরণের এই অপসংস্কৃতির থাবায় পড়ে কত তরুণ-তরুণী যে জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। কত মায়ের সন্তান যে মুশরিকত্ব বরণের উৎসবে আটকা পড়েছে । ধর্মহীনতার চোরাবালিতে তারা তলিয়ে যাচ্ছে। তা একটু ভেবে দেখা দরকার।
তরুণ-তরুণী ভাইবোন! নিজেকে অবমূল্যায়ন করো না। তোমার মত যুবকের হাতে ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। তোমার মত তরুণীরা কত পুরুষকে দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছে।
প্রিয় অভিভাবক! আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুস‘আব বিন উমাইর [রা.] গিয়েছেন ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হতে। আপনার সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি ব্যর্থ অভিভাবক। জেনে রাখুন! রাসূল [সা.] বলেছেন, اَلاَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫] সুতরাং আসুন! সেদিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই, যেদিন আমার সন্তান আমার জান্নাতের গতিরোধ করবে।
বাংলাদেশের জনগন মূলত দু’টি বড় ধর্মের (মুসলমান ও হিন্দু) অনুসারী। শান্তিপূর্নভাবে যার যার ধর্মচর্চা এ দেশের ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু বর্তমানে কিছু আদর্শচ্যুত নামধারী মুসলমান হিন্দু ধর্মের কিছু পার্বনকে “সার্বজনীন উৎসব” হিসাবে প্রচার করতে শুরু করেছে উদ্দেশ্য মূলকভাবে। এ দেশের একটি গোষ্ঠী বাঙ্গালী হ’তে গিয়ে হিন্দু রীতির লৌহ নিগঢ়ে নিজেকে জড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক হ’তে চাইছেন। দুর্ভাগ্য হতভাগা মুসলমানদের, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজেছে। তবে বাংলাদেশের ১৫ কোটি বাঙ্গালী মুসলমান দুর্গাপুজা বা গণেশপুজার উৎসবকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি মনে করে না, এটাই সত্য। তাই আদর্শহীনেরা আমাদেরকে তা গিলাতে চেষ্টা করছে। সচেতন মুমিনদের উচিত বর্ষবরণের মতো এমন বেলেল্লাপূর্ণ এবং অর্থ ও সময়ের অপচয়সর্বস্ব অনুষ্ঠান হতে বিরত থাকা এবং সর্বস্তরের মুসলমানদের এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায় বিগত বছরের কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য সুপাথেয় সংগ্রহের জন্য উদ্যমী হওয়া।
আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
লেখক: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম