সাধারণত শবে বরাতকে মুসলমানদের একটি পর্ব বা খুশির দিন বলে মনে করা হয়। এর জন্য কিছু রসম রেওয়াজও গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো বেশ কড়াকড়ির সাথে পালন করা হয়। ধুমধাম ও জাকজমকের বিচারেতো যেন মোহররমের পরপরই এর স্থান। কিন্তু সত্য কথা হলো, এটা অযথা একটি মনগড়া পর্ব। না কুরআন মজীদে এর কোনো ভিত্তি আছে না হাদীস শরীফে। না সাহাবায়ে কেরামেট যুগের ইতিহাসে এর কোনো নাম নিশানা পাওয়া যায়। আর না প্রাথমিক কালের বুযুর্গানে দ্বীনের কেউ এটাকে ইসলামের পর্ব বলেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম রসম রেওয়াজ ও পালা পার্বণের দ্বীন নয়। ইসলামতো একটি সাদাসিধা ও যুক্তিসঙ্গত দ্বীন। এ দ্বীন মানুষকে রসম রেওয়াজের বেড়াজাল থেকে, খেল তামাশার অর্থহীন কাজকর্মে মশগুল হওয়া থেকে বাজে কাজ সময়, শ্রম ও সম্পদ অপচয় থেকে রক্ষা করে জীবনকে বাস্তব সত্যের দিকে আকৃষ্ট করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা ও কল্যাণের কাজে মানুষকে ব্যস্ত রাখে। এমন একটা দ্বীনে প্রকৃতির সাথে এরূপ কাজের কোনো সামঞ্জস্য নেই যে, সে বছরে একদিন হালুয়া রুটি পাকানো ও আতসবাজি করার জন্য নির্দিষ্ট করে দেবে আর মানুষকে বলবে যে, তুমি বিশেষভাবে প্রতি বছর নিজের জীবনের কিছু মূল্যবান সময় ও নিজের কষ্টার্জিত ধনের বেশ কিছু অংশ বরবাদ করতে থাকো। এর চেয়েও দূরতম কথা হলো এই যে, ইসলাম এমন কোনো রসম রেওয়াজ পালন করতে অভ্যস্ত করবে, যা শুধু সময় ও টাকা পয়সাই বরবাদ করে না, বরং কোনো কোনো সময় জীবননাশের ঘটনাও ঘটে এবং ঘরবাড়ী পর্যন্ত এই শিখা গিয়ে পৌছে। এ ধরনের বাজে কাজের নির্দেশ দেয়াতো দূরের কথা, যদি এমন ধরনের কোনো রেওয়াজ নবী করীম (সঃ) এর যামানায় বিদ্যমান থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই আইন প্রয়োগ করে তা বন্ধ করে দেয়া হতো। আর এ ধরনের যেসব রেওয়াজ সে সময় প্রচলিত ছিলো তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
হালুয়া ও আঁতশবাজীর ব্যাপারটাতো এতো পরিষ্কার যে, যে ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে সামান্য কিছুও জানে সেও প্রথম দৃষ্টিতেই বলে দেবে যে, এসব কাজ করা এ দ্বীনের স্পিরিটের খেলাপ। কিন্তু আমরা যখন তালাশ করি যে, সাবান মাসের এ বিশেষ দিনের সাথে কোনো নির্ভরযোগ্য ধর্মীয় আকীদা সংশ্লিষ্ট আছে কিনা অথবা কোনো আবশ্যকীয় ইবাদাত নির্ধারিত আছে কিনা,তখন এর কোনো নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। ইসলামী সাহিত্যে যদি বেশী কিছু পাওয়া যায় তা শুধু এই যে, একবার শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাত্রে হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বিছানায় না পেয়ে তালাশ করতে বেরিয়ে পড়লেন। তালাশ করতে করতে তিনি 'জান্নাতুল বাকী' কবরস্থানে গিয়ে তাঁকে পেলেন। এখানে আসার কারণ জিঙ্গেস করলে তিনি বললেন, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানের দিকে দৃষ্টি দান করেন এবং কালব গোত্রের ভেড়াগুলোর দেহে যে পরিমাণ লোম আছে তত সংখ্যক মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন। কিন্তু হাদীসের বিখ্যাত ইমাম তিরমিযী (রাহঃ) এ বর্ণনাটিকে "যয়িফ" বলেছেন এবং নিজের অনুসন্ধান সম্পর্কে বলেছেন, এ হাদীসের সনদ সঠিকভাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) পর্যন্ত পৌছে না। অন্য কতিপয় হাদীসে যা কিছু কম মর্যাদাসম্পন্ন হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায়, তাতে এ রাতের ফযিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এতে ভাগ্যের ফয়সালা করা হয়, জন্ম ও মৃর্ত্যুর বিষয় চুড়ান্ত করা হয়। কিন্তু এ হাদীসই দূর্বল। প্রতিটি হাদীসের সনদেই কোনো কোনো দূর্বলতা বিদ্যমান। এজন্য হাদীসের প্রাচীনতর ও অধিক নির্ভরযোগ্য কিতাবের কোথাও এ হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তারপরও যদি এর কোনো ভিত্তি স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলে শুধু এতটুকুই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, এ রাতে ইবাদাত করা ও আল্লাহর নিকট মাগফিরাত কামনা করা একটি উত্তম কাজ যা ব্যক্তিগতভাবপ করলেও সওয়াব পাওয়া যাবে। এসবই রিওয়ায়াত হতে এর বেশী কিছু প্রমাণিত হয় না, যার ভিত্তিতে মনে করা যেতে পারে যে, ১৪ তারিখে বা ১৫ তারিখের রাতকে ইসলামে ঈদ সাব্যস্ত করা হয়েছে অথবা কোনো সামাজিক ইবাদাত হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
হাদীসের অধিক নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ হতে যে কথা প্রমাণিত তা এই যে, রমযান মাস আসার আগেই শাবান মাসে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর উপর এক ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হতো। রমযান হলো সেই মাস, যে মাসে আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সঃ) কে নবুওয়তের মতো মহামান্বিত পদে অধিষ্ঠিত করেছেন এবং কুরআনের মতো চিরস্থায়ী কিতাব নাযিল শুরু হয়েছে। এ কারণে শুধু রমযান মাসেই তিনি অসাধারণ ইবাদাত বন্দেগীতে মশগুল হতেন না বরং এর আগে থেকেই তাঁর ধ্যান আল্লাহর সাথে লেগে যেতো। হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বরণনা করেছেন, রমযান ছাড়া বছরের বাকী এগারো মাসের মধ্যে শুধু শাবান মাসই এমন, যে মাসে তিনি সবচেয়ে বেশী রোযা রাখতেন। প্রায় গোটা মাসই তিনি রোযা অবস্থায় কাটাতেন। কিন্তু এ আমল শুধু তাঁর নিজের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। আল্লাহর সাথে তাঁর গভীর রূহানী সম্পর্কের কারণেই তা সম্ভব ছিলো। করআন নাযিল হওয়ার মাস থেকেই তাঁর এ বৈশিষ্ট্য ছিলো। সাধারণ মুসলমানদের জন্য শাবান মাসের শেষ পনর দিন রোযা না রাখার জন্য তিনি হেদায়াত দিয়েছেন। কেননা এ মাসের শেষের পনর দিন মানুষ রোযা রাখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লে, ধীরে ধীরে তা একটা অপরিহার্য প্রথায় পরিণত হয়ে যাবার আশংকা ছিল। আর রমযান মাসের ফরয রোযার উপর অযথা আরো দশ পনরটি রোযা যুক্ত হয়ে যাবে। এভাবে মানুষের উপর এমন একটা বোঝা চাপবে, যা আল্লাহ তাদর উপর চাপাননি।
ইসলামে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, আল্লাহপাক বান্দাদের উপর যে কাজ অপরিহার্য করেছেন, এছাড়া আর কোনো কাজ যেন বান্দাহ তার নিজের উপর অপরিহার্য করে না নেয়। কোনো স্বরচিত রসম রেওয়াজ, কোনো কৃত্রিম নিয়ম-কানুন, কোনো সামষ্টিক তৎপরতা এমন হতে পারবে না যার অনুসরণ লোকদের জন্য ফরযের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ কোন্ কাজের অনুসরণে রয়েছে, এবং কোন্ কাজের কতটুকু অনুসরণ রয়েছে, তা তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন। তাঁর কায়েম করা সীমা অতিক্রম করে বান্দাদের নিজ থেকে যদি কোনো রসম রেওয়াজ নির্দিষ্ট করে নেয় এবং ফরযের মতো গুরুত্ব দিয়ে পালন করে তাহলে তারা নিজেরা নিজেদের জীবনকে সংকটে ফেলবে। অতীতের জাতিগুলো এ ভূলই করেছিলো। তারা নতুন নতুন রেওয়াজ রীতি আবিষ্কার করে নিজেদের উপর ফরয ওয়াযিবের বোঝা চাপাতে থাকে এবং ধীরে ধীরে রেওয়াজ রসমের এমন এক জাল নিজেদের চারদিকে বিস্তার করে ফেললো যে, তা অবশেষে তাদের হাত পা বেঁধে ফেললো। রেওয়াজ রসমকে কুরআন জিঞ্জিরের সাথে তুলনা করে বলে দিয়েছে যে, মুহাম্মদ (সঃ) এর মিশনের একটা বড় কাজ হলো---এসব জিঞ্জির টুকরা টুকরা করে দূরে নিক্ষেপ করা, যার মধ্যে তারা নিজেদেরকে বেঁধে রেখেছে। এ কারণেই শরীয়াতে মুহাম্মদীতে ফারায়েযের একটা খুবই হালকা ও সহজ নিয়ম ঘোষণা করে বাকী সব রেওয়াজ রসমের অবসান ঘটানো হয়েছে। রমযানের ঈদ ও কুরবানির ঈদ ছাড়া আর কোনো পর্ব রাখা হয়নি। হজ্ব ছাড়া আর কোনো বাধ্যতামূলক সফর রাখা হয়নি। যাকাত ছাড়া কোনো নযর-নিয়ায বা দান-খয়রাত ফরয করা হয়নি। একটা চিরন্তন নীতিমালা ঠিক করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ফরয কাজে যেভাবে কিছু জিনিস হ্রাস করার অধিকার কারো নেই এভাবে বাড়াবাড়িরও নেই কোনো অধিকার।
প্রাথমিক কালে যেসব লোক শরীয়াতে মুহাম্মদীর প্রাণসত্তাকে বুঝতো তারা কঠোরভাবে এ নীতিমালা অনুসরণ করে চলতো। তারা কোনো নতুন রেওয়াজ প্রচলিত করা হতে বিশেষভাবে বিরত থেকেছেন এবং যে জিনিস বাধ্যতামূলক রসমে পরিণত হতে যাচ্ছে বুঝতে পারতেন, সাথে সাথে তার মূল কেটে ফেলতেন। তাদের জানা ছিলো, কোনো কাজকে নেকী ও সওয়াবের কাজ মনে করে প্রথম প্রথম খুব ভালো নিয়তেই শুরু করার পর ধীরে ধীরে তা কিভাবে প্রথম সূন্নাত তারপর ওয়াজিব তারপর ফরয এবং সবচেয়ে ফরযের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম জিনিসে পরিণত হয় এবং অঞ্জতার কারণে লোকেরা এই সাথে কিভাবে অসংখ্য খারাপ কাজকে মিশ্রিত করে একটি নিকৃষ্ট রসম বানিয়ে নেয় এবং এই প্রকারের রসম জমস হয়ে কিভাবে মানব জীবনে একটি এবং মানব জীবনের উন্নতির পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাড়ায়। এজন্য প্রাথমিক কালের আলেম ও ইমামগণ শরীয়াতে কোনো বাড়তি কাজের প্রচলন যেন গড়ে উঠতে না পারে, এদিকে কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, যা শরীয়াতে নেই তাকে শরঈ মর্যাদা দেয়া, অথবা যে কাজের শরীয়াতে যে মর্যাদা আছে তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়াই হলো ♦বিদায়াত♥ এবং প্রতিটি বিদায়াতই পথভ্রষ্টতা। কিন্তু দূঃখের বিষয়! পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এদিকে চরম অমনোযোগ ও অবহেলা প্রদর্শন করা হয় এবং মুসলমানরাও ধীরে ধীরে নিজেদের মনগড়া রেওয়াজ রসমের জালে এমনভাবে আটকে যেতে লাগলো, যেভাবে দূনিয়ার অন্যান্য জাতিও ফেঁসে গিয়েছিলো। এ ক্ষতির একটি বড় কারণ হলো---পরবর্তীকালে যেসব জাতি ইসলাম গ্রহন করে তারা ইসলামেরসঠিক তা'লীম তরবিয়াত পাননি। তারা নিজেদের সাথে তাদের পুরানো জাহিলিয়াতের অনেক ধ্যান ধারণা, অনেক নিয়ম পদ্ধতি নিয়ে ইসলামের সীমায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে শত শত বছরের রসম রেওয়াজ, পূঁজা-পার্বণ, মেলা, যাত্রা ইত্যাদি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। এগুলো ছাড়া তাদের ধর্মীয় জীবনে কোনো মজাি ছিলো না। Shah Jalal Miazi সহজ-সরল শরীয়াতের সীমার মধ্যে এসে ঐসব পুরানো রসম রেওয়াজের বোঝা নামিয়ে ফেলা ও পুরানো জিঞ্জিরের বন্ধন কেটে প্রশান্তি লাভ করার পরবর্তে এখানে এসে তারা ঐসব বোঝা কিভাবে আবার মাথায় উঠিয়ে নেবে যা ইসলাম নামিয়ে দিয়েছিলো, ওই সব জিঞ্জির চবার পরে নেবে যা ইসলাম কাটে দিয়েছিলো, সেই চিন্তা করতে লাগলো।
সূতরাং তারা কিছু প্রাচীন জাহিলিয়াতের রসম রেওয়াজের প্রকাশ্য রূপ পরিবর্তন করে রেখে দেয়, কিছু নতুন রেওয়াজ আবিষ্কার করে, এমনকি তাদের পুরানো ধর্মের মতো ইসলামকেও রসম রেওয়াজ ও পালা পার্বণের ধর্ম বানিয়ে ছাড়লো। এ নতুন রেওয়াজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাশা'আল্লাহ বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ব্যবহার করা হলো। ইসলাম মানুষের জন্য যে জীবন ব্যবস্থা ঠিক করেছে তার নীতিমালা জানার জন্য কুরআন হাদীস খুঁজে দেখা হয়নি, বরং নতুন নতুন রসম চালু করার জন্য বা প্রচীন জাহেলী রসম চালু রাখার জন্য কোনো বাহানা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপর যদি কোথাও সামান্যতম ইংগিতও মিলে যেতো তাহলে তার উপরই একটি পাহাড়সম ইমারাত নির্মাণ করে ফেলা হয়েছে। ইসলামে পালা পার্বণের যে অভাব ছিলো তা পূরণ করতে পেরেছে এই ভেবে লোকেরা আত্মতৃপ্তি বোধ করত। অথচ তারা নিজেদের অঞ্জতার কারণে সেইসব বেড়ী পরে নিলো যা ♦আল্লাহ ও তাঁর নবীর♥ মাধ্যমে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন এবং তারা তাদের নিজেদের সেই জালে ফাঁসিয়ে দিলো, যাতে আটকে পড়ে দূনিয়ার কোনো জাতি কখনো আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।
♦ বি: দ্রঃ লেখাটি ১৯৪৭ সালের আগে "অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ৪৭ সালের পরে রেডিও পাকিস্তান থেকে মাওলানার (রঃ) বেশ কিছু কথিকা প্রচারিত হয়। বর্তমান "ইসলামী অনুষ্ঠানের তাৎপর্য" নামে প্রকাশিত একটি বই থেকে।
(ইসলাম প্রিয় ঈমানদারদের লেখাটি পড়া অত্যন্ত জরুরী)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন