ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ স

আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট দক্ষিণগাও বাজার এর পক্ষ থেকে সকল গ্রাহক, শুভাকাংখীসহ সবাইকে জানাই সালাম শুভেচ্ছা। এইগ্রুপে যারা আছেন তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার এলাকারসকলকে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটপন্স পাঠানোর আহবান জানাচ্ছি। রাজারবাগ, কুসুমবাগ, দক্ষিনগাও, শাহীবাগ, মানিকদিয়া, বাইকদিয়া, নন্দিপাড়াসহ সকল এলাকার গ্রাহক, শুভাকাংখী, শুভানুধ্যায়ীদের প্রদত্ত মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হলোঃ ০১৭১১-৪৫৮১৫১, ০১৭০০৯২৫২৪১

রবিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৮

একজন পরাজিতের বিজয় ভাবনা


বাংলাদেশ বার্তাঃ আমি একজন পরাজিত মৌলবাদী। একসময় শিবির করেছি তুমুল। পরে ছিলাম জামায়াত নেতা। ওসব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে এখন পরাজিত, পরিত্যক্ত কিন্তু পুনরায় যুদ্ধে নেমে বিজয়ী হওয়ার স্বপ্নগ্রস্ত এক যৌবন-বিগত যুবক। বর্তমান সরকারের দমন-পীড়নের সাথে আমার এ নতুন পথচলার সম্পর্ক কয়েনসিডেন্টাল বা নিছক কাকতালীয়। আসলে জীবন সম্পর্কে আমার এমন কিছু উপলব্ধি উৎপন্ন হয়েছে যা আগে কখনো এতটা এভাবে অনুভব করিনি।
আজকে কিছু কথা অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বলতে চাই। আমার ধারণায়, মানুষেরা সাধারণত কিছু মৌলিক প্রবৃত্তি বা চাওয়াকে কেন্দ্র করে বাঁচে। এরমধ্যে কিছু তার (১) জৈবিক-সহজাত প্রবৃত্তি, কিছু তার (২) সাংস্কৃতিক-সহজাত প্রবৃত্তি, কিছু তার (৩) বুদ্ধিবৃত্তিক-সহজাত প্রবৃত্তি। আর কিছু হলো তার (৪) আধ্যাত্মিক-সহজাত প্রবৃত্তি।
ক্ষুধা, যৌনতা, নিদ্রা ও নিরাময় – এগুলো হলো মানুষের physical instinct বা জৈবিক-সহজাত প্রয়োজন। আনন্দময়তা সংশ্লিষ্ট আর্টস ও সোশ্যাল বিষয়গুলো হলো মানুষের cultural instinct বা সাংস্কৃতিক-সহজাত চাহিদার ব্যাপার। দর্শন ও বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো হলো মানুষের intellectual instinct বা বুদ্ধিবৃত্তিক সহজাত প্রবৃত্তির ব্যাপার। এর পাশাপাশি, এক পরম সত্তার সন্ধানে ব্যাপৃত থাকা, মৃত্যুর পরেও নিজেকে কোনো না কোনো ধরনের অস্তিত্বগত ধারাবাহিকতায় যুক্ত করে কর্মতৎপর হওয়া, পরজীবনের কল্পনা, কিংবা এ জীবনকে পরজীবনের মতো সুন্দরতম করে গড়ে তোলার ইউটোপিয়াকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা, এককথায় মানুষের মধ্যে অতিবর্তীতার যেসব বৈশিষ্ট্য, তা হলো তার spiritual instinct বা আধ্যাত্মিক-সহজাত প্রবৃত্তির পরিচায়ক।
মানুষ ১ম পর্যায়ের চাহিদাগুলোর জন্য ২য়, ৩য় বা ৪র্থ পর্যায়ের চাহিদা পূর্ণ না হওয়াকে মেনে নিতে পারে। ১ম পর্যায়ের চাহিদাগুলো পূরণ হওয়া সাপেক্ষে ২য় পর্যায়ের চাহিদাগুলো তার কাছে মূল চাওয়া। যা সে কোনো মতেই ছাড়তে চায় না। ১ম ও ২য় পর্যায়ের চাহিদাগুলো পূরণ হওয়া সাপেক্ষে ৩য় পর্যায়ের চাহিদাগুলো তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে ১ থেকে ৩ নম্বর ক্যাটাগরির চাহিদাগুলো ন্যূনতম মানে পূরণ হওয়া সাপেক্ষে মানুষ ৪র্থ ক্যটাগরির চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।
ছোটবেলা থেকে একটা ধারার ইসলামী সংগঠনে কাজ করে মানুষের মৌল প্রবৃত্তি সম্পর্কে আমার উল্টো ধারণা গড়ে উঠেছিলো। তখন ভাবতাম ১ নম্বরে হলো মানুষের আধ্যাত্মিকতা, ২ নম্বরে বুদ্ধিবৃত্তি, ৩ নম্বরে সংস্কৃতি ও ৪ নম্বরে জৈববৃত্তি। এখন বুঝি, তখন কতো ভুল বুঝেছিলাম।
না, শিবিরের সিলেবাস ভূক্ত কোনো বিশেষ বইয়ে এটি লেখা নাই। বরং, সেখানকার যে আবহ তাতে এই ধরনের একটা ফলস প্যারাডাইম গড়ে উঠেছিলো। বড়কথা হলো, জীবন সম্পর্কে এই ধরনের নিতান্ত ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে মসজিদ-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এ দেশের বৃহত্তর ধর্মীয় পরিমণ্ডলে। তাই, সব ইসলামী সংগঠনের মাইন্ডসেট হলো, মানুষের জন্য এক নম্বরের বিষয় হলো তার আধ্যাত্মিকতা।
মানুষের আধ্যাত্মিকতার চাহিদা সম্পর্কে ভুল ধারণা কারণে তাদের এই ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে। উনাদের ধারণায়, স্রষ্টার অস্তিত্ব হলো মানব জ্ঞানের কেন্দ্র বা সূচনাবিন্দু। অথচ, মানুষের সব জ্ঞানের কেন্দ্র হলো তার নিজের অস্তিত্ব তথা আত্মসত্তার একান্ত অনুভূতি। নিজের পরিচয় জানতে গিয়েই মানুষ জগত সম্পর্কে জানতে চায়। জগত সম্পর্কে জানতে গিয়ে সে এক পর্যায়ে যুক্তি ও উপলব্ধির সিঁড়ি বেয়ে পরমসত্তার অস্তিত্ববিশ্বাসে উন্নীত হয়।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির চূড়ান্ত পরিণতি হলো আধ্যাত্মিকতা। ইসলাম যতটুকু জেনেছি, তাতে বুঝেছি, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির এই ক্রমসোপান বা hierarchyকে ইসলাম অনুমোদন করে। বরং, ইসলামের প্রস্তাবনাটাই হলো মানুষের চাহিদাগুলোকে ভিত্তিস্তর, মধ্যস্তর, উন্নত স্তর ও লক্ষ্য-স্তরের এ’ ধারায় সুবিন্যাস্ত করা।
মুশকিল হলো, আমরা যখন কোরআন-হাদীসের মতো বেসিক টেক্সটগুলো হতে পাঠ করি তখন আমরা প্রায়শঃই নিজেদের আশপাশে বিদ্যমান স্টাবলিশমেন্টের পক্ষে দলীলগুলোকে খুঁজে পাই। টেক্সটের নিরপেক্ষ পাঠ বলে কিছু নাই বলে পোস্টমর্ডানিস্টরা বেশ বলাবলি করে। তাদের কথাগুলো স্রেফ স্ববিরোধী বা self-refuting আঁতলামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার মতে, সব টেক্সটেরই নিরপেক্ষ পাঠ আছে। সেটা হলো, লেখক কোন প্রেক্ষাপটে, কোন অবস্থানের পক্ষে, বা বিপক্ষে লিখেছেন, তা অনুধাবন করে টেক্সট-এর অর্থ নিরূপণ করা।
সে হিসাবে কোরআন ও হাদীসের টেক্সটগুলোকে যদি আমরা জীবনবাদী-সমাজকর্মীর দৃষ্টিতে দেখি তাহলে বুঝবো, কীভাবে এখানকার ধর্মীয় সংগঠনগুলো ইসলাম উল্টা করে অর্থাৎ ‘পা উপরে আর মাথা নীচে’ করে দাঁড় করিয়ে ইসলামকে সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা ভাবেন, পরজীবনের জন্যই তো এ জীবন। অথচ, এ জীবনের ন্যায্য ধারাবাহিকতাই হচ্ছে পরজীবনের যৌক্তিকতা ও স্বার্থকতা। তারা ভাবেন, খোদা আছেন ধরে নিয়ে তো সবকিছু বিবেচনা করা উচিত। অথচ, আমি আছি, এ ব্যাপারে অন্তত আমি নিঃসন্দেহ বলেই আমি জীবনের অস্তিত্ববাদী আত্মঅনুসন্ধানের এক পর্যায়ে খোদার অস্তিত্বে ঈমানদার হয়ে উঠি। আদর্শের মূল এপ্রোচটা সোশ্যাল, এটি বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক আদর্শবাদীরা মানতে চান না।
বিশেষ করে, ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে যদি বলি, ইসলামকে তারা মূলত ধর্ম হিসাবে মনে করে। তারচেয়েও অদ্ভূত ব্যাপার হলো, তারা মনে করেন, ইসলাম মোতাবেকই সবকিছু হওয়া উচিত। অথচ, ধর্ম হলো মানুষের অন্যতম ব্যক্তিগত ও সামাজিক ফেনোমেনা। উপরে আমি যে স্কেল দিয়েছি তাতে ধর্মের অবস্থান ৪র্থ নম্বরে। তাই, সবকিছু কেনো ধর্মভিত্তিক হওয়ার দাবী কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আমার কাছ হতে এ ধরনের কথা শুনে তারা ভীষণ আশ্চর্যান্বিত হবেন। ভাববেন, এর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাদের যুক্তি হলো, মানুষের জীবনের সব আসপেক্ট নিয়েই তো কোরআনে সুস্পষ্ট ও স্বনির্ভর বক্তব্য ও গাইডেন্স আছে। তাহলে ইসলামপন্থীরা কেনো মানষের জীবনের সবকিছুতে ইসলাম নিয়ে হাজির হতে পারবে না?
হ্যাঁ, আমিও মনে করি, মানুষের জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিয়ে ইসলামের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও কনসিসটেন্ট বক্তব্য আছে। বরং আমার কাছে তা সেরা। তারচেয়েও বেশি। বরং, ইসলামই আমার কাছে একমাত্র পরিপূর্ণ সত্য, যা মানুষের জীবনকে সুসংগতভাবে, জীবনের সব আসপেক্টগুলোকে প্রপার ওয়েতে কাভার করে। তাই, ইসলাম আমার কাছে একটা আদর্শ ক্যাটাগরির বিষয়। ধর্মমাত্র নয়। the category of ideology, not of religion।
আধুনিক ইসলামিস্টদের মতো, ইসলাম আমার কাছে এমন ধর্ম নয় যার মধ্যে রয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি। কথাটা আগের লাইনে যেভাবে বললাম, ইসলাম আমার কাছে একটা জীবনাদর্শ। যেটার মধ্যে আছে ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি। এ’সব একটা আরেকটা হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও নয়, আবার এগুলো একাকারও নয়। বরং, একটা বহুতল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের মতো এগুলো স্বতন্ত্র অথচ পরষ্পর নির্ভরশীল।
সাধারণভাবে বলা যায়, ইসলামপন্থীরা মোটাদাগে ধর্মীয় প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ। সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি, এক কথায় সবকিছুকে তারা ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখে থাকে। যার কারণে, মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোকে তারা ঠিক মতো বুঝতে পারে না। সমাজের পালসকে তারা ঠিক মতো ধরতে পারে না। যুগের সেন্টিমেন্টকে তারা প্রপারলি রিড করতে পারে না। বরং অবুঝ এক আধ্যাত্মিকতার আবেগে সবকিছুকে তারা ধর্ম বনাম অধর্মের এক ফলস বাইনারিতে মূল্যায়ন করে।
আমি যা বলছি তা আমার অভিজ্ঞতা হতে বলছি। আমার কথা পরিষ্কার। মানুষের সহজাত চাওয়াগুলোকে দমিয়ে রেখে ইতিবাচক কিছু অর্জন করা অসম্ভব। বরং এগুলোর কোনোটির চাওয়া-পাওয়ার সাথে অন্যটির সমন্বয় হতে পারে। একটা একটু বেশি পেলে অন্যটা কিছুটা কম পেলেও মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে পারে। কিছুটা কম-বেশ করে কোনো সামাজিক ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে রান করতে পারে। কিন্তু, কোনো সমাজ, রাষ্ট্র বা অথরিটি এই সহজাত চাওয়াগুলোর কোনোটিকে স্থায়ীভাবে বা সিগনিফিকেন্টলি দমন বা অস্বীকার করতে চাইলে মানুষ কোনো না কোনো উপায়ে ঠিকই সেই চাহিদাকে পূরণ করার পথ খুঁজে নিবে। প্রয়োজনে সে বিপ্লব ঘটাবে। এমন কি, আধ্যাত্মিকতার চাহিদা মিটাবার জন্যও মানুষ বিপ্লব ঘটাতে পারে, যদি তার আধ্যাত্মিকতা চর্চার স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। মানুষ নিজের সহজাত প্রয়োজন পূরণে বিকল্প পথ খুঁজে নেয়া বা প্রয়োজনে বিপ্লব করার এই ফর্মূলা প্রযোজ্য হতে পারে উপরে বর্ণিত ১ থেকে ৪ পর্যন্ত ক্যাটাগরির যে কোনোটির জন্যই।
আনন্দময়তা হলো মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ের মৌলিক প্রবৃত্তি। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এর চর্চা মানুষ করে। যদি বলি, আমি বুঝি না, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ইসলামপন্থীদের কেনো এত নেতিবাচক মন-মানসিকতা, তাহলে তা ভুল বলা হবে। আমি জানি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ধর্মের দৃষ্টিতে সবকিছু দেখাই হলো ইসলামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গীগত মূল সমস্যা। এই সমস্যার কারণ উপরে বলেছি। তারা ইসলামকে সেরা ধর্ম মনে করে। বহু বছর আগে লিখেছিলাম, Islam must be rescued from it’s religion image। ইসলামকে ধর্ম-পরিচিতি হতে উদ্ধার করা না গেলে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর এই প্রেক্ষিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, মার্কসের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মতোই অসম্ভব ব্যাপার। ইসলামকে আমি নিছক ইউটোপিয়া হিসাবে মানতে রাজী নই।
কিছুদিন আগে কয়েকজনের সাথে একটা দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। তাতে ধর্ম, আদর্শ ও ইসলামের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর তালিকা তৈরী করে তাদেরকে দেখিয়েছিলাম, ইসলাম মূলত একটা জীবনাদর্শ হিসাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করে। ধর্ম এর অংশ মাত্র। ধর্মের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলোর অধিকাংশকেই ইসলাম সরাসরি অস্বীকার বা রিফিউট করে।
একজন ইসলামিস্ট হিসাবে নিজের সম্পর্কে আমার অনুভূতি পরাজয়ের। নিজেকে আমি এ সমাজে পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের কাছে একজন অপাংক্তেয় হিসাবে খুঁজে পাই। পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে অধিকাংশের কাছে আমার কথাগুলো অভিনব বা heretic। ধর্মবিরোধী পক্ষ ইসলামকে ধর্ম হিসাবে চিহ্নিত করে একে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। অপরপক্ষ ইসলামকে super-inclusive religion বা ‘সবকিছুওয়ালা ধর্ম’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। আমার দৃষ্টিতে, ইসলাম সম্পর্কে এই ডমিন্যান্ট এপ্রোচের দু’টাই ভুল।
আমরা মানুষ। এটি আমাদের মূল পরিচয়। এরপরে আমাদের বাদবাকী যা কিছু পরিচয়, পরিচিতি, আইডেন্টিটি। আচ্ছা হলো, আমরা মানুষ। এরপর কী? ‘মানুষ’ বলতে কী বুঝবো? এ’ ধরনের বেসিক প্রশ্ন উত্থাপন ও অনুসন্ধানের পরিণতি হলো যার যার জীবনাদর্শ। এই ধরনের সোল-সার্সিং প্রসেসের ending বা উত্তর হিসাবে বাজারে যেসব ‘আদর্শিক পণ্য’ আছে তার একটি হলো ইসলাম। আমার কাছে মানুষের আত্মপরিচয় সংক্রান্ত উত্তরমালার মধ্যে ইসলাম হলো সবচেয়ে নিখুঁত, সুসামঞ্জস্য প্রস্তাবনা। তাই, এটি আমার কাছে একমাত্র সঠিক উত্তর।
জীবনাদর্শ হিসাবে ইসলাম কীভাবে ‘অপর’কে একোমোডেইট করে তা ‘ইসলামী মতাদর্শের আলোকে সামাজিক আন্দোলন’ শিরোনামে আমার লেখায় সংক্ষেপে তুলে ধরেছি। এর একটা অংশ হলো নিম্নরূপ।
প্রতিটা মানুষরই রয়েছে তিন ধরনের জাতিগত পরিচয়। (১) রাজনৈতিক জাতীয়তা, (২) নৃ-তাত্ত্বিক জাতীয়তা, ও (৩) ধর্মীয় জাতিয়তা। এর কোনোটি অপরটির বিকল্প নয়। বরং, এগুলো পরষ্পর পরিপূরক। ১লা বৈশাখ উদযাপন যদি ধর্মবিরুদ্ধ হয়, তাহলে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কেনো ধর্মসিদ্ধ হবে? দুই ঈদ ছাড়া যদি কোনো জাতীয় দিবস উদযাপন নাজায়েয হয়, তাহলে ‘বদর দিবস’ বা ‘বালাকোট দিবস’এর মতো প্রচলিত ধর্মীয় দিবসগুলোর উদযাপন কী করে জায়েয হবে?
আগে একুশে ফ্রেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়াটা হারাম মনে করতাম। প্রফেসর আনোয়ারুল হক খতিবী স্যারকে এ ব্যাপারে একদিন জিজ্ঞাসা করাতে উনি বেশ ক্ষুদ্ধ হয়ে এ সংক্রান্ত কিছু কথা বললেন। উনার সাথে কথা বলে জানলাম, এগুলো হলো সন্দেহজনক বা বেহুদা কাজ। শরয়ী পরিভাষায় এগুলোকে ‘উরুফ’ বা লোকাচার বলে। কোনোকিছু হারাম হওয়ার জন্য ‘নস’ বা অকাট্য দলীল প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি সব হারামগুলোকে সুষ্পস্টভাবে বর্ণনা করেছি’। ইউসুফ কারজাভির ‘ইসলামে হারাম ও হালালের বিধান’ হতে জেনেছি, হারাম না হওয়া সাপেক্ষে সবই প্রাথমিকভাবে হালাল হিসাবে বিবেচনাযোগ্য।
আজকে পহেলা বৈশাখের এই দিনে একজন ইসলামপন্থী হিসাবে নিজেকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে পরাজিত বোধ করছি। মানুষকে হালাল আনন্দময়তার সুযোগ না দেয়ার পরিণতিতে মতলববাজ প্রগতিশীলদের সাথে এ দেশের ইসলাম অনুসারী বৃহত্তর জনগণ এক ধরনের বৈপরিত্যমূলক সমঝোতা করে নিয়েছে, যা বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। জনগণের দিক থেকে এর কোনো গত্যন্তর নাই। জাহাজের উপরতলার লোকেরা পানি সরবরাহ না করাতে ডেকের লোকেরা তলা ফুটা করে পানি সংগ্রহ করতে চাওয়ার মতো ব্যাপার।
আনন্দয়তার সব পথ রুদ্ধ করে মানুষকে কঠোরভাবে ধার্মিক বানাবার দৃশ্যমান চেষ্টা বুমেরাং না হয়ে পারে না। এটি অনিবার্য। মানুষ সব সময়ে আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়ে জীবনযাপন করে না। এমন কি, মানুষ সব সময়ে বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারাও পরিচালিত হয় না। এমন কি বুদ্ধিজীবীরাও না। মানুষ, জীবনের এক একটা দিক থেকে এক একটা প্রয়োজনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কোনো আদর্শ নিখুঁত হতে হলে তাকে মানুষের বাস্তব চাহিদাগুলোকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা জরুরী। আমার দৃষ্টিতে, ইসলাম তেমনি একটা প্রাকৃতিক জীবনাদর্শ।
অথচ দেখেন, মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা তথা চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থাই নাই। যে কোনো ধরনের ক্রীড়া ও আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারে ইসলামপন্থীরা ওভারঅল নেগেটিভ। নারীদের সাজগোজকে তারা নিতান্ত খারাপ মনে করে। এমন কি, সুস্পষ্ট হাদীস থাকা সত্বেও তারা নারীদের মসজিদে প্রবেশাধিকারকে হরণ করেছে। মেয়েরা মাজারে জেয়ারত করতে পারে কিন্তু মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য অনুমতি পায় না। ইসলামপন্থীরা দেশের ক্ষমতা পেতে চান, অথচ, নারীদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক ন্যায্য মানবিক অধিকার প্রদানে তারা অসম্মত।
প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি ‘নিউস্কিম মাদ্রাসা’র মতো সব যুগোপযোগী সব বিষয়ের শিক্ষা দেয়া হতো তাহলে হয়তোবা, ইংরেজী শিক্ষা বনাম মাদ্রাসা শিক্ষার এই দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে একমুখী শিক্ষা এ দেশে কায়েম থাকতো।
ইসলামপন্থীদের গোঁড়ামি, প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মান্ধতা, বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি নেতিবাচকতা, আখেরাতের নামে জীবন-বিমুখিনতা, বিশেষ করে নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিকতার পরিণতি হলো ধর্ম ছাড়া সব অংগনে তাদের আধিপত্যহীনতা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের অস্তিত্বহীনতা ও পরাজয়। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ময়দানে। 
একজন জীবনবাদী সমাজকর্মী হিসাবে যেখানে মানুষের সমাগম সেখানে আমি সাধারণত ঘুরে আসি। মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করি। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, এরপর কীভাবে কী করা যেতে পারে, তা ভাবার চেষ্টা করি। শিবিরের সদস্য সম্মেলনের ফাঁকে যখন শাহবাগের শিশু পার্কে গিয়েছিলাম, তখনও আমার মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টিভংগী কাজ করেছিলো। যখন একটা শিক্ষক সংগঠনের নেতা ছিলাম তখনও বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বৈশাখের অনুষ্ঠানে গেছি।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য এবার বের হই নাই। আমার মেয়েরা ঘুরে এসেছে। ডিপার্টমেন্টের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বসে নিজেকে পরাজিত বোধ করেছি, বারে বারে। যেমন করে অপরাপর ইসলামপন্থীদের মতো আজকেও কেমন জানি পরাজয়ের খানিকটা গ্লানি ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই দিক থেকে এ দেশের বামপন্থীরা জয়ী। তাদের দৃষ্টিতে একটা ‘ধর্মান্ধ’ সমাজে তারা সংস্কৃতির খোলা মাঠে মুহূর্মুহূ গোল দিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামপন্থীদের কূপমণ্ডুকতার কারণে তারা এ দেশের এমনকি ধার্মিক জনগোষ্ঠীকেও সাংস্কৃতিক চেতনায় বেশ খানিকটা ধর্মহীন হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
ধর্মের মধ্যে আনন্দময়তা চাই না। ‘সনাতন ধর্মে’র মতো আনন্দময় ধর্মও চাই না। চাই, আনন্দময় মানব জীবন। প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক, ও ওভারঅল একটা তুষ্ট জীবন। চাই, বুদ্ধি সংগত জীবন। চাই, আধ্যাত্মিক জীবন। এগুলোর একটা আরেকটার বিকল্প হিসাবে নয়। বরং, পরিপূরক হিসাবে। খাওয়া-পরা, নিরাময় ও প্রজননের প্রয়োজন পূর্ণ হোক। আনন্দময়তা থাকুক ইঞ্জিন-অয়েলের মতো পর্যাপ্ত। বুদ্ধির চর্চা হোক অবারিত। আধ্যাত্মিকতার চাহিদা পূরণ হোক যথার্থ মানে। তবেই তো সে জীবন পূর্ণ জীবন, শুদ্ধ জীবন। চাই এমন সমাজ যেখানে মানুষের সব সহজাত প্রবৃত্তি নিবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে ন্যায়সংগত উপায়ে, ন্যূনতম মানে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ, একদেশদর্শী ও আরোপিত কোনো শুদ্ধ জীবন চাই না।
যখন এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হবে তখন শুধু নিজেকে ভাববো, বিজয়ী। আজকের এই পরাজয় গ্লানির সাথে সাথে ভেতর থেকে টের পাচ্ছি তেমন এক বিজয়-সম্ভাবনার পদধ্বনি। আগামীদিনের এই ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে আজকে যারা সর্বাত্মকভাবে কাজ করতে চান, তাদের প্রতি রইলো অভিবাদন, সালাম। আপনারাই সত্যিকারের মানুষ। বাকীরা সব জনগণ। তেমনই সাংসারিক বিবেচনায় ‘বেকুব বিপ্লবীদের’ একজন হিসাবে নিজেকে ভাবতে ভালো লাগছে।
জীবন মানেই খানিকটা জয়, খানিকটা পরাজয়। একাট্টা জয়, সবসময়ে ভাল নয়।
এ’ লেখা এতটুকু পর্যন্ত যদি পড়ে থাকেন, আমার লেখার বিষয়বস্তু বা মান যা-ই হোক না কেন, পাঠক হিসাবে আপনি নির্ভেজাল উঁচুমানের ধৈর্যশীল, সফল। তাই, শুভেচ্ছা আপনার প্রতি। ভালো থাকুন। পারলে, আসুন, বিপ্লবী হই। সূচিত এই বিপ্লবের অগ্রযাত্রায় সামিল হই। ক’দিনই-বা আর বাঁচবো …। একদিন তো মরেই যাবো ….! জানেন তো, বিপ্লবী হওয়া মানে প্রাকারান্তরে মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়া। তা যে আদর্শে পক্ষেই হোক না কেন ….।
তাই, গোবেচারা নির্বিবাদী সুশীল নাগরিক হওয়ার চেয়ে বিপ্লবী হওয়া লং টার্মে অধিকতর লাভজনক। বিশেষ করে ইসলামের মতো সভ্যতা-সঞ্জিবনী আদর্শ যখন আপনার আছে, তবে আর চিন্তা কী? নাজাত-লোভী হয়ে মৃত-প্রায় জীবনযাপনের চেয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়াই বেহেতর নয় কি?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক জনাব মুজাম্মিল হোসাইনের স্ট্যাটাস থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন