জনাব নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী আপনি। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সুতরাং সে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সরকারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
জনাব মোদী, আপনি যখন বাংলাদেশ সফর করছেন, তখন এখানে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন একেবারেই শূন্যের কোটায়! এর কারণ বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে এই অবৈধ ও একদলীয় সরকার জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে। এর মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে গণতন্ত্রের কবর।
পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও ভারতের কংগ্রেস সরকার বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের মূল মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যা দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত। ভারতের এমন আচরণে এদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ দারুনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ভারতের মতো একটি বড় শক্তি যদি আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষাভাবে সহযোগিতা না করতো তাহলে আওয়ামী লীগ কখনো ২০ দলীয় জোট এবং অন্যান্য দলগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করার সাহস পেত কি?
৫ জানুয়ারিতে গণতন্ত্র হরণের নেতৃত্ব দানকারী ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংহকে আপনার সরকার চাকরিচ্যুত করে লঘু শাস্তি দিয়ে এদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছেন। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মূলতঃ তখন থেকেই এদেশের জনগণ গণতন্ত্র উত্তরণে আপনার আশু সহযোগিতার প্রত্যাশী হয়ে উঠে। সতরাং বাংলাদেশের গনতন্ত্র উত্তরনে আপনার এ সফরকে দেশের জনগন ও আন্তর্জাতিক মহল অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।
জনাব মোদী, বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করে ভারত কি কখনো লাভবান হতে পারবে? অবশ্য আপনার সরকারের তৎপরতা বলছে এই অঞ্চলকে ভারতের স্বার্থেই স্থিতিশীল রাখতে চান। তাছাড়া ওবামার ভারত সফরেও বাংলাদেশ ইস্যুটি গুরুত্ব পেয়েছে। সেটিই যদি সত্য হয় তাহলে অবৈধ ভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
৫ জানুয়ারি ভোটার বিহীন নির্বাচনের নামে সিলেক্টিভ এই সরকার সারা পৃথিবী থেকে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভারতের যে কংগ্রেস সরকারের ইশারায় আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে তারাও এখন দিল্লির মসনদ থেকে ছিটকে পড়ে আপনি এখন ক্ষমতায়। অনেকেই মনে করছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় হতো কংগ্রেস থেকে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ কংগ্রেস থেকে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুনীতি আর অপকর্মের পাল্লা অনেক ভারী।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন খুবই নাজুক। আমাদের বিশ্বাস এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে আপনার তা অজানা নয়। আপনি এও জানেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভারতের চতুর্থ রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশের তালিকা এখন বাংলাদেশ অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং দু’দেশের স্বার্থেই এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই জরুরী।
জনাব মোদী, আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রহীনতা, হিংসা, বিদ্বেষ আর বিভেদের সুযোগে ভারত সহ অনেক দেশই তাদের নিজ নিজ অনেক উদ্দেশ্য এখন হাসিল করতে পারে এটি সত্য। কিন্তু এদেশের জনগণ এটিকে খুব ভালোভাবে গ্রহন করবে না।
জনাব নরেন্দ্র মোদী আপনি জানেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন: -Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit.অর্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে নয়। ”জনাব মোদি আপনি হয়ত এমন পুরাতন ডকট্রিনে বিশ্বাস করেন কিনা তা অবশ্য সময় বলে দিবে।
জনাব মোদী, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। মানুষের মহৎ কর্মেই তাকে চিরজীবী করে রাখে মানুষের হৃদয়ে। খাদের কিনারায় দন্ডায়মান ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের গণতন্ত্র আইনের শাসন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে এ ভূখন্ডের জন্য একেবারে জরুরী।
জনাব মোদী আপনি জানেন বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম জনপদ। এদেশের নব্বই শতাংশ জনসমষ্টিই এক কালেমায় বিশ্বাসী। ৬১৮ খৃষ্টাব্দে রাসুল (স:)-এর সময় একটি প্রতিনিধিদল এখানে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। ভারতের তামিলনাডুর উপকুলীয় অঞ্চল মালাবাবের তৎকালীন রাজা চেরুমল রপরুমল রাসূল স. এর যুগেই ইসলাম গ্রহন করেন। ফলে এই এলাকা ইসলামের কেন্দ্রে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে মুসলিম শাসনের গোড়া পত্তন। ”
৭১২ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয় থেকে শুরু করে আজ অবদি অসংখ্য ইসলামের বীর মুজাহিদ ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। এখানে চলে আসা দাওয়াতী কার্যক্রম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ও প্রায় ছয় শতাব্দী পূর্বের। ফলে জনগণ ও ইসলামের সেতু বন্ধন অনেক পুরাতন। এই দর্শন, মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে এখানের জনসাধারণ সকল বাধা- বিগ্ন, চক্রান্ত ও যড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছে দূর্বার গতিতে। অকাতরে জীবন বিলিয়েছেন কিন্তু অন্যায় আর অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি। আগামীতেও করবে না॥
কাঠমুন্ডকতা, অসহিষ্ণুতা, উগ্রতা, একগুয়েমী, কোন সমাধান হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি, পারস্পারিক, আস্থা, সমঝোতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব একটি বাসযোগ্য পৃথিবী চিত্রাঙ্কন। আসুন আমরা সকলে ভেদাভেদ ভুলে সেই পথেই এগিয়ে যাই।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা স্থায়ী করতে প্রতিপক্ষ দমন ও ভারতবিরোধী বলে ইসলাম পন্থীদের শায়েস্তা করতে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের সহযোগিতা পাবে না। আপনার সফরের পর জনগণ এটাই দেখতে চায়। ভারত এদেশের জনগনের বন্ধু, কোন পরিবারের নয়। আপনার এ সফরের মধ্য দিয়ে তার বাস্তবায়নের শুভ সূচনা হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
জনাব মোদী, আমরা বাংলাদেশ-ভারত ভালো সম্পর্কের পথ রচনা করতে চাই। করতে চাই ভুল বুঝাবুঝির অবসান। মীমাংসা করতে চাই এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা, সীমান্ত সহ অসম নানা সমস্যার সমাধান। এদেশের মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, আপনার এ সফরের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মৈত্রী সম্পর্ক অনেক উচ্চতায় পৌছে যাবে। আপনার এ সফরের মাধ্যমে এদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশে উত্তরণের আপনি হয়ে উঠবেন এদেশের মানুষের কাছে অনেক প্রিয়।
আমাদের বিভেদের সুযোগে শুধু নিজের দেশের জন্য নিয়েই যাবেন না বরং এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাংখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অনন্য ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন। এদেশের জনগণ সে দিকেই অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে। জনাব নরেন্দ্র মোদী আপনার প্রতি অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন