বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ আমার হৃদস্পন্দন, আমার ভাললাগা-ভালবাসা, আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হাফিজাহুল্লাহ'র সাথে সাক্ষাত করতে পারছিনা আজ ২ মাস ১৬ দিন। শেষবার যখন আব্বার সাথে সাক্ষাতে গিয়েছিলাম সেবারও আমাদেরকে দেখা করতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ, গেট থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাদেরকে।
জানিনা বর্তমানে করোনার এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমার ৮১ বছর বয়স্ক অসুস্থ আব্বা কেমন আছেন আর কীভাবেই বা আছেন? কোন রকমের কোন যোগাযোগই করতে পারছিনা।
গতকাল কারা ফটকের টিএন্ডটি নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম ঈদ উপলক্ষে পরিবারের ২/১ জনকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবে কিনা তা জানার জন্য। ফোন রিসিভকারী ব্যাক্তি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে কঠিন ভাষায় জানিয়ে দিলেন, 'সাক্ষাত হবেনা।' আমি বললাম, 'পত্রিকায় দেখতে পেলাম সরকার কারা বন্দীদেরকে ২/৪ মিনিট তার স্বজনদের সাথে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। সাক্ষাত যদি নাও হয় তবে অন্ততঃ আমাদেরকে ২/৪ মিনিট মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দিন।' ওপাশ থেকে উত্তর এলো, 'এ সুযোগ সাধারণ হাজতী বা কয়েদীদের জন্য, দাঙ্গাবাজ কোনো আসামীর জন্য নয়।'
কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলাম। নতুন করে জানলাম, কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদী সরকারের দৃষ্টিতে শুধু যুদ্ধপরাধীই (!) নন, ভয়ংকর দাঙ্গাবাজও (!) বটে। চোখের পানি মুছলাম। আকাশ পানে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে আমার যা বলার তা বলে দিয়েছি।
আমার মনে পড়ছে আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ২০১০ সালের ২৯ জুন আমাদের শহীদবাগের বাসা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আমার আব্বা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের হাস্যকর এক মামলায় গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেই থেকে কেটে গেছে ১০টি বছর। একে একে হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে ২০টি ঈদ।
যে মানুষটি বিগত ৫০টি বছর ধরে বিশ্বব্যাপি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি জনপদের মানুষকে কোরআনের দাওয়াত দিয়েছেন, মানুষকে কোরআনের পথে আহবান করেছেন সেই তিনিই নাকি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করেছেন !!
ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের মামলায় গ্রেফতারের পরপরই কথিত যুদ্ধাপরাধসহ আওয়ামী সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য আমার আব্বার বিরুদ্ধে -
•• রমনা থানায় গাড়ি ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো ও পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার কথিত অভিযোগে (!) ২টি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় আবার জিজ্ঞাসাবাদের নামে আব্বাকে ডিবি অফিসে ৩ দিন রিমান্ডেও নিয়েছিল।
•• রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে (!) উত্তরা মডেল থানায় ১টি মামলা দায়ের করে। এই মামলাতেও জিজ্ঞাসাবাদের নামে আব্বাকে রমনা থানায় ৩ দিন রিমান্ডে নিয়েছিল।
•• পল্টন মডেল থানায় গাড়ি ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের কাজে বাঁধা ও রাষ্ট্রপতির (তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান) গাড়ি বহরে হামলার হাস্যকর অভিযোগে (!) ৩টি মামলা দায়ের করে। হাস্যকর এইসব মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমার আব্বাকে ডিবি অফিসে প্রতিটি মামলায় ৩ দিন করে মোট ৯ দিন রিমান্ডে নিয়েছিল।
•• শেরেবাংলা নগর থানায় যাকাতের ৫ লক্ষ টাকা আত্নসাতের অভিযোগে (!) ১টি মামলা
•• কদমতলী থানায় পেট্রোল বোমা ও ককটেল বানানোর হাস্যকর অভিযোগে (!) ১টি মামলা দায়ের করে। এবং এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে আব্বাকে রমনা থানায় ৩ দিন রিমান্ডে নিয়েছিল।
•• রাজশাহীর মতিহার থানায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দলে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যার কথিত অভিযোগে (!) ১টি হত্যা মামলা
•• জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ২ লক্ষ টাকার আয়কর ফাঁকির হাস্যকর অভিযোগে (!) ১টি মামলা এবং
•• পিরোজপুরে অর্থের প্রলোভন ও ভীতিপ্রদর্শন করে ২টি কল্পিত যুদ্ধাপরাধের মামলা
•• পিরোজপুরের নাজিরপুরে আওয়ামীলীগের অফিসে রক্ষিত প্রধানমন্ত্রী ও তার পিতার ছবি ভাংচুরের (!!) অভিযোগসহ মোট ১৩টি মামলা দায়ের করে আওয়ামী সরকার।
এইসব কল্পিত অভিযোগ আর মিথ্যা মামলায় আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাকে টানা ৪১ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। এছাড়া সরকারের সেফ হোমেও তাকে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। এভাবে টানা রিমান্ডে নিয়ে আমার আব্বার উপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। আল্লামা সাঈদীর মতো একজন কোরআনের দা'ঈ ও সিনিয়র রাজনীতিবিদকে এতোদিন রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল এক ঘটনা।
এখন থেকে ১০ বছর আগে গ্রেফতার হওয়ার সময় আমার আব্বার বয়স ছিল ৭১। এই ৭১ বছরের মধ্যে আমার আব্বার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন থানায় কোন মামলা তো বহুদূরের কথা সামান্য একটি জিডিও তার বিরুদ্ধে কোন বিষয়েই ছিলনা।
কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয়, জন্মের পর থেকে নিয়ে জীবনের ৭১টি বছরের মধ্যে যার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধেই একটি মামলাও ছিলোনা, সেই তারই বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই আবিস্কার করলো হাজারো অভিযোগ আর দায়ের করলো এক এক করে মোট ১৩টি মামলা !!
আওয়ামী সরকারের রোষানলে কারান্তরীণ অবস্থায়ই আমার আব্বা হারিয়েছেন তার মমতাময়ী প্রিয় মা গুলনাহার ইউসুফ সাঈদী, ছোট ভাই হুমায়ুন কবির সাঈদী এবং কলিজার টুকরা বড় সন্তান রাফীক বিন সাঈদীকে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একই মাঠে সন্তান হয়ে মায়ের এবং পিতা হয়ে পুত্রের নামাজের জানাজা পড়ানোর মতো দুঃসহ যন্ত্রনা সইতে হয়েছে আমার আব্বাকে। শুধু তাই নয়, মা কিংবা সন্তানের লাশের পাশে এমনকি স্বজনদের সাথেও ব্যাথা ভোলার জন্য সামান্য কিছু সময়ও তাকে কাটাতে দেয়া হয়নি। জানাজা শেষেই মাঠ থেকে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কারাগারে। আর ছোট ভাই হুমায়ুন কবির সাঈদীর নামাজে জানাজায় তো অংশগ্রহণই করতে দেয়নি আওয়ামী সরকার!!
আমি প্রায়ই একাকী বসে ভাবি ..
আহ্! কী অব্যক্ত বেদনাময় সময়-ই না কাটিয়েছেন আমার আব্বা তখন !!
আহ্! কী অব্যক্ত বেদনাময় সময়-ই না কাটিয়েছেন আমার আব্বা তখন !!
আমার প্রানপ্রিয় আব্বার বয়স এখন ৮১ চলছে। নানারকম শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে কারাগারে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি। চিকিৎসার অভাবে হাঁটু ও কোমড়ের ব্যথার তীব্রতা প্রতিদিন বাড়ছেই। ৩৯ বছরের ডায়াবেটিক আর হার্টের সমস্যা তো তার নিত্যদিনের সঙ্গী। শারিরীক অসুস্থতার কারনে আব্বা কারো সহযোগিতা ছাড়া একাকী হাটাচলা করতে পারেন না। দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে পারেন না। এমনকি শোয়া অবস্থা থেকে বিছানা থেকে উঠতে গেলেও কারো না কারো সহযোগিতা নিয়ে উঠতে হয়।
এমন একটি অবস্থায় আব্বার শারিরীক অবস্থা নিয়ে আমরা সবসময়ই দুঃশ্চিন্তায় থাকি। এর মধ্যে এখন আবার নতুন করে যোগ হয়েছে করোনা নিয়ে উদ্বেগ। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষ অসুস্থতা, বয়স ও মানবিক বিবেচনায় সরকারের নিকট আল্লামা সাঈদীর মুক্তি দাবি করে যাচ্ছে কিন্তু 'মানবতার ঠিকাদার' এই সরকার কোটি মানুষের এই মানবিক দাবিটি পূরণে আন্তরিক তো নয়ই, উল্টো গত আড়াই মাস ধরে আব্বার সাথে আমাদের সাক্ষাত বন্ধ করে রেখেছে।
আব্বাকে কারাগারে রেখে এটি আমাদের ২১তম ঈদ। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা কারাগারে থাকা অবস্থাতেই আমরা হারালাম কলিজার টুকরা বড় ভাইকে, হারালাম ছোট চাচাকে, তেমনি হারিয়েছি প্রিয় দাদীকেও।
আমাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ বলতে এখন আর কিছুই নেই। আমাদের ঈদ আজ কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি।আমাদের ঈদ আনন্দ এখন আমরা খুঁজে বেড়াই অতীত স্মৃতির মাঝে। চারপাশের মানুষের ঈদের আনন্দ দেখে আজকাল মাঝে মধ্যে বড় ঈর্ষা হয় আমার। আহারে! এই ঈদ আনন্দ এক সময় আমাদেরো তো ছিল ! সরকার আমাদের এই আনন্দটুকুনও কেড়ে নিয়েছে।
Masood Sayedee - মাসুদ সাঈদী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন