জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনা অনুযায়ী, মৌলিক অধিকার হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার, যা জাতি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। বাংলাদেশ সংবিধানের, ৩৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, ৩৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমাবেশের স্বাধীনতা, ৩৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনের স্বাধীনতা ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, এই সব অধিকারের সবগুলিই বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বর্নিত হয়েছে। উপরোক্ত অধিকারগুলির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের কোন নাগরিকই পরিপূর্ণভাবে উপরোক্ত অধিকারগুলি ভোগ করতে পারছেনা। অথচ রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব নাগরিকের এই অধিকারগগুলি পরিপূর্নভাবে বাস্তবায়ন করা।
ইসলামী ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিভাগ মনে করে, সংবিধান স্বীকৃত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চত করা না গেলে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পারলে এবং মানুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পেলে শুধু কাগজে কলমে গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করলেই সেটিকে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলা যায়না। রাষ্ট্র পরিচালনার সকলক্ষেত্রে জনগণ নিজেদেরকে নাগরিক ভাবতে ও অংশগ্রহন করতে না পারলে সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র গড়ে উঠবেনা। এজন্য সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে আইন কাঠামো প্রনয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কোনদিনই মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, প্রশাসনের হেফাজতে নির্যাতন, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে হামলা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে, দিন দিন ধর্ষণ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে সমগ্র দেশের নারী সমাজের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিভাগ কর্তৃক দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে ১৭৯ জন লোক হত্যার স্বীকার হয়েছে। এ মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬ জন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ১১ টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১৫ জন নিহত হয়। উল্লেখ্য, গত ১৫ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়ন জামায়াত নেতা মো. ওসমান গণি (৩০) পুলিশের ‘গুলিতে’ নিহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবী নিহত ওসমান গণির বিরুদ্ধে চারটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।
ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলকে কেন্দ্র করে শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতার ১০ টি ঘটনায় আহত হয়েছে ৬০ জন ছাত্র। উল্লেখ্য, ১৭ই ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়েছেন।
এ মাসে ৬৪ টি সহিংস হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪২ জন, আহত হয়েছে ৫৯ জন এবং গুলিবিদ্ধ ৮ জন। এছাড়াও গণপিটুনির ৭ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৪ জন। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ ২২ জন পুরুষের, ১৪ জন মহিলার এবং ১১জনের অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে।
এ মাসে ২৪ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪ জন, আহত হয়েছে ১১৭ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ২ জন। এছাড়া পৌরসভা নির্বাচন’২০১৫ উপলক্ষে সহিংসতার ৭৫ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ জন, আহত হয়েছে ৩৮১ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৩১ জন। যার অধিকাংশ ঘটনায় সরকার দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। উল্লেখ্য, ৩০ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্বাচনি সহিংসতায় নুরুল আমিন নামক একজন নিহত হয়।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ৬ টি হামলা হয়েছে, এ ঘটনায় আহত হয়েছে ১৫ জন। উল্লেখ্য, ১০ই ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে দিনাজপুরে কাহারোলে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে কীর্তন ও ধর্মসভা চলার সময় দুবৃত্তরা হামলা চালায় এসময় দুই জন গুলিবিদ্ধ হন।
নারী নির্যাতনের অংশ হিসেবে যৌতুক জন্য নির্যাতনে নিহত হয়েছে ৯ জন নারী এবং শারিবীক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭ জন নারী, পারিবারিক কলহে নিহত হয়েছে ১৬ জন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬ জন নারী, এসিড নিক্ষেপের ১ টি ঘটনায় আহত হয়েছে ১জন, আত্মহত্যার স্বীকার হয়েছে ১৭ জন, ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে ৩৫ জন নারী, ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ৫ জন। উল্লেখ্য, ৮ই ডিসেম্বর নোয়াখালী সদর উপজেলার শল্লা গ্রামে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন চালিয়ে মিনা আক্তার (২২) নামে এক গৃহবধূকে হত্যা হত্যা করে সদর উপজেলার শল্লা গ্রামের জয়নাল আবেদিনের ছেলে দেলোয়ার হোসেনে। নিহত মিনা আক্তার সুবর্ণচর উপজেলার পশ্চিম চর জুবলী গ্রামের আবদুল হকের মেয়ে।
এমাসে আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক গুম হয়ে ২ জন শিবির নেতা। এছাড়া অপহরন হয়েছে ২১ জন, এর মধ্যে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৩ জনের এবং জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৯ জনকে । উল্লেখ্য, গত ৮ই ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গাবতলী থেকে ২ ছাত্রকে র্যাব পরিচয়ে অন্যায়ভাবে আটকের পর অস্বীকার করে। আটককৃতরা হলো জয়পুরহাট আইন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবুজর গিফারী ও জয়পুরহাট সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের ৪থ বর্ষের ছাত্র ওমর ফারুক।পরবর্তীতে ১৮ই ডিসেম্বর র্যাবের হাতে আটকের পর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছাত্রশিবিরের জেলা সভাপতি আবু যর গিফরী ও সেক্রেটারি ওমর আলী ও এক জামায়াত কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ‘বিএসএফ’ কর্তৃক ৯ টি হামলার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতন ও গুলি করে ৪ জন বাংলাদেশী হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে ১ জন বাংলাদেশীকে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ৮ জন বাংলাদেশী। উল্লেখ্য, ২৬ই সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১নং নিজপাট ইউনিয়নের বাইরাখেল হর্নি ময়না বস্তি গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে মো. জমির উদ্দিন (২২) নিহত হয়েছে।
বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানী ও নির্যাতনের অংশ হিসেবে ৭৯ টি ঘটনায় বিরোধী দলের ৮৯১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সন্ত্রাসী ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের ৭ টি হামলায় নিহত হয়েছে ১ জন সাংবাদিক, আহত হয়েছে ৫ জন সাংবাদিক এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ২জন সাংবাদিক। উল্লেখ্য, ১৯শে ডিসেম্বর নাটোরের লালপুর উপজেলার আব্দুলপুরে ট্রেনের তেল চুরির প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের তালাশ টিমের সাংবাদিক সবুজ মাহমুদ, ভিডিও গ্রাফার রাকিবুল ইসলাম ও ক্যামেরাপারসন তাইবুর হাসানকে মারধর করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় অপরাধীরা।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে জনগনের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। তাই ইসলামী ছাত্রাশিবিরের কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিভাগের পক্ষ থেকে দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন