প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’-এর সংস্কৃতির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে, “আমরা জনগণ” সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় সংসদ সংবিধানের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না এবং কোনো আইন সংবিধানসম্মত কি না, তা বিচার করার অধিকার সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকেই দিয়েছে।’ ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় ঘোষণা করেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতি এসব কথা লিখেছেন। গতকাল এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়েছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।’
আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করার পরও আলাদা করে নিজেরা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তবে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে তার বাইরে আর কিছু লেখেননি।
তিনি লিখেছেন, ‘আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগর–পরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাঁকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি টড স্বীকৃতি পেয়েছেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন জেনারেলও রয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশে একটি রোগ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেই রোগের নাম “অদূরদর্শী রাজনৈতিকীকরণ”। এটা একটা ভাইরাস এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংস্কৃতিকে তা এমন বিস্তৃতভাবে সংক্রমিত করেছে যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে বা কল্পনা করতেও পারছেন না যে ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।’
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তাঁরা তাঁদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও “মেকি গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তাঁরা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন। আমাদের অবশ্যই এই নোংরা “আমাদের লোক” মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী “আমি একাই সব” দৃষ্টিভঙ্গি। দলীয় আনুগত্য বা অর্থবিত্ত নয়, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শুধু মেধার বিবেচনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি এক-এগারো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দুই বছরের জরুরি অবস্থার নামে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আর সেটা ঘটেছিল সেই সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দূরদর্শিতার অভাব এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে তাদের অনীহার কারণে।’ ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আপিল বিভাগ মত দিয়েছিলেন যে দুটি সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে শর্ত হলো, বিলুপ্ত হওয়া ৫৮(ক) অনুচ্ছেদের ৩ ও ৪ দফা অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা যাবে না। এই আদালত উল্লিখিত নির্দেশনা এ কথা মনে রেখে দিয়েছিলেন যে প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রক্রিয়ায় তাহলে রাজনৈতিকীকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।’
নির্বাচন যাতে সর্বদাই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আরও বেশি ক্ষমতা এবং তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘এই আদালত লক্ষ করেছেন যে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল যারাই নির্বাচনে হেরে যায়, তারা নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এং বিরোধী দল সংসদে সহযোগিতা করে না। শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচনে একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। এই আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সব ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের শূন্য পদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভবে পূরণ হবে। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলোর কেউ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলও সংসদে কিংবা কোনো ফোরামে এই প্রশ্ন তোলেনি এবং তার ফল দাঁড়িয়েছে, নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেনি।’
রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সে কারণে আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা অর্পণ করতে পারছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে, তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের দিয়ে সংসদ গঠিত হতে পারে না, বরং তা সংসদের নিজের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে ব্যাহত করতে পারে।’
রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংসদ যদি যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জন না করে, তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হবে একটি আত্মঘাতী উদ্যোগ। সংসদের কাছে বিচার বিভাগের জবাবদিহি করা উচিত নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক হওয়া। যেসব দেশে বিচারপতিদের সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশের গণতন্ত্র আমাদের তুলনায় বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও সেখানে ওই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগ সম্ভব হয়নি।’
রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক, পিএসসির সদস্যসহ সব সাংবিধানিক পদধারীকে অপসারণ–সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবনের জন্য এখন সংসদের আর কোনো পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে না। অষ্টম সংশোধনীর বৈধতার মামলার রায়ের আলোকে এটি আপনাআপনি কার্যকর হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট একই সঙ্গে বিচারকদের অসদাচরণের কোনো প্রাথমিক অভিযোগ এলে তা প্রথমে প্রধান বিচারপতি এবং তাঁর পরের দুই জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে তদন্ত করে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সম্মতি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান করে নতুন আচরণবিধি করেছেন।’
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ইতিপূর্বে আপিল বিভাগ স্থায়ীভাবে মার্জনা করেনি, এ যুক্তি সঠিক নয়।’ তিনি আরও বলেন, এটিই একমাত্র সামরিক আইন দ্বারা তৈরি বিধান নয়, যা এই আদালত অনুমোদন করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, পঞ্চম সংশোধনীতে আনা জাতীয়তার পরিচয় বাংলাদেশি করা, সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ যুক্ত করার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৮৮ সালের রাবার স্ট্যাম্প সংসদে আনা, ২(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল না। ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রত্যক্ষ সংঘাত রয়েছে, তারপরও তাকে সংবিধানে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে ধর্মীয় একটি অভিমন্ত্রে ধর্মীয় ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার সরাসরি বিরুদ্ধে। ১৯৭৯ সালে একটি সামরিক সরকার সংবিধানে এটি প্রতিস্থাপন করলেও পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদ তাকে বৈধতা দিয়েছে। সে কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়েছে। আর এভাবে ’৭২-এ সংবিধানে বর্ণিত স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং মূল সংবিধানের চেতনা সমাহিত করা হয়েছে। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন, সামরিক আইনের কণামাত্রও সংবিধানে থাকতে পারবে না।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, যার সুরক্ষায় শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। তাই অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেগপূর্ণ যুক্তি গ্রহণ করতে আমরা অক্ষম। এটাও স্বীকৃত যে উভয় পক্ষ স্বীকার করেছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মৌলিক কাঠামো, আর মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না। আর এই আদালত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে সুরক্ষা দিয়েছেন।’
প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের রায় প্রদানের পরে সুপ্রিম কোর্ট লক্ষ করেছেন যে সংসদ সদস্যরা রায়ের সমালোচনা করে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। রায় এবং বিচারকদের শুদ্ধতা নিয়ে অসংসদীয় ভাষায় প্রশ্ন তুলেছেন। এটা প্রমাণ করে যে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব।’
রায়ে বলা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিকালে যুক্তি দিয়েছেন যে যদি কতিপয় বিচারক হতে আগ্রহী ব্যক্তি নিজেদের ‘খুব উঁচু, খুব বড়’ এবং ‘জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ বলে গণ্য করেন, তাঁদের বিচার বিভাগে স্বাগত জানাই না। তাঁরা এমনকি চলে যেতে পারেন। আজমালুল হোসেনও তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। এম আমীর-উল ইসলাম ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টনের বরাতে বলেছেন, সকল ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই প্রশ্ন জাগে, ক্ষমতার অনুশীলন কার নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত? ইংল্যান্ডের বিচারপতি লর্ড ড্যানিং বলেছেন, ‘কাউকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে। আর আসুন বিচারকদেরই বিশ্বাস করি।’ এরপর প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘বিচারকদের প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল অত্যন্ত নির্দয় মন্তব্য করেছেন। তিনি এবং সরকার যদি বিচারকদের ওপর ভরসা না রাখতে পারেন, তাহলে আমি বলব, তিনি ভ্রান্ত এবং তাঁর উচিত হবে তাঁর মক্কেলকে (সরকার) এই পরামর্শ দেওয়া যে এটাই যদি সরকারের ধারণা হয় যে বিচারকেরা স্বাধীন এবং পক্ষপাতহীন নন, তাহলে দেশে আস্থার আর কোনো জায়গাই থাকবে না।’ তিনি লিখেছেন, আজমালুল হোসেনও উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্পর্কে নির্দয় এবং অবমাননকার মন্তব্য করেছেন।
৭০ অনুচ্ছেদ
৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি মনে করেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাঁদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে। তাই সংসদের কোনো ইস্যুতেই তাঁরা দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। সংবিধানের ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো আইন না করা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে একটি বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। আর ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগের প্রভাব পড়বে।’ তিনি লিখেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, ৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য হলো সরকারের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা।’
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই দেখা হয়, তাহলে তাঁদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়। তাই এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যের চেতনা হলো সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা তাঁদের মনোনীত করা দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবেন। আসলে তাঁরা তাঁদের দলের উচ্চপর্যায়ের হাতে জিম্মি। তাই ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন, তার মধ্যে আমরা কোনো বৈকল্য দেখি না। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে বিচারকেরা দলের হাইকমান্ডের অনুকম্পানির্ভর হয়ে পড়বেন।’
হাইকোর্টকে ভর্ৎসনা
প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের একটি অংশ তুলে ধরেন, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা এটা দেখাচ্ছে যে সংসদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে। তাঁরা দেওয়ানি মামলাসমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সাংসদেরা বিচারকদের কার্যত বসে (কর্তৃত্ব অর্থে) পরিণত হয়েছেন, যা উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে হুমকি সৃষ্টি করেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী সংসদের ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। মাহবুবে আলম এবং মুরাদ রেজা (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) এই তথ্যের বিষয়ে আপত্তি করেননি। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, আইন প্রণয়নসংক্রান্ত সংসদীয় বিতর্কে তাঁরা কম আগ্রহী। এর পরিণাম হলো আজকের দিনে সংসদে পাস করা বেশির ভাগ আইন ‘ত্রুটিযুক্ত’। অসম্পূর্ণ এবং ‘নিচু মানের’ আইন প্রণয়নে তাঁদের দায়িত্ব উত্তমরূপে পালনের চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে তাঁরা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের বিচার করা আইনপ্রণেতাদের কাজ নয়।’
প্রধান বিচারপতি এরপর মন্তব্য করেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণরূপে অবাঞ্ছিত এবং আমরা কোনোভাবেই এ দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করি না। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা বিচারকদের এ রকম অবমাননাকর মন্তব্য করা উচিত নয়। আদালত এবং সংসদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি থাকা দরকার। একইভাবে সংসদেরও উচিত নয় সুপ্রিম কোর্টের কোনো পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য বা কটাক্ষ করা।’
প্রথম আলোর সৌজন্যে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন