কয়েক দিন আগে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি গোল টেবিল বৈঠকে ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) প্রধান আসম আব্দুর রব এমন একটি মন্তব্য করেন যেটি সর্বশ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি প্রশ্ন করেন, সরকার কি বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন? উল্লেখ করা যেতে পারে যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর সরকার পক্ষ শুধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করছেন না, তারা বিচার বিভাগকে আক্রমণও করছেন। দলীয় সংসদ সদস্য এবং নেতা ও কর্মীদের প্রতি প্রধান মন্ত্রী এই মর্মে আহ্বান জানান যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে সারা দেশে জনমত গড়ে তুলতে হবে। এরপর অনেক মন্ত্রী একের পর এক ধারাবাহিকভাবে শুধুমাত্র ষোড়শ সংশোধনী নয়, প্রধান বিচারপতি বাবু এসকে সিনহার বিরুদ্ধেও তীব্র বিষোদগার শুরু করেছেন। জনমত গঠনের জন্য প্রধান মন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন সে ব্যাপারে আসম রব প্রশ্ন করেন, কার বিরুদ্ধে জনমত? বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনমত? তার অর্থ হলো জনগণ কি বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে? এই পটভূমিতেই তিনি প্রশ্ন করেছেন, সরকার কি তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চান?
শুধুমাত্র আসম রব নন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও অনুরূপ প্রশ্ন করেছেন। মির্জা ফখরুল জানতে চেয়েছেন, কার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের আহ্বান? জনাব মান্না বলেছেন, বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যেভাবে বিষোদগার করা হচ্ছে সেটা যদি চলতে থাকে তাহলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের এসব উদ্বেগ প্রকাশ করার পরেও গত বৃহস্পতিবার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম একটি ডেঞ্জারাস কথা বলেছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে একটি চরমপত্র দিয়েছেন। বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে এক মাসের সময় দেয়া হলো। এর মধ্যে তিনি যদি তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করেন তাহলে এক মাস পর তার অপসারণের দাবিতে সারা দেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রধান বিচারপতি বেশি দিন এই মসনদে থাকতে পারবেন না।’ প্রধান মন্ত্রীর বেয়াই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেছেন, 'সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটাক্ষ করার ‘ধৃষ্টতা’ দেখিয়েছেন।’ এ রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কথাবার্তার অবতারণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এমনকি রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। আমরা প্রধান বিচারপতিকে ধিক্কার জানাই।’ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এ রায় আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত।’
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন,‘আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা সেটি অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিশিয়ারি কত দূর যায়।’ তিনি বলেন, ‘জুডিসিয়াল কন্ডিশন আনটলারেবল। সংসদের উপর তারা পোদ্দারি করবে। এদেরকে আমরা চাকরি দেই।’ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যারা বর্তমানে বিচারকের আসনে বসেছেন, তারা ইম-ম্যাচিউরড।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আদালতের হাত এত বড় লম্বা হয়নি যে সংসদ ছুঁতে পারে।’ ‘সংসদ নিয়ে ধৃষ্টতা দেখানোর অধিকার কারও নেই।’ গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যা বলছেন, তা ঠিক নয়। বাংলার মানুষ জানে, আপনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের যেসব বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলো সেগুলো সব সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা হানি করেছে। এ গুলো সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননার শামিল। আজ যদি এই ধরনের বক্তব্য বিরোধী দলের তরফ থেকে আসতো তাহলে এতদিনে বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা রুজু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত।
॥দুই॥
এভাবে যখন দেশের উচ্চতম আদালতের প্রতি অবজ্ঞা এবং অসম্মান প্রদর্শনের লহর বইছে তখন আদালতের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থাৎ সভা করে দাবি উঠেছে আওয়ামী লীগেরই একটি অংগ সংগঠন থেকে। ঐ সভায় দাবি উত্থাপন করেছেন ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এবং মরহুম শেখ ফজলুল হক মণির পুত্র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। ওই রায়ের প্রতিবাদে আগামী ১৩, ১৬ ও ১৭ অগাস্ট দুপুরে সারা দেশের আইনজীবী সমিতিতে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের কথা জানানো হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সংগঠনের সদস্য সচিব শেখ ফজলে নূর তাপস। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সারা দেশের আইনজীবীদের সংক্ষুব্ধ করেছে। রায়ে যে সমস্ত ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলো স্বতপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহার করতে আদালতের প্রতি দাবিও জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
॥তিন॥
একটি কথা বলা দরকার যে, মূল রায়ের সাথে পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশ। আজ যদি সরকারদলীয় মন্ত্রী এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের চাপে আপিল বিভাগ এসব পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় তাহলে আগামী কাল একই ধরনের নতুন দাবি আসতে বাধ্য। তখন দাবি করা হবে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলায় বিচারপতি খায়রুল হক যে সব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ পঞ্চম সংশোধনীর মূল বিষয় ছিল সিনেমা হলের মালিকানা ফেরৎ দেওয়া। মালিক তার সিনেমা হল ফেরৎ পাননি। কিন্তু খায়রুল হক সাহ্বে সিনেমা হলের ঘাড়ে চড়ে মোশতাক, সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছেন। সেই কাজটি করতে গিয়ে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২২২ বছরের ইতিহাস টেনেছেন। সিনেমা হলের মালিকানার সাথে ২২২ বছরের ইতিহাসের সম্পর্ক কি? মোশতাক, সায়েম ও জিয়া সরকারের সাথেই বা সিনেমা হলের মালিকানার সম্পর্ক কি?
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আওয়ামী লীগ যে সব কথা বলছে সেসব কথার সূত্র ধরেই বলতে হয় যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল নিয়ে খায়রুল হক যে ৩৯৩ পৃষ্ঠা সম্বলিত ২২২ বছরের ইতিহাস টেনেছেন সেটি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক, অপ্রাসঙ্গিক এবং মোটেই বিচার্য্য বিষয় ছিল না। তাই খায়রুল হককেও পঞ্চম সংশোধনীর পর্যবেক্ষণ এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় অর্থাৎ কেয়ার টেকার সরকার বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে।
মূল বিচার্য্যরে বাইরে যদি অন্য কোনো বিষয় অপ্রাসঙ্গিক হয় তাহলে সপ্তম সংশোধনী বাতিল করতে গিয়ে বিচারপতি সামছুদ্দিন মানিক এবং অপর একজন বিচারপতি যে সব মন্তব্য করেছেন সেগুলোও সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। তিনি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং ১৯৪৬ সালের দিল্লী কনভেনশনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি বলেছেন যে, পূর্ব বাংলার মানুষ নাকি পাকিস্তান চায়নি। তিনি ভুলে গেছেন যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মানুষই পাকিস্তান দাবিতে মুসলিম লীগকে বাংলায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়েছিল। সেই অমোঘ সত্যকে বিকৃত করে যে মনগড়া ইতিহাস সামছুদ্দিন মানিক বানিয়েছেন সেটিও প্রত্যাহার করতে হবে।
॥চার॥
সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে এই ধরনের হুমকি ধামকির মধ্যে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। জনাব খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর একটি চাকরি নিয়েছেন। সেটি হলো আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ। এই পদটি প্রধান বিচারপতির পদের চেয়ে অনেক ছোট। সংবিধানের ভাষায় এটি একটি অফিস অব প্রফিট বা লাভজনক পদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত যত প্রধান বিচারপতি এসেছেন তাদের কেউই অবসর গ্রহণ করার পর সরকারী, আধা-সরকারী বা অন্য কোনো লাভজনক পদে চাকরি নেননি।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের যত প্রধান বিচারপতি অবসর নিয়েছেন তাদের কেউই অবসর গ্রহণ করার পর তাদের উত্তরসূরিদের অর্থাৎ অন্য প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেনে নি। এই ৪৬ বছর বয়সে এমন ঘটনা ঘটেনি। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন জাস্টিস খায়রুল হক। তিনি শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়েরই সমালোচনা করেননি, তিনি সমস্ত বিচারপতির সমালোচনা করেছেন। কারণ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি ছিল সর্বসম্মত। তাই খায়রুল হকের বিষোদগার চিফ জাস্টিসসহ সাতজন বিচারপতির বিরুদ্ধেই তীব্র বিষোদগারের শামিল।
কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারের একটি চাকরি করে বা লাভজনক একটি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে খায়রুল হক প্রেস কনফারেন্স করতে পারেন কিনা? আরও প্রশ্ন আছে। একজন চাকরিজীবী প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চকে অপমান করতে পারেন কিনা? খায়রুল হক সাহ্বে ভুলে যাচ্ছেন যে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল অর্থাৎ যে কেয়ার টেকার সরকার বাতিল করার রায় দিয়েছেন সেটি তিনি করতে পেরেছেন তার কাস্টিং ভোটে। কেয়ার টেকার বাতিলের পক্ষে ছিলেন তিনজন বিচারপতি। এরা হলেন বিচারপতি মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি এসকে সিনহা এবং বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন। আবার কেয়ার টেকার বাতিলের বিপক্ষেও ছিলেন তিনজন বিচারপতি। এরা হলেন , বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং বিচারপতি ঈমান আলী। এমন পরিস্থিতিতে খায়রুল হক প্রথম তিনজনের সাথে মিলে গেলে তারা সামান্য মেজরিটি (স্লেন্ডার মেজরিটি) হন। অথচ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যে রায় হয়েছে সেটি সাতজন বিচারপতির ফুল বেঞ্চ সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন। কিসের সাথে কিসের তুলনা করছেন খায়রুল হক?
খায়রুল হক সাহ্বে কি আরো ভুলে গেছেন যে তিনি কেয়ার টেকারের সংক্ষিপ্ত রায়ে দশম ও একাদশ সংসদের দুইটি নির্বাচন কেয়ার টেকারের অধীনে হতে পারে বলে রায় দিয়েছিলেন। ১৬ মাস পর তিনি ৩৪২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় দাখিল করেন। এই রায়ে তিনি ঐ দুইটি সংসদ নির্বাচন কেয়ার টেকাররের অধীনে হতে পারে বলে সংক্ষিপ্ত রায়ে যা বলেছিলেন সেটি গায়েব করে দেন। বিচারপতি হিসাবে যিনি এমন অসৎ মানসিকতার অধিকারী তিনি যে এখন সরকারের দালালি করার জন্য নির্লজ্জ ভাবে চাকরি বিধি ভঙ্গ করে মাঠে নেমে পড়বেন তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। খায়রুল হকের মুখোশ খুলে পড়েছে। তিনি স্বরূপে উন্মোচিত হয়েছেন।
asifarsalan15@gmail.comদৈনিক সংগ্রাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন