২০০০ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ‘নাফযুদ্ধ’ হয়েছিল। এতে বাংলাদেশের কোনো জোয়ান মারা না গেলেও মিয়ানমারের ছয়শো সেন্য নিহত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পরাজয় মেনে নিয়ে মিয়ানমার সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল।
তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের বর্ণনায় মিয়ানমারকে যুদ্ধে হারানোর ইতিহাস তুলে ধরা হলোঃ
"আমি সবে বিডিআর মহাপরিচালক হয়েছি। দেখলাম মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী (বর্তমানে বর্ডার পুলিশ) আমাদেরকে মানে বিডিআর সদর দপ্তরে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে সতর্ক করে। মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর লেখা চিঠির ভাষা হুবহু নয়, তবে কিছুটা এইরূপ বা এর চেয়ে জঘন্য: “From NASAKA HQ to BDR HQ Bangladesh. We are warning you to behave otherwise we will teach you lessons you will never forget.”
সাধারণত যখন কোন চিঠি লেখা হয়, তখন প্রথা অনুযায়ী চিঠির শুরুতে অভিবাদন/নিবেদন এবং শেষ সাবমিশন থাকে। যেমন সালাম দিয়ে বা সমপর্যায়ের শব্দ দিয়ে চিঠি আরম্ভ করে চিঠির শেষে যেমন লিখতে হয় আপনার একান্ত বিশ্বস্ত বা সমপর্যায়ের শব্দ। আমাদেরকে লেখা নাসাকার চিঠিতে তার কোন বালাই নেই। ভাষা এবং শব্দচয়ন অতীব নিম্নমানের এবং অসম্মানজনক।
এই রকম কয়েকটা চিঠি আসার পর আমি পরিচালক অপারেশন বিডিআর কর্নেল রফিককে আমার অফিসে ডেকে মিয়ানমারের নাসাকা সদরে একটি জবাবী চিঠি উত্তর হিসাবে পাঠাতে নির্দেশ দিলাম এবং জবাবী চিঠির ভাষা কী হবে তা যখন তাকে বললাম, তখন কর্নেল রফিক আমাকে অনুরোধ করতে লাগলেন, “স্যার, এমন কড়া ভাষায় নাসাকা সদরে চিঠি পাঠানো ঠিক হবে না। ওরা স্যার ইংরেজি ভাল জানে না বলে কী লিখতে কী লিখে তারা নিজেরাই হয়তো জানে না।”
আমি বললাম, “রফিক, দেখ। আমরা যেমন ব্রিটিশ রুলে ছিলাম, তেমনি বার্মাও ব্রিটিশ রুলে ছিল। আমরা যদি ইংরেজি জানতে, বুঝতে এবং ভাল লিখতে পারি, তাহলে মিয়ানমারের নাসাকাও ভাল ইংরেজি লিখতে পারবে সন্দেহ নাই।”
তারপরেও যখন দেখলাম কর্নেল রফিক সম্মত হচ্ছেন না, তখন আমি তাকে চলে যেতে বললাম এবং আরো বললাম, “আমি নিজে ডিকটেশন দিয়ে একটা চিঠি টাইপ করে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি নাসাকা সদরে পাঠানোর জন্য।”
আমি চিঠিটার শুরুতে সেলুটেশন ও শেষে সাবমিশন ঠিক রেখে যা লিখেছিলাম তার ভাষা মোটামুটি এইরূপ: “Excellency, the letters we receive intermittently from your HQs are worst in choice of words and construction of sentences. Often you use filthy and uncivilized words which are never written to any Forces HQs like BDR. Henceforth any such of your letters will be viewed seriously by us and you will be liable to face grime consequences. Be gentle and civilized, else we will teach you lessons how to be civilized and behave properly.”
যাইহোক, এই ধরনের একটা চিঠি সময় মতো নাসাকা সদরে পাঠানো হল। আশ্চর্য হলেও সত্য, এই চিঠির পরে নাসাকা সদর থেকে যত চিঠি আমি মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় বিডিআর সদরে এসেছিল, সব ছিল সুন্দর এবং মার্জিত ভাষায় লেখা। এরপরে মিয়ানমারের সাথে আমাদের নাফযুদ্ধ হল।
নাফ হচ্ছে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বিভক্তিকারী নদী। প্রকৃতপক্ষে এটি ১২ টি শাখায় বিভক্ত। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান এবং বার্মা সরকার এই মর্মে চুক্তি সাক্ষর করে যে, তারা কেউই নদীর কিংবা এর শাখাগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহে হস্তক্ষেপ করবে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে নদীর গভীরতায় তারতম্য তৈরী হলে সেই অনুপাতে দু দেশের সীমান্তও পরিবর্তিত হবে।
তো যখন আমি বিডিআর এর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেলাম তখন আমাকে জানানো হল যে, বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের ২৮০০ একর জায়গা মিয়ায়ানমার কর্তৃক নদীতে অবৈধভাবে দখল হয়েছে। কারণ, তারা ১৯৬৬ সালে সাক্ষরিত চুক্তির অবৈধ অপব্যবহারের উদ্দেশ্যে নাফ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে বাঁধ নির্মাণ করেছে।
হঠাৎই তারা নাফ নদীর সর্বশেষ শাখাটিতেও বাঁধ নির্মাণ আরম্ভ করল এবং যদি তারা একাজে সফল হত, তবে পুরো টেকনাফ অঞ্চলটিই বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যেত।
আমরা প্রতিবাদ জানালাম, কিন্তু মিয়ানমার এটিকে আমলে নিল না এবং তাদের কাজ অব্যাহত রাখল। তারা তাদের স্থাপনা (৯ বাঁধ) রক্ষার্থে বার্মিজ সেনা ও নৌবাহিনী হতে একজন একজন করে মোট দুজন মেজর জেনারেলের নেতৃত্বে দুই ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিডিআর এর প্রায় ২৫০০ সৈন্যকে প্রস্তুত করলাম সরাসরি আমার নেতৃত্বে। আমি প্রায় পঁচিশ লক্ষ পরিমাণ যুদ্ধ সামগ্রী (রাইফেল, গুলি, বোমা, গান পাউডার) কক্সবাজারে প্রেরণ করলাম যার অর্ধেক কক্সবাজারেই মজুদ রাখলাম এবং বাকি অর্ধেক টেকনাফে প্রেরণ করলাম।
২০০০ সালের পয়লা জানুয়ারি দুপুর ০২:৩০-এ আমি আমাদের সৈন্যদেরকে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার নির্দেশ দিলাম এবং তারাও (মিয়ানমার) পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করল। এই যুদ্ধ তিনদিনব্যাপী স্থায়ী ছিল, যাতে প্রায় ৬০০ বার্মিজ সেনা নিহত হয়।
৪ জানুয়ারী তারিখে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল থান সুই রাজধানী রেঙ্গুনে কূটনীতিকদের ডেকে বলেন যে তারা বাংলাদেশের সাথে আর যুদ্ধ চায় না। আক্রমণ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার একটি চিঠি পাঠায় যাতে লিখা ছিল, “আমরা চাই বাংলাদেশ ও আমরা কোনরূপ পূর্বশর্ত ছাড়া একসাথে আলোচনায় বসে বিবাদমান বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করি।”
অতঃপর মিয়ানমারের মংডুতে এ নিয়ে সচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরু হল, (রাজনৈতিক ব্যাপার) যাতে বাংলাদেশের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব জানিবুল হক। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলাকালীন মিয়ানমার পক্ষ এতটাই বিমর্ষ/উত্তেজিত ছিল যে তারা টাইপ রাইটার পর্যন্ত সরবরাহ করেনি এবং চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত হাতেই লিখতে হয়েছিল।
অবশেষে মায়ানমার নদী থেকে বাঁধ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। ফলশ্রুতিতে আমরা টেকনাফকে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলাম। তো এভাবেই বাংলাদেশের পক্ষ হতে কোন প্রাণহানি ছাড়াই আমরা মিয়ানমার বাহিনীকে পরাজিত করলাম। এটাই হচ্ছে নাফযুদ্ধের সত্যিকার কাহিনী।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন