বাংলাদেশ বার্তাঃ হিমালয়ান উপমহাদেশের এই ভূখন্ড এক সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে “দারুল ইসলাম” বা “মুসলিম রাষ্ট্র” হিসেবে পরিচিত ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিণতিতে আজ এই দেশ মুসলমানদের উপর জুলুম অত্যাচার আর চরম নিপীড়নের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এই অঞ্চলের মুসলিম মিল্লাতের শাশ্বত ঈমানী প্রাণ প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে রাসূল (সা:) এর কর্মসূচী অনুসরণ করেই শহীদ আব্দুল মালেকের পথ ধরে ত্যাগের প্রতিযোগিতাই বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
তাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনে জীবন মরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ মজলুম ভাইয়েরা।
বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে রয়েছে সুগভীর ষড়যন্ত্র। ক্ষমতাসীন সেক্যুলার গোষ্টি আওয়ামীলীগের হিংস্র বর্বরতায় আক্রান্ত হাজার হাজার দ্বীনের সৈনিক। প্রতিনিয়ত টার্গেট করে হত্যা, গুম, অপহরণ,পঙ্গুত্ববরণ,আর্থিকভাবে চরমক্ষতি, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় আঘাত করাই ক্ষমতাসীনদের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই ভাবে আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চরম নির্যাতন, নিপীড়নে অকালেই প্রিয় বাবা, ভাই,স্বামীকে হারিয়ে হাজারো স্বজনের করুন আর্তনাদের দরিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
একমাত্র প্রিয় অভিভাবক হারিয়ে অসংখ্যা শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে ভবিষ্যতের ভাল মানুষ হওয়ার স্বপ্ন পন্ড হয়ে গেছে। বাবার কোলে বসে ভাল মানুষ হওয়ার স্বপ্ন আর শুনতে পায় না।
প্রতিনিয়ত শুনতে পায় বাবা, ভাইয়ের নির্মম মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। হায়েনার ছোবলে বিষাক্ত ফণা আবার যে কখন কোন স্বজনের উপর পতিত হচ্ছে সেই উৎকন্ঠাতে আতংকিত মুহুর্ত কাটে সবসময়।
অসংখ্য হত্যাকান্ডের জনপদ সাতকানিয়া
বর্তমান ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠির নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহ উপত্যকা খ্যাত জনপদ দক্ষিণ চট্রগ্রামের সাতকানিয়া। একের পর এক নির্মম রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার এই জনপদের দ্বীন প্রিয় যুবক।২০১১ সালে শাসক গোষ্ঠির চিহিৃত সন্ত্রাসীরা প্রকাশে্য ঘোষনা দিয়ে সশস্ত্রভাবে হামলা করে সম্ভাবনাময়ী দুই তরুণ প্রিয় আব্দুল হাকিম এবং কামাল উদ্দিনকে জবাই করে হত্যা করে।
খুনিরা এখনও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। এই ভাবে সন্ত্রাসীরা দলীয় ভাবে হত্যা সন্ত্রাসের মদদ পায়।
২০১৩ সালে মাওলানা দেলোওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবকে মিথ্যা সাজার বিরুদ্ধে শান্তপ্রিয় জনতার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অবস্থানে পুলিশের নির্বিচার গুলি বর্ষনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ছদাহার তিন যুবক আবু তাহের, ওসমান, শহীদ।
লোহাগাড়াতে নিহত হয় আমিরাবাদের মিসবাহ উদ্দীন।কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এই উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের আবু ছালেহ ।
সিলেটে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় চরতির মাষ্টার মাহফুজুর রহমান।
কিছুদিন পর শহরে বাসায় সাতকানিয়া লোহাগাড়ার সাবেক এম.পি. শাহাজাহান চৌধুরীর প্রিয় ভাগিনা সাহসী যুবক মুন্নাকে বর্বরোচিত কায়দায় নিমর্মভাবে হত্যা করে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রহসনের নিবার্চনে পুলিশ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের যৌথ হামলায় নিহত হয় লোহাগাড়া উপজেলার বড় হাতিয়ার শিবির কর্মী এনামুল হক লালু। একই হামলায় পঙ্গত্ববরণ করেন শিবিরের সাথী গিয়াস উদ্দীন।
কিছুদিন পর গ্রেপ্তার করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ছদাহার কৃতি সন্তান জসিম উদ্দিনকে।
২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারী চুনতি সিরাত মাহফিল শেষে পথিমধ্যে আওয়ামী সন্ত্রাসী হামলায় শাহাদাত বরণ করেন নগরীর মহসীন কলেজের ছাত্র শিবিরের সাথী চুনতি গ্রামের জুবাইর হোসেন।
একই বছর ২৬ জানুয়ারি নগরিতে পুলিশের বর্বরোচিত হামলায় বিনা চিকিৎসায় শাহাদাত বরণ করেন লোহাগড়ার পুটিবিলার কৃতি সন্তান শিবিরের সদস্য প্রার্থী সাকিবুল ইসলাম।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষনে স্পটেই মৃত্যুবরণ করেন কাঞ্চনার বীর সাহসী যুবক আবুল বশর।
ক্ষমতাসীন গোষ্টির নির্মম বর্বরতায় এইভাবে প্রাণ হারায় সাতকানিয়া-লোহাগড়ার ১৪ জন মর্দে মুজাহিদ।
বর্বরোচিত ভাবে পঙ্গুত্বের শিকার যুবকরা
পঙ্গুত্ববরনের আহাজারীতে ও সাতকানিয়া বর্বরোচিত কায়দায় নিমর্মভাবে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের পর সাতকানিয়ায় কয়েকজন বীর তরুণ ভাইকে পরিকল্পিত ভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয়। পুলিশ নিরাপদ জায়গা থেকে গ্রেপ্তর করে নির্জন স্থানে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে গুলি করে। পরবর্তীতে হাসপাতালে জীবন রক্ষাত্বে পা কেটে ফেলা হয়। ঘটনাটিকে পুলিশ কথিত "বন্দুকযুদ্ধ "নাটক উপাধি দিয়ে রমরমা সংবাদ পরিবেশ করে উল্টো অস্ত্র মামলা করে পঙ্গু ভাইদেরকে কারাগারে আটক রাখে। পা হারিয়ে আজীবনের জন্য চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় এওচিয়ার আবু তাহের, শহীদুল ইসলাম, মোহাম্মদ এনাম। কাঞ্চানার কামাল উদ্দীন , ছদাহার রফিক ড্রাইভার, কেওচিয়ার বিবাহিত মহিলা সাজু আরা বেগম। এই সকল ভাইদের উপর অত্যাচারের ভয়াবহতা মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আইন মানবাধিকারের চরম দৈন্যদশা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
সাতকানিয়ায় হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করলেন প্রিয় ছাফা ভাই:
বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আহম্মদ ছফা ভাই। এই বছর উপজেলা সংগঠনের সাংগঠনিক সংবাদ পৌঁছে দেয়া, ইউনিট টীম বৈঠক সহ বিভিন্ন কাজে তাকে সহযোগিতার দায়িত্ব ছিল আমার। তাই বছরের শুরু থেকেই পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের অনেক বৈঠকেই ছাফা ভাইয়ের সাথে ছিলাম। ছফা ভাই থানা সংগঠনের দায়িত্বশীলের সাথে নিয়মিত ফোনে আলাপ করে প্রতিদিন কাজ বুঝে নিতেন। এই বছর পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নে সংগঠন মজবুতির দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অল্প সময়ে অনেক বৈঠক, অনেক জনশক্তির সাথে যোগাযোগ করেন।
সুন্দর দিনটি ছিল ২৪শে মে সোমবার। সুবহে সাদিকের আলোর সাথে ঝলমলে দিন শুরু হয়। ভোরে ছোট ছেলে মেয়ের সাথে নাস্তা সেরে কর্মব্যস্ততায় বেরিয়ে যায় ছাফা ভাই। অনেক কাজের মধ্যে রুটিন মাফিক নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইকামাতে দ্বীনের কাজ।এই দিন চট্রগ্রাম শহরে অবস্থানরত বাছাইকৃত কর্মীদের পাঠচক্র ছিল।এক সপ্তাহ আগেই পাঠচক্রেরর দাওয়াত দেয়া হয়। বিগত ৫ দিন ধরে তিনি জ্বরে আক্রান্ত থেকে একটু সুস্থ হয়েছে। অসুস্থতার মাঝেও পাঠচক্রে আসতে উদগ্রীব ছিল। যথাসময়ে বাদে মাগরিব ছারওয়ার ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত হয়েছে ছাফা ভাই। মেহমান ছিলেন মুহতারাম থানা আমীর মাওলানা আবুল ফয়েজ ভাই। রাত ৮টায় শেষ হয়। পাঠচক্রের নির্ধারিত বিষয়ে ছাফা ভাই প্রাণবন্ত আলোচনাও করেন। পরবর্তী প্রোগ্রাম রমজানে তাহার বাসায় ইফতার সহ করার জন্য প্রোগ্রামে সবাইকে দাওয়াত দেন। আমরা সবাই ছাফা ভাইয়ের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করি।
হঠাৎ প্রোগ্রাম শেষে সরকারের পেটুয়া বাহিনী ডিবি পুলিশ ৫ম তলা বাসায় আমাদেরকে ঘিরে ফেলে। সবাইকে গ্রেপ্তার করে লালদিঘী ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। তখন রাত ৮:৩০টা। ডিবিতে কর্মরত অফিসারের সহযোগিতায় আমরা সবাই নিজের মোবাইলে নিজ নিজ পরিবারের সাথে কথা বলি। আমরা প্রশান্তি অনুভব করি।খুবই ঘনিষ্ট দুই বন্ধু হেলাল সহ রাত ৯টার দিকে ছফা ভাইয়ের সাথে দেখা করেন। পারিবারিক, ব্যবসায়িক, মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে দুই বন্ধুর সাথে আলোচনা করেন। ডিবি থেকে মোবাইলটি নিয়ে বন্ধুকে দিয়ে দেন ছফা ভাই।
ছারওয়ার ভাইয়ের কয়েক জন আত্বীয়ও দেখা করেন। ডিবি অফিসারদের সৌহার্দ্যপূর্ন আলোচনার পরে আমরা টেনশন মুক্ত হয়ে যায়। রাত ১টার দিকে কোতেয়ালি থানায় নিয়ে যায়। রাতে ইবাদাত, গল্পে, সামান্য ঘুমে ফজর হয়। খুব ভোরে কয়েক জন ভাই হাজতে দেখা করেন। আমার ভাই,স্ত্রী, ছারওয়ার ভাইয়ের ভাইয়েরা, ফয়েজ ভাইয়ের আত্বীয়রাও দেখা করেন।
সকাল ১১টার দিকে আবার ডিবি অফিসে নিয়ে আসে। সেখানে পারিবারিক তথ্য, ছবি তোলা সহ বিভিন্ন আনুস্টানিকতা শেষে বিকাল ৫টার দিকে নতুন মামলায় আসামী করে আদালতে নিয়ে যায়। উদ্বিগ্ন সংঠনের ভাইয়েরা ও
সবার আত্বীয় স্বজন দেখা করেন। আমাদের দেখে তারা কিছুটা স্বস্তি পাই, টেনশন মুক্ত হয়। আদালত থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই কারাগারে প্রবেশ করি। কারাগারে প্রবেশ করেই ছাফা ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় আমদানিতে না গিয়ে আমরা সরাসরি পদ্মা ৫ ওর্য়াডে চলে যাই । বিগত দুই দিনে ডিবি অফিসের ঝামেলা, কোতেয়ালি থানার হাজতের রাত, র্কোটের হাজত রুমের চরম ভোগান্তি শেষে সরাসরি ওর্য়াডে প্রবেশ আমাদের জন্যে ছিল পরম প্রশান্তি। গোসল,খাবার, নামাজ দুআ শেষে তিনদিনের নিদ্রাহীন ক্লান্ত শরিরে সহজেই বিশ্রামের সুযোগ হয়। বিষয়টি একান্তই ছাফা ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টাই।
কারাগারে জুমাবার, শনিবার ছাফা ভাইকে ইবাদত বন্দেগিতে খুবই ব্যস্ত দেখি। অল্প দিনেই ওর্য়াডের সবার সাথে সুসর্ম্পক গড়ে তুলেন। রবিবার রিমান্ড শুনানিতে র্কোটে আসি। ম্যাজিস্ট্রেট এডভোকেটদের যাবতীয় যুক্তি, কারণকে নাকচ করে সবাইকে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড মঞ্জুরের পর থেকে একটুু বিচলিত দেখা যায় ছাফা ভাইকে। ছাফা ভাই পারিবারিক এবং ব্যাসায়িক বিষয়ে একটু বেশি চিন্তিত ছিল।
দ্বিতীয়ত ব্যবসায়িক ঝামেলা। ব্যবসায় বিগত সময়ে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ব্যবসায়িক মামলায় কারাগারেও এসেছিলেন। নতুন ভাবে ব্যবসায় শুরু করেছেন। সেখানে আবার গ্রেপ্তার। পরিবার এবং ব্যবসায় নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। রিমান্ড মনজুর হয়েছে, রিমান্ডে যেতে হবে। এই রিমান্ড নিয়ে টেনশনে ছিলেন। শারিরীক ভাবে বিভিন্ন রোগে অসুস্থতাও ছিল।
তারপরেও সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার দুপুর র্পযন্ত কুরআন-হাদীস এবং ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নে খুবই ব্যস্ত থাকেন। কুরআনের বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান র্অজনে খুবই আগ্রহী দেখতাম। প্রতিদিন সকালে নামাজ পড়ে নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন করতেন। মাঝে, মাঝে কুরআন হাদীসের বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করতেন। ইবাদত,বন্দেগী, দ্বীনি ইলম অর্জনে ব্যস্ত থাকতেন। বুধবার বিকাল ৪ টায় রিমান্ডে যেতে ডাক আসে। সাথে সাথে সবাই ৪ রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সবাইকে ডান্ডাবেড়ি পড়ার জন্যে কারারক্ষীকে র্নিদেশ দেন। ছাফা ভাই আগে থেকে বিচলিত ও অসুস্ত ছিল।থানা আমির ফয়েজ ভাই বয়স্ক এবং অসুস্থ। তাই থানা আমির এবং ছাফা ভাইকে ডান্ডাবেড়ি না পড়াতে অনুরোধ করি। কিন্তু আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে দুই জনকেই ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়। তখন ছাফা ভাই আরো অসুস্থ হয়ে পড়েএবং সারা শরির খুব ঘেমে যায়।
এই অবস্থায় আসর নামাজ পড়ে কারা ফটকে প্রবেশ করি। সেখানে ফ্লোরে বসে যায় তিনি।
বিকাল ৫:৩০ টায় ডিবি অফিসে পৌছি। অসুস্থায় তিনি আরো বেশি ছটফট করেন। দোয়া ,দরুদ পড়তে থাকেন। একটু দাড়ান আবার বসে পড়েন। আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন কিছুক্ষণ। আমাদের একজন ভাই তাকে বললেন, আপনি হতাশ হচ্ছেন কেন? তিনি সাথে সাথে মৃদু প্রতিবাদে শক্ত করে বললেন,"আমি এগুলোকে ভয় পায়না, ঈমানের সাথে কিভাবে মৃত্যবরন করতে হয় তা আমি জানি। আমি মানসিক ভাবে খুব শক্ত। আপনি বুঝতেছেন না। আমি বাস্তবে খুব অসুস্থতা অনুভব করতেছি"।
থানা আমিরকে আবার তিনি বললেন আমার খুব খারাপ লাগতেছে। আমি এখন কি করব? আমির সাহেব রোজা ভাংতে বললেন। তিনি রাজি হচ্ছে না। আমাদের ফরমান ভাই খুব জোর দিয়ে বললেন, "আপনি গ্রেপ্তার, রিমান্ডে, খুব অসুস্থ, রোজা আপনার উপর ফরজ নয়"। এইভাবে অনুরোধে কিছু পানি পান করালাম। আবার একটু খারাপ বেশি লাগতেছে। আমরা ডিউটি অফিসারকে ডেকে ডিউটি অফিসারের রুমে তাকে পাঠালাম। আমরা ভাবলাম তাকে খুব দ্রুত মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হবে। না! ইফতারের পূর্ব মুহুর্তে আবার আমাদের রুমে চলে আসলেন। সবার সাথে ইফতার করলেন। সব কিছু অল্প অল্প খেলেন। নামাজের জন্য দাড়ালেন। একটু পায়চারি করলেন। হঠাৎ দেখি বমির ভাব ভাব। সাথে সাথে দরজার পাশে আল্লাহু আকবর বলে পড়ে গেলেন। দ্রুত ডিউটি অফিসারের রুমে নিয়ে গেলেন। কতক্ষণ পর মেডিকেলে নিয়ে গেল।
কি হল আমরা আর জানলাম না। আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারো কাছ থেকে কোন খবর পাচ্ছি না। মনে হয় ২০ মিনিট পর মেডিকেলে দিকে যাত্রা করলেন। এইভাবে অজানা আশংকায় আমাদের সময় কাঠতে লাগল।
কোন আত্বীয় স্বজনও আমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি। কত্যর্বরত পুলিশকে জিজ্ঞেসা করলেও কোন সংবাদই বলেনা। সময় যত যাচ্ছে ততই আমাদের চিন্তা, টেনশন বেড়েই যাচ্ছে। এইভাবে রাত ৮টা। হঠাৎ এক সিনিয়ার অফিসার এসে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তারপর ডিবি সিনিয়ার অফিসের রুমে নিলেন। ছাফা ভাই কারাগার থেকে মেডিকেলে যাওয়া পর্যন্ত ঘঠনা লিপিবদ্ধ করে আমাদের ৫ জন থেকে আলাদা কাগজে স্বাক্ষর নিলেন। তারাও ছাফা ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের জানায়নি। জবানবন্ধি শেষ হয় রাত ১টা। তারপর কোতেয়ালী থানাতে রেখে আসলেন। সেখানে সেহেরীর খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমারা সেহেরী খেয়ে বাদে ফজর ঘুমালাম। ভোর ৮টায় ছারওয়ার ভাইয়ের বড় ভাই আসলেন। ছাফা ভাই সিরিয়াস অসুস্থ মেডিকেলে আছে বলে চলে গেলেন। সারারাত দুশ্চিন্তার মেঘ কাটল। ছফা ভাই জীবিত আছে জেনে আমরা খুব খুশি হলাম। সকাল ১০টার দিকে ছারওয়ার ভাইয়ের ছেলে আশিক আসলেন। আশিকই জানাল ছাফা ভাই গত রাতে ইন্তেকাল করেছে। সবাই খুব ভেঙ্গে পড়লাম। মনকে বুঝানো, মৃত্যু সংবাদ মেনে নেয়া খুব কঠিন হয়ে দাড়াল আমাদের জন্য।
একসাথে প্রোগাম, গ্রেপ্তার, আদালত, কারাগার, রিমান্ডে যেন সবাই একাকার ছিলাম। আজ অস্বাভাবিক ভাবে ছাফা ভাই আমাদের মাঝে নেই। আমাদের প্রিয় ভাই চলে গেলেন মহান রবের খুব কাছে আপন ঠিকানায়। দুনিয়ার লোভ-লাসার উর্ধ্বে উঠে ইকামাতের দ্বীনের কাজেই সরকারের চরম জুলুমের কাছে শাহাদাত বরণ করলেন অত্যন্ত প্রিয় আহম্মদ ছাফা ভাই।
আদর্শ জীবন চরিত্র:
শহীদ আহম্মদ ছাফা ভাই বাল্যকাল থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে গভীর সর্ম্পক তৈরি করেন। তার নিজের গ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য ছাত্রদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌছান। দাওয়াতী চরিত্রের মৌলিক গুণ ছিল তার জীবনে। সত্য কথা বলা, হাসিমুখে থাকা, বিপদে চরম ধৈর্য ধারণ করা, জনশক্তির বিপদে নিরলস ভাবে সহযোগিতা করা, সংগঠনের কাজে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করাই ছিল অন্যতম গুণ। পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের সকল জনশক্তি দল মত নির্বিশেষে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য আদর্শনীয় ব্যক্তি ছিলেন ছাফা ভাই। এই গুণের মানুষ সমাজে খুবই বিরল।
শহীদের গ্রামে রামপুর
সাতকানিয়া উপজেলা সদরের ৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ডলুনদীর তীর ঘেষে ঐতিহ্যবাহী রামপুর গ্রাম। এই গ্রামের মানুষ খুবই সহজ সরল। খুবই দ্বীনদার। অধিকাংশই ইসলামী আন্দোলনকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। জন্ম লাভ করেছে ইকামতে দ্বীনের জন্য অনেক সিপাহ সালার। এই গ্রামের প্রত্যেক বাড়ীতে রয়েছে দ্বীনের জন্য নিবেদিত কর্মী। আল্লাহর রহমতে এই গ্রামের পবিত্র মাঠিতে শায়িত আছেন শহীদ আহম্মদ ছফা ভাইয়ের প্রিয় বন্ধু সহপাঠী দ্বীনের সহযাত্রী শহীদ আনোয়ার হোসেন।
১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর সাতকানিয়া সরকারী কলেজে ছাত্রদলের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র সংগঠনের সদস্যপ্রার্থী শহীদ আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার ভাইয়ের সাথে একসাথে পড়ালেখা ও সংগঠন করতেন আহম্মদ ছফা ভাই। আনোয়ার ভাইয়ের শাহাদাৎ বার্ষিকিতে প্রতিবছর ছাফা ভাই সৃতিচারণ করতেন। আনোয়ার ভাইকে নিয়ে গর্ব করে বলতেন আমি দ্বীনের জন্য নিবেদিত একজন শহীদের বন্ধু ছিলাম। প্রিয় বন্ধুর শহীদি মিছিলে শামিল হয়ে শহীদ আহম্মদ ছফা ভাই রামপুর মাটি ও মানুষকে ধন্য করলেন।
এই রামপুর গ্রামে শায়িত আছেন ছাত্রশিবিরে শহীদ বোরহান উদ্দিন। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এইভাবে তিন জন শহীদের পবিত্র ভূমি রামপুর গ্রাম। আরো সত্য হলো এই গ্রামের আধা-কিলোমিটর পশ্চিমে শায়িত আছেন শহীদ সালাহউদ্দিন ভাই, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী শহীদ আকবর হোসেন। এক কিলোমিটার দক্ষিণে গাটিয়াডেঙ্গায় শায়িত আছেন শ্রমিক কল্যানের কর্মী শহীদ মোনায়েম মুন্না।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচয়:
শহীদ আহম্মদ ছফা সাতকানিয়া উপজেলার তৎকালিন মাদার্শা ইউনিয়নের বর্তমান পশ্চিম ঢেমশা রামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২ ভাই ২ বোনের মাঝে তিনি ৪র্থ। দুই বছর আগে বাবা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৩ সালে এস এস সি পাস করেন। সাতকানিয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এক মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। শহরের স্কুলে মেয়ে সপ্তম শেণীতে, ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। শহরে অনেক বছর থেকেই মোটর-পার্টসের ব্যবসা করে আসছেন।
জানাজা ও দাফন
বুধবার রাতেই ডিবি হেফাজতে আকষ্মিকভাবে আহম্মদ ছাফা ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদ দ্রুতই গ্রাম,শহর,দেশে বিদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। আত্বীয় স্বজন পরিবার ও সংগঠনের সকল জনশক্তি সবাই হতবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অসহায় নিরপরাধ নিরহংকার খুব সাদাসিধে সহজ সরল মানুষ ছাফা ভাইকে এই ভাবে হারিয়ে সবাই খুবই বিমূর্ষ হয়ে যায়। পরদিন শুক্রবার পরিকল্পিত পোস্টমটেম শেষ করে পুলিশ প্রহরায় শহীদের কফিন গ্রামের দিকে নিয়ে যায়। শহরে অগণিত শহীদের সাথী স্বজনরা জানাজা পড়ার আগ্রহ করলেও নির্দয় প্রশাসন সুযোগ দেয়নি। শহীদের কফিন বাদে আছর নিজ গ্রামে পৌঁছলে পূর্বেই সাতকানিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার শোকাহত জনতা জানাজা স্থলে চলে আসে। গ্রামবাসী শোকাহত জনতার ক্রনদন আর্তনাদে সশব্দে ভেসে উঠে। শোকাহত জনতার উদ্দেশ্যে রামপুর বায়তুশশরফ মাদ্রাসা মাঠে জানাজার পূর্বে বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব জাফর সাদেক, নায়েবে আমীর মুহাম্মদ ইছহাক, চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রামপুর গ্রামের কৃতি সন্তান মাওলানা নেজাম উদ্দীন, সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান রামপুরের কৃতি সন্তান জসিম উদ্দীন। আরো অনেক নেতৃত্ববৃন্দ জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সন্তানের আকুতি:
৭ম,৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা কোথায় পাবে বাবার আদর স্নেহ। প্রতিদিনের আবদার কে মিঠাবে। এই এতিম সন্তানেরা কি পড়ালেখা করতে পারবে? যে সন্তানেরা মৃত্যুর পূর্বে বাবার পাশে দাড়াতে পারেনি। তাদের ভয়াল আকুতি সবখানে। আমার বাবাকে কেন গ্রেপ্তার করা হল? বিনা কারণে কেন রিমান্ডে নেয়া হল? আমার বাবার কি দোষ ছিল?
এই নিরীহ এতিম সন্তানদের হাজারো প্রশ্নের জবাব কে দিবে?
দানব এই সরকার কি শিশুদের এই অব্যক্ত কথা বুঝবে! বৃদ্ধ মায়ের আশাগুলো অচিরেই শেষ করে দিল।অসহায় অসুস্থ মায়ের দিনগুলি কিভাবে কাটবে।দু:খ-যন্ত্রনা কে মুছে দিববে।
আজ শহীদের শাহাদাতে নির্মিত সাতকানিয়ার জনপদ। সেখানে অসংখ্য লোকের শাহাদাত বরণ, গ্রেফতার, পঙ্গুত্ববরণ, প্রশাসনের সীমাহীন লুটপাট, ভাংচুর ও ছন্নছাড়া অসংখ্য পরিবার। এমনকি অনেক মেধাবী ছাত্রের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে এই আওয়ামী দু:শাসনে। চরম নির্যাতন, নিষ্পেষণে ক্ষত-বিক্ষত সাতকানিয়ার সর্বত্রই আজ মানবতার আর্তনাদ আর আহাজারি।
শুকরিয়ার বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের ভাইয়েরা কখনো বিচলিত হয়নি। তাদের ঈমানের গতি পূর্বের তুলনায় আরো দৃঢ় হয়েছে। হাসি মুখে প্রাণ বিলিয়ে দিতেও শপথে উজ্জ্বীবিত। অসংখ্য দ্বীনের মুজাহিদ আল্লাহর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সংগঠনের প্রয়োজনে দুনিয়ার সমস্ত ভালোবাসা উপেক্ষা করে প্রশান্তমনে দ্বীনি দায়িত্বে ব্যাকুল।
মহান রবের উপর ভরসাই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। তাইতো দ্বীনের মুজাহিদরা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। ঈমানের এই অগ্নি পরীক্ষা যত বড় সফলতাও তত বড়। তারা প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করেন এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে সফলতা যদি নাও আসে তারপরেও তারা সফল।
আজ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নিশ্চিত এই সফলতার জন্য ঈমানের এই পথে সর্বোচ্চ ত্যাগের বহি:প্রকাশ ঘটাতে সদা প্রস্তুত। তাইতো শহীদি জনপদের এই ময়দানে অনেকেই হারিয়েছেন তাদের প্রিয় সন্তানকে, বোন তার ভাইকে, প্রিয়তমা স্ত্রী হারিয়েছেন তার প্রিয় স্বামীকে। কেউ হারিয়েছেন তার উপার্জিত সম্পদ কিংবা সর্বশেষ সম্বল। তারপরেও এই পথের সৈনিকেরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স:) কে হারায়নি।
এই
শহীদেরাই ইসলামী আন্দোলনের
চিরন্তন দায়িত্বশীল। তাদের
কুরবানী সাক্ষ্য দিবে অনন্তকাল।
বাতিলের হৃদয়ে আগুন
জ্বালাবে নিরন্তর। এই শাহাদাত
সময়ের আবর্তনে বিজয়ের মহাকাব্য
রচনা করবে- ইনশাল্লাহ।
তারেক হোসাইন
শহীদেরাই ইসলামী আন্দোলনের
চিরন্তন দায়িত্বশীল। তাদের
কুরবানী সাক্ষ্য দিবে অনন্তকাল।
বাতিলের হৃদয়ে আগুন
জ্বালাবে নিরন্তর। এই শাহাদাত
সময়ের আবর্তনে বিজয়ের মহাকাব্য
রচনা করবে- ইনশাল্লাহ।
তারেক হোসাইন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন