বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নির্বাচন-পরবর্তী মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হাফিংটন পোস্ট। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য লর্ড অ্যাভেবেরি বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ‘বাংলাদেশ অ্যান্ড এ হিউম্যান রাইটস ক্রাইসিস’ শীর্ষক এ মন্তব্য-প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচন আয়োজিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং সেই নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। ৫ বছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সুবিধা পেয়েছিলেন, সেই ব্যবস্থা বহাল রাখতে তার অস্বীকৃতির কারণে বিরোধী দল ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করে। ফলাফলে আজ তিনি পরিষ্কারভাবেই অবৈধ সরকার পরিচালনা করছেন এবং একদলীয় শাসনতন্ত্র কায়েমের পথে এগোচ্ছেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সহযোগী রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রহীন এ অবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, এ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যভাবে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা প্রকাশ করে না বলে প্রতীয়মান উল্লেখ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার অসন্তোষের কথা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ সরকারকে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের তারিখ নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার এ পর্যন্ত কড়া সমালোচনা করেছে। সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এমন রাজনৈতিক সঙ্কট যদি বাংলাদেশ এড়াতে চায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই অবিলম্বে নতুন নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। সেখানে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান বা পর্যবেক্ষণের পূর্ণ অনুমোদন থাকতে হবে। বছরের পর বছর ধরে ভয়ভীতি প্রদর্শন, রক্তপাত ও বিভক্তির পর বাংলাদেশের জনগণের নিদেনপক্ষে যে অধিকারটুকু প্রাপ্য, তা হলো নিরপেক্ষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ। গঠনমূলক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে অবিলম্বে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) বাংলাদেশের ওপর অবশ্যই চাপ দিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক অঙ্গনের সবগুলো দলের অংশগ্রহণে সংলাপে বসার প্রয়োজন রয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সমঝোতায় পৌঁছানো মোটেই সহজ কাজ নয় মন্তব্য করে তিনি দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তা তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আঁঁকড়ে থাকায় সরকারের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর অর্থ সুনাম হারানো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকেও আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে। শেখ হাসিনার নির্দেশে বাহ্যত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বজন-হারানোদের ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হলেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য। সামপ্রতিক সপ্তাহগুলোর ঘটনাপ্রবাহ আরও অশুভ মোড় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে পরিচালিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত। এ সপ্তাহে বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। ক্রসফায়ারের দোহাই দিয়ে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এবং এর অধিকাংশই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে নিরাপত্তা হেফাজতে। গত ১৪ দিনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তারের পর মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বিরোধী দলের সদস্যদের তাদের বাড়ি থেকে ধরে নেয়ার পর তাদের মারধর ও হত্যা করার প্রতিবেদন অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন ও নির্বাচনের জেরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ তিক্তভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন অভিযান চালাচ্ছে বলে সরকার যে যুক্তি তুলে ধরেছে, তা মিথ্যা। সরকারের মধ্যমপন্থী দলগুলোকে বর্জনের পদক্ষেপ শুধু আরও বেপরোয়া ও সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশই সৃষ্টি করবে। তিনি এ প্রসঙ্গে মিশরের উদাহরণ তুলে ধরেন। কিন্তু, মিশর যেখানে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, সেখানে বাংলাদেশ আরও মানবাধিকার সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন