বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ “দুনিয়ায় বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই। তাদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী অবস্থানস্থল সম্পর্কে তিনি অবহিত। সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা আছে।” (সূরা হুদ : ৬)
উপরোক্ত আয়াত সংশ্লিষ্ট পূর্ণাঙ্গ দারসটি নিম্মে দেয়া হলো-
* নামকরণঃ
সূরা হুদ ৫৩ নং আয়াতে হুদ আ: এবং তার কওমের কথা উল্লেখ আছে। এর ভিত্তিতেই এ নামকরণ করা হয়েছে।
* নাজিলের সময়ঃ
সূরা হুদ মক্কার জীবনের শেষ স্তরে অর্থাৎ ১০-১৩ তম বর্ষে নাজিল হয়। হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে : হযরত আবু বকর (রা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন : “আমি দেখছি আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, এর কারণ কী?” জবাবে তিনি বলেন, “সূরা হুদ ও তারই মতো বিষয়বস্তু সংবলিত সূরাগুলো আমাকে বুড়ো করে দিয়েছে।”
এ থেকে অনুমান করা যাবে, যখন একদিকে কুরাইশ বংশীয় কাফেররা নিজেদের সমস্ত অস্ত্র নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যের দাওয়াতকে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছিল ।
এ সূরার আলোচ্য বিষয়ঃ
-এ সূরার আলোচ্য বিষয় সূরা ইউনুসের অনুরূপ। অর্থাৎ দাওয়াত, উপদেশ ও সতর্কবাণী। তবে পার্থক্য হচ্ছে, সূরা ইউনূসের তুলনায় দাওয়াতের অংশ এখানে সংক্ষিপ্ত, উপদেশের মধ্যে যুক্তির পরিমাণ কম ও ওয়াজ-নসিহত বেশি এবং সতর্কবাণীগুলো বিস্তারিত ও বলিষ্ঠ।
-এখানে আরও বিশেষ করে বলা হয়েছে নবীর কথা মেনে নাও, শিরক থেকে বিরত হও অন্য সবার বন্দেগি ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও এবং নিজেদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত ব্যবস্থা আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতির ভিত্তিতে গড়ে তোলো।
-এ সূরায় যে উপদেশ হয়েছে তা হলো দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিকের ওপর ভরসা করে যেসব জাতি আল্লাহর নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে ইতঃপূর্বেই তারা অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। এমতাবস্থায় ইতিহাসের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় যে পথটি ধ্বংসের পথ হিসেবে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেই একই পথে তোমাদেরও চলতেই হবে, এ ধরনের মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।
– এ সূরার মাঝে যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে তা হচ্ছে- আজাব আসতে যে দেরি হচ্ছে, তা আসলে একটা অবকাশ মাত্র। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদের এ অবকাশ দান করছেন। এ অবকাশকালে যদি তোমরা সংযত ও সংশোধিত না হও তাহলে এমন আজাব আসবে যাকে হটিয়ে দেয়ার সাধ্য কারোর নেই এবং যা ঈমানদারদের ক্ষুদ্রতম দলটি ছাড়া বাকি সমগ্র জাতিকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
– এ বিষয়বস্তুসমূহ উপলব্ধি করার জন্য সরাসরি সম্বোধন করার তুলনায় নূহের জাতি, আদ, সামুদ, লূতের জাতি, মাদয়ানবাসী ও ফেরাউনের সম্প্রদায়ের ঘটনাবলির সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে বেশি করে।
* আয়াতের ব্যাখ্যাঃ
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা সকল প্রাণীর রিজিক তার যে তাঁর জিম্মায় রয়েছে সে কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর জলে-স্থলে, গাছ-গাছালিতে, গুহায় এবং গর্তে যত স্থান হতে পারে এবং যত স্থানে প্রাণী থাকতে পারে, তাদের সকলের আহার ব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। কোন জীব কোথায় থাকে, কোথায় চলাচল করে, কোথায় আশ্রয় গ্রহণ করে, কোথায় মৃত্যুবরণ করে, মায়ের উদরে কী থাকে সব কিছুই মহান আল্লাহর কিতাবে লেখা রয়েছে। (তাফসির ইবন কাসির)
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন-
ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল কোন প্রাণী এবং বাতাসে ডানা বিস্তার করে উড়ে চলা কোন পাখিকেই দেখ না কেন, এরা সবাই তোমাদের মতই বিভিন্ন শ্রেণী। তাদের ভাগ্যলিপিতে কোন কিছু লিখতে আমি বাদ দেইনি। তারপর তাদের সবাইকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে। (সূরা আল আনআম : ৩৮)
মহান আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কিছুই হয় না বা তাঁর অজ্ঞাতসারে কোনো কিছুই ঘটে না সে ব্যাপারে কুরআনুল কারিমে অন্যত্র বলা হয়েছে-
তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন । তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে। (সূরা আল আনআম : ৫৯)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনের প্রণেতা বলেনঃ
যে আল্লাহ এমন সূক্ষ্মজ্ঞানী যে প্রত্যেকটি পাখির বাসা ও প্রত্যেকটি পোকা-মাকড়ের গর্ত তাঁর জানা এবং তাদের প্রত্যেকের কাছে তিনি তাদের জীবনোপাকরণ পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর তা ছাড়া প্রত্যেকটি প্রাণী কোথায় থাকে এবং কোথায় মৃত্যুবরণ করে প্রতি মুহূর্তে যিনি এ খবর রাখেন, তাঁর সম্পর্কে যদি তোমরা এ ধারণা করে থাকো যে, এভাবে মুখ লুকিয়ে অথবা কানে আঙুল চেপে কিংবা চোখ বন্ধ করে তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাবে তাহলে তোমরা বড়ই বোকা। সত্যের আহবায়ককে দেখে তোমরা মুখ লুকালে তাতে লাভ কী?
এর ফলে কি তোমরা আল্লাহর কাছ থেকেও নিজেদের গোপন করতে পেরেছো ? আল্লাহ কি দেখছেন না, এক ব্যক্তি তোমাদের সত্যের সাথে পরিচিত বরাবর দায়িত্ব পালন করছেন আর তোমরা তার কোন কথা যাতে তোমাদের কানে না পড়ে সেজন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো। (তাফহিম)
প্রাগুক্ত আয়াতের প্রাসঙ্গিকতার আলোকে বলা যায়, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক দানের ব্যাপারে কিছু নিয়ম রয়েছে, তা বিস্তারিত আলোচনার আগে রিজিক কাকে বলে তা স্পষ্ট হওয়া দরকার।
রিজিক এমন জিনিস, যা মহান আল্লাহ প্রাণিকুলের নিকট নিয়ে যান এবং প্রাণীরা তা আহার করে। এ রিজিক অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেমন- স্বাস্থ্য, সম্পদ, খাদ্য, বুদ্ধি, উপায়-উপকরণ, সময় ইত্যাদি। এমনকি আমাদের জীবনটাও রিজিক। এই সবকিছু আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ হলেন আর-রাজ্জাক তথা রিজিকদাতা।
এখন প্রশ্ন হলো আমরা যদি একবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, তাহলে আমাদের সামনে রিজিক আসবে না চেষ্টা করতে হবে? অবশ্যই খাবারের সন্ধানে চেষ্টা করতে হবে। শুধু তাই নয়, এ রিজিক বৃদ্ধি জন্য আমল করা, সর্বোপরি মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা একান্ত কর্তব্য।
মহান আল্লাহ রিজিক অন্বেষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন : তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। (সূরা আল-জুমুআ, ১০)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, তোমাদেরকে আমি ক্ষমতা-ইখতিয়ার সহকারে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এবং তোমাদের জন্য এখানে জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করেছি। কিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর গুজারি করে থাকো। (সূরা আল আরাফ : ১০)
অধিকাংশ কাজ যার মাধ্যমে রিজিক অর্জন করা যায়, তা তিনি সহজ করেছেন, কঠিন করেননি। তিনি এ ব্যাপারে বলেন,
তিনিই তো সেই মহান সত্তা যিনি ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। তোমরা এর বুকের ওপর চলাফেরা করো এবং আল্লাহর দেয়া রিজিক খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। (সূরা আল মুলক : ১৫)
আয়াতে একটি কথা স্পষ্ট করা হয়েছে, দুনিয়াতে জীবন পরিচালনার জন্য যত কিছুই করা হোক না কেন, এ দুনিয়া শেষ ঠিকানা নয়। যত উপার্জন হোক না কেন, তা স্থায়ী কোনো সম্পদ নয়। সকলকে অবশ্যই একদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই তাঁর উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহর সামনে হিসাব দিতে হবে কোন স্থান থেকে থেকে উপার্জন করলে এবং কোথায় ব্যয় করলে।
এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে , ইবনু মাসউদ রা: হতে বর্ণিত আছে, নাবী সা: বলেছেন : কিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ্ তা’আলার নিকট হতে সরতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা ব্যয় করেছে; তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা হতে তা উপার্জন করেছে এবং তা কী কী খাতে খরচ করেছে এবং সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল, সে মুতাবিক কী কী আমল করেছে। (জামে আত তিরমিজি)
রিজিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান যে সকল আমল করা যায় তা হচ্ছেঃ
-মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও খোদাভীতি অবলম্বন করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
আল্লাহ তাআলা বলেন-
জনপদগুলোর লোকেরা যদি ঈমান আনত আর তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান আর জমিনের কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম কিন্তু তারা (সত্যকে) প্রত্যাখ্যান করল। কাজেই তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে পাকড়াও করলাম। (সূরা আল আরাফ : ৯৬)
তিনি আরো বলেন : যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য কোন না কোন পথ বের করে দেবেন। আর তাকে রিজিক দিবেন (এমন উৎস) থেকে যা সে ধারণাও করতে পারবে না। (সূরা ত্বালাক : ২-৩)
-কৃতকর্মের জন্য তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা।
তাওবা বা ফিরে আসার জন্য মৌলিক কয়েকটি শর্ত রয়েছেঃ
১. যে পাপে লিপ্ত তা তাৎক্ষণিক বর্জন করা
২. উক্ত পাপের জন্য লজ্জিত হওয়া
৩. সমকালীন সময়ে কোনোভাবেই উক্ত পাপ বা অন্যায় কাজে যুক্ত না হওয়া
৪. ভবিষ্যতে পুনরায় পাপে লিপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
তাওবা বা ফিরে আসার জন্য মৌলিক কয়েকটি শর্ত রয়েছেঃ
১. যে পাপে লিপ্ত তা তাৎক্ষণিক বর্জন করা
২. উক্ত পাপের জন্য লজ্জিত হওয়া
৩. সমকালীন সময়ে কোনোভাবেই উক্ত পাপ বা অন্যায় কাজে যুক্ত না হওয়া
৪. ভবিষ্যতে পুনরায় পাপে লিপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
এ কাজের মাধ্যমেও মহান আল্লাহ রিজিক বৃদ্ধির ঘোষণা প্রদান করে বলেন
আমি বলেছি ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তানাদি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন। (সূরা নূহ : ১০-১২)
তিনি অন্যত্র আরো বলেন-
তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা চাও, আর অনুশোচনাভরে তাঁর দিকেই ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তোমাদেরকে উত্তম জীবন সামগ্রী ভোগ করতে দিবেন, আর অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিনি তাঁর অনুগ্রহ দানে ধন্য করবেন। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ওপর বড় এক কঠিন দিনের আজাবের আশঙ্কা করছি। (সূরা হুদ : ৩)
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সা. বলেন-
যে ব্যক্তি বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাকে তার সকল দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করবেন, সকল সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ দিবেন এবং তাকে এমনভাবে রিজিক দিবেন, যা কোন মানুষ ধারণা করতে পারে না। (মুস্তাদরাক হাকেম)
-আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা করা।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা-
যে কেউ আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ নিজের কাজ সম্পূর্ণ করবেনই। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য করেছেন একটা সুনির্দিষ্ট মাত্রা। (সূরা ত্বালাক : ৩)
এ ব্যাপারে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা কর তাহলে তোমাদেরকে জীবিকা দেয়া হবে ঐভাবে যেভাবে দেয়া হয় পাখিকে। পাখি সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা ত্যাগ করে এবং পেট পুরে ফিরে আসে। (আহমাদ, তিরমিজি, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান ও হাকেম)
-আল্লাহর ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লøাহ বলেন : হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাজের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন। (সূরা আল বাকারা : ১৫৩)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে বলেন :
আবু হুরায়রা রা: কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেন, অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য আত্মনিয়োগ কর আমি তোমার অন্তরকে অভাবমুক্ত করব, তোমার অভাবকে মোচন করব, আর যদি এরূপ না কর তাহলে তোমার হাতকে কর্মে ব্যস্ত করব এবং তোমার অভাব মোচন করব না। (আহমাদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও হাকেম)
অনুরূপ আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে- মাকাল বিন ইয়াসার রা: কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
আল্লাহ তাআলা বলেন : হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য আত্মনিয়োগ কর আমি তোমার অন্তরকে অভাবমুক্ত করব এবং তোমার হাতকে জীবিকায় পরিপূর্ণ করে দেব। হে আদম সন্তান! আমা হতে দূরে সরে যেও না (যদি যাও তাহলে) তোমার অন্তরকে সঙ্কীর্ণ ও দরিদ্র করে দেব, আর তোমার দু-হাতকে কর্মে ব্যস্ত করে দেব। (মুস্তাদরাক হাকেম, মুজামুল কাবির)
-আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা।
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এসেছে। আলী রা: কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন : যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার বয়স বৃদ্ধি করা হোক, তার জীবিকা বৃদ্ধি করা হোক এবং জঘন্য মৃত্যু থেকে সে পরিত্রাণ পাক, তাহলে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে। (আহমাদ)
তিনি আরও বলেন-
যে ব্যক্তি পছন্দ করে তার রিজিক অথবা তার হায়াত বৃদ্ধি হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে। (বুখারি)
এ ছাড়াও আরো যা করলে রিজিক বেড়ে যাবে তা হচ্ছে.
-আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন : হে নবী! তাদেরকে বলো, “আমার রব তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান মুক্ত হস্তে রিজিক দান করেন এবং যাকে চান মাপাজোখা দেন। যা কিছু তোমরা ব্যয় করে দাও তার জায়গায় তিনি তোমাদের আরো দেন, তিনি সব রিজিকদাতার চেয়ে ভালো রিজিকদাতা।” (সূরা সাবা : ৩৯)
নবী করিম সা. এ ব্যাপারে বলেন :
আবু হুরায়রা রা: কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন : বান্দাগণ যখন প্রভাত করে তখন দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি তোমার পথে ব্যয় করে তাকে উত্তম প্রতিদান দাও। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণের মাল ধ্বংস কর। (বুখারি)
রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন :
আবু হুরায়রা রাধ থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন : হে আদম সন্তান! খরচ কর। আমি তোমার ওপর খরচ করব। (বুখারি)
-আল্লাহর পথে হিজরত করার মাধ্যমে রিজিক বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর ঘোষণা-
যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য প্রাপ্ত হবে। (সূরা নিসা : ১০০)
যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য প্রাপ্ত হবে। (সূরা নিসা : ১০০)
-দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি মমতা দেখানো।
-দ্বীনি ইলম অন্বেষণে আত্মনিয়োগকারীর জন্য ব্যয় করা।
-হজ ও উমরাহর পারস্পরিকতা তথা হজ ও উমরাহ পরপর আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সা. এ ব্যাপারে বলেন :
-দ্বীনি ইলম অন্বেষণে আত্মনিয়োগকারীর জন্য ব্যয় করা।
-হজ ও উমরাহর পারস্পরিকতা তথা হজ ও উমরাহ পরপর আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সা. এ ব্যাপারে বলেন :
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা হজ ও উমরাহ পরস্পর আদায় কর, কেননা উক্ত কাজ দু’টি তেমনভাবে অভাব ও পাপকে মিটিয়ে দেয়, যেমন হাপর সোনা, চাঁদি এবং লোহার মরিচাকে মিটায়। আর কবুল হজের সওয়াব হচ্ছে একমাত্র জান্নাত। (নাসায়ী, তিরমিজি)
রিযিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকভাবে পরিত্যাজ্য কিছু বিষয় রয়েছে। সেগুলো পরিত্যাগ করতে না পারলে রিজিক হারাম হয়ে যাবে। যেমন :
-কোন রিজিক বা উপার্জন সামান্যতম হারামের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তা পরিত্যাগ করতে হবে।
এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে, নু‘মান ইবনু বাশীর রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট, উভয়ের মাঝে বহু অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে। যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ পরিত্যাগ করে, সে ব্যক্তি যে বিষয়ে গুনাহ হওয়া সুস্পষ্ট, সে বিষয়ে অধিকতর পরিত্যাগকারী হবে।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহযুক্ত কাজ করতে দুঃসাহস করে, সে ব্যক্তির সুস্পষ্ট গুনাহের কাজে পতিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। গুনাহসমূহ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা, যে জানোয়ার সংরক্ষিত এলাকার চার পাশে চরতে থাকে, তার ঐ সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। (বুখারী, হাদিস নম্বর ২০৫১)
-ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য পরিধেয় বস্ত্রসহ সবকিছু হালাল উপার্জনের দ্বারা হতে হবে অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাসূল সা: বলেন : “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তু গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণকে।” আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে ইমানদারগণ তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রিজিক হিসেবে দান করেছি।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, হে আমার রব, হে আমার রব অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। সুতরাং তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?।” (মুসলিম হা/২৭৬০; মিশকাত হা/২৭৬০)
-মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে সম্পদ বা রিজিক অর্জন না করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা নিয়ে যায় পাপ কাজের দিকে, আর পাপকাজ জাহান্নামে নিক্ষেপ করে।
-সুদের সাথে কোন অবস্থাতেই সম্পৃক্ততা না থাকা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ খুব শক্তভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন : “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের জুলুম করা হবে না।” (সূরা আল বাকারা : ২৭৮-২৭৯)
-জুলুম একটি সর্বাধিক নিন্দনীয় অপরাধ, যা শক্তিমান মানুষ করে থাকে আর দুর্বল ব্যক্তি নীরবে তা সহ্য করে এবং আল্লাহর নিকট বিচার পেশ করে। জুলুমের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার কারণে ইসলামে যেকোনো ধরনের জুলুম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ পন্থায় চলা কোন ব্যক্তি আখিরাতে একেবারে রিক্তহস্ত হয়ে যাবে। সুতরাং এ পথে সম্পদ অর্জন একেবারে চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা কি জান কপর্দকহীন কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নেই সে হলো কপর্দকহীন। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো কপর্দকহীন, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিকে সেদিন তার নেক আমলনামা দিয়ে দেয়া হবে।
-অপচয় ও অপব্যয় না করা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ অর্জন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যে কোন ধরনের অপচয় ও অপব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন : “আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকেও। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)
-ঘুষের সম্পৃক্ততা না থাকা। ঘুষ দেয়া, নেয়া বা এর সাথে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা রাখলে সে উপার্জন সরাসরি হারাম হয়ে যাবে। হাদিসে এসেছে : “আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহণকারী উভয়কে লানত দিয়েছেন।”
-অন্যের অধিকার নষ্ট না করা। অন্যের হক বঞ্চিত করার মাধ্যমে যে উপার্জন করা হয় তা অবৈধ। তাই সকল প্রকার খেয়ানত থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল এবং তোমাদের সম্মান নষ্ট করা তোমাদের জন্য হারাম।’’
আয়াতের শিক্ষা
-মানব মনে যত প্রকার চাহিদার উদয় হয়, সর্বাবস্থায় তা মহান আল্লাহর নিকট পেশ করতে হবে;
-যে কোন ধরনের রিজিক একমাত্র মহান রবের কাছে যাচনা করতে হবে;
-মানব মনে যত প্রকার চাহিদার উদয় হয়, সর্বাবস্থায় তা মহান আল্লাহর নিকট পেশ করতে হবে;
-যে কোন ধরনের রিজিক একমাত্র মহান রবের কাছে যাচনা করতে হবে;
-কোন প্রয়োজন পূরণ হতে দেরি হলেও ধৈর্যধারণ করতে হবে। কোন ধরনের শিরক, বিদআতের আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না;
-সর্বাবস্থায় হালাল রিজিক- যত কঠিন হোক- আহরণ করতে হবে, হারাম রিজিক- যত সহজ হোক পরিত্যাগ করতে হবে;
-সর্বাবস্থায় আহকামুল হাকিমিন, রাব্বুল আলামিন মহান আল্লাহর রহমতের অপেক্ষা করতে হবে এবং তাঁর সাহায্যের মাধ্যমেই সব সমস্যা সমাধানের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন, সঠিক পথে পরিচালিত করুন।লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন