বাংলাদেশ বার্তাঃ আমার হৃদস্পন্দন, আমার ভাললাগা ভালবাসা, আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাথে সাক্ষাত করে এই কিছু আগে কারাগার থেকে বের হলাম। গাড়ি চলছে, এখনো ঘরে পৌঁছাতে পারিনি। আব্বার সাথে দেখা হল আমার প্রায় এক মাস পর। মাঝে উপজেলা পরিষদের কাজে জিয়ানগরে থাকার কারনে আমি আব্বার সাথে সাক্ষাত করতে পারিনি। কিন্তু এর মাঝের প্রতিটি দিনই ছিল আমার ক্ষন গণনার, কখন আসবে কাংখিত সেই দিন। আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে কাংখিত সেই দিনও এসেছে আর আমরা দেখাও করেছি। ভাগ্যের ফেরে আজ আবার ঈদেরও দিন।
সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদনের পর সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে আব্বা এলেন। পরনে সফেদ পানজাবী তাতে গলার কাছে হালকা নীলের কাজ, মাথায় চিরচেনা সেই টুপি। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। আজকে আব্বাকে দারুন লাগছিল আলহামদুলিল্লাহ (যদিও আমার আব্বা এমনিতেই সুন্দর আলহামদুলিল্লাহ)।
আমাদের জন্য সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত মাত্র ৩০ মিনিট। আব্বার মায়াভরা পবিত্র চেহারাখানি নয়ন ভরে দেখতে গিয়েই অনুভব করেছি আমাদের সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত 'অল্প সময়টুকুন' আসলে কতো 'অল্প' !!
আলহামদুলিল্লাহ, দেখা হলো আব্বার সাথে।, কথাও হলো। কিন্তু হৃদয়ের হাহাকার মিটলোনা আমার। তার পবিত্র মুখখানি দেখার জন্য আমার ছোট্ট এ হৃদয় কতটুকুন উতলা থাকে তা আমি বলে বোঝাতে পারবোনা।
সাক্ষাত শেষে গাড়িতে করে ফিরছি আর চোখের পানি মুছছি ক্ষনে ক্ষনে। আমার মনে পড়ছে আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা। ২০১০ সালের ২৯ জুন আমাদের শহীদবাগের বাসা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আমার আব্বা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের হাস্যকর এক মামলায় গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেই থেকে কেটে গেছে আজ ৭টি বছর। একে একে হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে ১৫টি ঈদ। যে মানুষটি বিগত পঞ্চাশটি বছর ধরে বিশ্বব্যাপি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি জনপদের মানুষকে কোরআনের দাওয়াত দিয়েছেন, মানুষকে কোরআনের পথে আহবান করেছেন সেই তিনিই নাকি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করেছেন !!
ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের মামলায় গ্রেফতারের পরপরই কথিত যুদ্ধাপরাধসহ আওয়ামী সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য আমার আব্বার বিরুদ্ধে -
>> রমনা থানায় গাড়ি ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো ও পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগে (!) ২টি মামলা>> রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে (!) উত্তরা মডেল থানায় ১টি মামলা
>> পল্টন মডেল থানায় গাড়ি ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের কাজে বাঁধা ও রাষ্ট্রপতির গাড়ি বহরে হামলার অভিযোগে (!) ৩টি মামলা
>> শেরেবাংলা নগর থানায় যাকাতের ৫ লক্ষ টাকা আত্নসাতের অভিযোগে (!) ১টি মামলা
>> কদমতলী থানায় বোমা/ককটেল বানানোর অভিযোগে (!) ১টি মামলা
>> রাজশাহীর মতিহার থানায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যার অভিযোগে (!) ১টি হত্যা মামলা
>> জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয়কর ফাঁকির অভিযোগে (!) ১টি মামলা এবং
>> পিরোজপুরে অর্থের প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন করে ২টি কল্পিত যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ মোট ১৩টি মামলা দায়ের করে আওয়ামী সরকার।
এইসব কল্পিত অভিযোগ আর মিথ্যা মামলায় আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাকে টানা ৪১ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। এছাড়া সরকারের সেফ হোমেও তাকে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। এভাবে টানা রিমান্ডে নিয়ে আমার আব্বার উপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। আল্লামা সাঈদীর মতো একজন কোরআনের দা'ঈ ও সিনিয়র রীজনীতিবিদকে এতোদিন রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল এক ঘটনা।
গ্রেফতার হওয়ার সময় আমার আব্বার বয়স ছিল ৭১। এই ৭১ বছরের মধ্যে আমার আব্বার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন থানায় কোন মামলা তো বহুদূরের কথা সামান্য একটি জিডিও কোন বিষয়েই ছিলনা। কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয়, যার জীবনের ৭১ বছরের মধ্যে যার বিরুদ্ধে একটি মামলাও ছিলোনা সেই তারই বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই গায়ের জোড়ে এক এক করে মোট ১৩টি মামলা দায়ের করে !!
আওয়ামী সরকারের রোষানলে কারান্তরীণ অবস্থায়ই আমার আব্বা হারিয়েছেন তার মমতাময়ী প্রিয় মা গুলনাহার ইউসুফ সাঈদী এবং কলিজার টুকরা বড় সন্তান রাফীক বিন সাঈদীকে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একই মাঠে সন্তান হয়ে মায়ের এবং পিতা হয়ে পুত্রের নামাজের জানাজা পড়ানোর মতো দুঃসহ যন্ত্রনা সইতে হয়েছে আমার আব্বাকে। শুধু তাই নয়, মা কিংবা সন্তানের লাশের পাশে এমনকি স্বজনদের সাথেও ব্যাথা ভোলার জন্য সামান্য কিছু সময়ও তাকে কাটাতে দেয়া হয়নি। জানাজা শেষেই মাঠ থেকে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কারাগারে।
প্রায়ই একাকী বসে ভাবি, আহ্! কী অব্যক্ত বেদনাময় সময়-ই না কাটিয়েছেন আমার আব্বা তখন !!
আসলে বিশ্বব্যাপি আল্লামা সাঈদীর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় দিশেহারা তার আদর্শিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। শুধুমাত্র এ কারনেই তাঁকে জনগণ থেকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী নানাবিধ অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। আল্লাহর রহমতে ষড়যন্ত্রকারীদের সকল প্রচেষ্টাই এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমান হলো, মিডিয়ার হাজারো প্রপাগান্ডা শেষে সরকারের ইচ্ছামাফিক সাজানো মিথ্যা মামলায় মিথ্যা স্বাক্ষের ভিত্তিতে দেয়া অন্যায় রায়ের পর দেশের আপামর জনতা এ জুলুমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে। রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশে জীবন দিয়েছে তরতাজা দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। আল্লাহর মেহেরবানীতে, সরকারের হাজারো ষড়যন্ত্র আর মিডিয়ার পরিকল্পিত শত অপপ্রচারও জনগন থেকে আল্লামা সাঈদীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি আর পারবেও না কোনোদিন ইনশাআল্লাহ।
ইসলামের শত্রুদের কাছে এ বিষয়টিই অসহনীয় এবং এ কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করে ‘আজীবন কারাদন্ডে’ দন্ডিত করে কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রেখেছে।
আমার প্রান প্রিয় আব্বার বয়স এখন ৭৮ চলছে। নানারকম শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে কারাগারে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি। চিকিৎসার অভাবে হাটু ও কোমড়ের ব্যথার তীব্রতা প্রতিদিন বাড়ছেই। ৩৭ বছরের ডায়াবেটিক আর হার্টের সমস্যাতো তার নিত্যদিনের সঙ্গী।
৭৮ বছর বয়স্ক আমার আব্বা শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও তার মানসিক মনোবল আল্লাহর মেহেরবাণীতে পর্বতসম।
আজ ছিল ঈদের দিন। আব্বাকে কারাগারে রেখে এটি আমাদের ১৫তম ঈদ। আমাদের ঈদ আজ জালিমের কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী। পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা কারাগারে থাকা অবস্থাতেই হারালাম কলিজার টুকরা বড় ভাই রাফীক বিন সাঈদী রাহিমাহুল্লাহকে, তেমনি হারিয়েছি প্রিয় দাদীকেও।
আমাদের পরিবারে ঈদের আনন্দ বলতে এখন আর কিছু নেই। আমাদের ঈদ আনন্দ এখন আমরা খুঁজে বেড়াই অতীত স্মৃতির মাঝে। চারপাশের মানুষের ঈদের আনন্দ দেখে আজকাল মাঝে মধ্যে বড় ঈর্ষা হয়।
আহারে! এই ঈদ আনন্দ এক সময় আমাদেরোতো ছিল !সরকার আমাদের এই আনন্দটুকুনও কেড়ে নিয়েছে ...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন