বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ (মুসলিম ষ্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব আমেরিকা এণ্ড ক্যানাডার প্রতিনিধি জনাব আনিস আহমদ ১৯৭৯ সালের ৮ই এপ্রিল বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের চিন্তানায়ক, জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর (রঃ) একটি ইন্টারভিউ গ্রহণ করেন। মূলতঃ এটি এম, এস, এর বার্ষিক সম্মেলনের জন্যে শুভেচ্ছাবাণী হিসেবে রেকর্ড করা হয়, যদিও তা প্রশোত্তরের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে।
এম, এস, এর প্রতিনিধি
মাওলানা! দারুণ অসুস্থতা সত্ত্বেও আমাদের দাওয়াত কবুল করায় এবং আমাদের বার্ষিক সম্মেলন’৭৯ এর জন্যে এ বিশেষ ইন্টারভিউ দিতে রাজী হওয়ায় আমি দক্ষিণ আমরিকা ও ক্যানাডার মুসলমানদের এবং এম.এস.এর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আন্তরিক শুকরিয়া জানাই। এটা একান্তই আল্লাহর মেহেরবানী ও অনুগ্রহ যে, দক্ষিণ আমেরিকায় আপনার ও ইখওয়ানুল মুসলেমুনের নেতৃবৃন্দের লিখনী ইসলামী আন্দোলনের চিন্তাকে দ্রূত প্রসারিত করে চলেছে। আজ আমেরিকায় অগণিত লোক আপনাকে এক নযর দেখার জন্যে এবং আপনার পক্ষ থেকে কিছু উপদেশবাণী শুনার জন্যে অপেক্ষামান। তাদেরই প্রবল আগ্রহ ও দাবীর পেক্ষিতে আমি আপনার খেদমতে হাযির হয়েছি।
প্রশ্নঃ মুহতারাম মাওলানা! কুরআনে করীম রাসূলে খোদা (সঃ)-কে ‘দা’য়ী ইলাল্লাহ’ বলে আখ্যায়িত করে। কুরআন এবং সীরাতে পাকের আলোকে একজন দা’য়ীয়ে হকের জন্যে কোন্ সব গুণাবলীকে আপনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
জবাবঃ আমেরিকা এবং ক্যানাডায় আল্লাহর যেসব বান্দাহ ইসলামী আন্দোলনের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সকলকে আমার পক্ষ থেকে সালাম পৌছে দেবেন। (অসুস্থতার কারণে) আমি বেশীক্ষণ কথা বলতে পারিনা। তাই সংক্ষিপ্তভাবে আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিঃ
‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো আর ঘোষণা করলো: ‘আমি একজন মুসলমান’ (হামীম সাজদাহ-৩৩)
এ আয়াতের পূর্ণ গুরুত্ব অনুধাবনের জন্যে একথা মনে রাখতে হবে যে, এ আয়াত মক্কার কঠিন বিরোধিতার পরিবেশে নাযিল হয়েছে। এটা ছিল সেই মর্মান্তিক অধ্যায়, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের উপর নির্মম নির্য়াতন চালানো হচ্ছিল। সে পরিবেশে একথা বলা এবং ঘোষণা করা কোনো সহজ ব্যাপার ছিল না যে, ‘আমি একজন মুসলমান’। এরূপ অবস্থা ও পরিবেশে প্রথম কথা এটা বলা হলো যে, সে ব্যক্তির কথাই সর্বোত্তম, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে। অন্য কথায় একজন সত্যপথের দাওয়াত দানকারীর বৈশিষ্ট্যই এটা যে তার দাওয়াত হবে আল্লাহর দিকে। তার সামনে কোননো প্রকার পার্থিব উদ্দেশ্য থাকবে না। দ্বিতীয় কোনো উদ্দেশ্যই তার মনের কোণে স্থান পেতে পারবে না। যে ব্যাক্তি খালেছভাবে আল্লাহর দিকে আহবান করেন, কুরআন মজীদের শিক্ষা অনুযায়ী এমন আহ্বানকারীর প্রথম বৈশিষ্ট্য এটাই হতে হবে যে, তিনি আল্লাহর একত্বের (তাওহীদের) প্রতি দাওয়াত দেবেন। তাকে এ ভাবে আহ্বান করতে হবেঃ হে মানুষ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব, আনুগত্য বা উপাসনা করবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে না। তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে কিছু পাওয়ার লোভ ও কামনা করবে না। কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুম ও নির্দেশ সমূহের আনুগত্য করো। কেবলমাত্র তাঁর বিধানেরই অনুসরণ করো।
পৃথিবীতে মানুষ যে কাজই করে। সে একথা চিন্তা করেই করে যে, আমি কার গোলামী ও আনুগত্য কারছি এবং কার নিকট জবাবদিহি করতে হবে। মানুষের সমস্ত তৎপরতা ও চেষ্টা সাধনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হওয়া চাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ লাভ।
দ্বিতীয় কথা বলা হয়েছে। হক পথের দাওয়াত দানকারীকে আমলে সালেহর সৌন্দর্যে সুশোভিত হতে হবে। তাকে নেক আমল করতে হবে। একটু চিন্তা করলে এ পরমানটার তাৎপর্য পরিস্কার হয়ে যাবে। ব্যাপারটা হচ্ছে দাওয়াত দানকারীর নিজের আমলই যদি দুরন্ত না হয়, তবে তার দাওয়াতের আর কোন প্রভাবই থাকে না। তা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে যায়। একজন ব্যক্তি যে জিনিসের প্রতি লোকদেরকে দাওয়াত দেবেন তার নিজেকেই প্রথমে সে জিনিসের প্রতিমূর্তি হতে হবে। তার নিজের জীবনে আল্লাহর নাফরমানীর এতটুকু বির্চুতিও যেনো পাওয়া না যায়। তার নৈতিক চরিত্র এমন হতে হবে যেনো কোন ব্যক্তি তাতে একটি দাহও খুজেঁ না পায় তার আশপাশের পরিবেশ, তার সমাজ, তার বন্ধু বান্ধব, তার আপনজন ও আত্মীয় স্বজন যেনো একথা মনে করে যে, আমাদের মধ্যে এক উচ্চ ও পবিত্র চরিত্রের ব্যক্তি রয়েছেন।
কুরআন পাকের সাথে সাথে সীরাত পাকেও আমরা হুবহু এ একই শিক্ষা পাই। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর হায়াতে তাইয়েবা সাক্ষ্য দেয় যে, যখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনে হকের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেন, তখন সেই সমাজ যাদের মধ্যে তিনি জীবনের চল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেন, তাদের মধ্যে এমন একজন লোকও ছিল না, যে তাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্রের প্রবক্তা এবং প্রশংসাকারী ছিলো না। যে ব্যক্তি তাঁর যত নিকটে অবস্থান করছিলো, সে ততো বেশী তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিলো। যে লোকগুলো থেকে তাঁর জীবনের কোনো একটি দিকও গোপন ছিলো না, তারাই সর্বপ্রথম তাঁর নবুওয়াতের স্বীকৃতি দান করেন।
হযরত খাদীজা (রাঃ) বিগত পনরটি বছর হুজুর (সঃ)-এর দাম্পত্য জীবনের একান্ত সঙ্গী ছিলেন। তিনি কোনো কমবয়েসী মহিলা ছিলেন না। বরঞ্চ বয়েসে হুজুর (সঃ) থেকে ছিলেন অনক বড়। হুজুর (সঃ)-এর নবুওয়াত লাভের কালে তাঁর বয়েস ছিল পঞ্চান্ন বছর। এরূপ একজন বয়স্কা, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারীণী মহিলা যিনি বিগত পনেরটি বছর স্বামী হিসেবে আড়ালবিহীন নিকট থেকে তাঁকে দেখেছেন, স্বামীর কোনো দোষক্রটি তাঁর কাছে গোপন থাকতে পারে না। কোনো পার্থিব উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে স্ত্রী স্বামীর না-জায়েয কাজে শরীক হতে পারে বটে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই একথা মানতে পারেন না যে, ইনি নবী হতে পারেন কিংবা তাঁর নবী হওয়া উচিত। পক্ষান্তরে হযরত খাদীজা (রাঃ) হুজুর (সঃ) -এর প্রতি এতো অধিক বিশ্বাসী ও মুতাকিদ ছিলেন যে, তিনি যখন নবুওয়াত লাভের ঘটনা তাঁর নিকট বর্ণনা করেন, তখন একটি মুহূর্ত পর্যন্ত চিন্তা না করে দ্বিধাহীন চিত্তে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর নবুওয়াতকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
হযরত যায়েদ (রাঃ)
একেবারে নিকট থেকে যারা তাঁকে জানতেন, তাদেঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রাঃ) একজন গোলাম হিসেবেন হুজুর (সঃ) এর সংসারে তাঁর আগমন ঘটে। পনের বছর বয়েসে তিনি এ ঘরে আসেন। হুজুর (সঃ) -এর নবুওয়াত প্রাপ্তিকালে তাঁর বয়স ছিলো ত্রিশ বছর অর্থাৎ গোটা পনেরটি বছর হুজুর (সঃ) এর ঘরে থেকে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ থেকে হুজুর (সঃ) কে দেখার ও বুঝার সুযোগ তাঁর হয়েছে। হুজুর (সঃ) সম্পর্কে তাঁর ধারণা একটা ঘটনার মাধ্যমে আরো পরিস্কার হয়ে ওঠে। ঘটনাটা হচ্ছে, ছোট বেলায় পিতা-মাতা থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। ভাগ্য তাকেঁ হুজুর (সঃ) পর্যন্ত পৌছে দেয়। তাঁর বাপ-চাচারা যখন জানতে পারলো আমাদের সন্তান অমুক স্থানে গোলামীর জীবন যাপন করছে, তখন তারা মক্কায় এলো। এটা হচ্ছে হুজুর (সঃ) –এর নবুওয়াত লাভের আগেকার ঘটনা। তারা এসে হুজুর (সঃ)–কে বললোঃ
‘আমাদের ছেলেটাকে যদি আযাদ করে দেন, তবে এটা আমাদের প্রতি বড়ই মেহেরবাণী হবে’।
তিনি বললেনঃ ‘আমি ছেলেকে ডাকছি। সে যদি আপনাদের সাথে যেতে চায় তবে আমি তাকে আপনাদের সাথে রওয়ানা করিয়ে দেবো। আর সে যদি আমার কাছে থাককত চায়, তবে আমি এমন লোক নই যে, কেউ আমার কাছে থাকতে চাইবে আর আমি জোরপূর্বক তাকেঁ দূরে ঠেলে দেবো’।
তাঁর এ জবাবে তারা বললো, আপনি বড়ই ইনসাফের কথা বলছেন। আপনি যায়েদকে ডেকে ব্যাপারটা জেনে নিন। তিনি যায়েদকে ডেকে পাঠালেন। যায়েদ যখন সামনে উপস্থিত হলো, হুজুর আরাম (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এ লোকদের চেনোঃ
যায়েদ বললেনঃ ‘জী-হ্যাঁ! এরা আমার আব্বা এবং চাচা’।
হুজুর (সঃ) বললেনঃ ‘এরা তোমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। তুমি যতদূর যেতে চাও আনন্দের সাথে যেতে পারো’।
তাঁর পিতা এবং চাচাও একই কথা বললঃ আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। জবাবে হযরত যায়েদ বিন হারেছা বলণলনঃ ‘আমি এ ব্যক্তির মধ্যে এমন সব সুন্দর গুণাবলী দেখেছি, যা দেখার পর আমি তাকেঁ ছেড়ে বাপ-চাচা এবং আত্মীয় স্বজনের নিকট ফিরে যেতে চাই না’।
হুজুর (সঃ) –এর সম্পর্কে এ ছিলো তাঁর খাদেমের সাক্ষ। একজন মনিবের প্রতি তার খাদেম কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে। কিন্তু এতো বেশী ভক্ত ও অনুরক্ত হতে পারে না যে মনিবের প্রতি ঈমান আনবে। ঈমান আনার জন্যে মনিবের মধ্যে এমন উন্নত স্বভাব, সদাচার, পবিত্রতা এবং উচ্চ নৈতিক পরিত্রের প্রকাশ ঘটতে হবে, যা দেখে খাদেম যেনো দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয় যে, আমার মনিব সত্যিই নবী। একথাও মনে রাখতে হবে যে, হযরত যায়েদ কোনো মামুলী যোগ্যতার অধিকারী লোক ছিলেন না। মদীনায় রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কায়েম হবার পর তাকেঁ বহু যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। হুজুর (সঃ) –এর চরিত্র সম্পর্কে এসাক্ষ্য এমন যোগ্য ব্যক্তিরই সাক্ষ্য।
হযরত আবুবকর (রাঃ) নবুওয়াত লাভের বিশ বছর পূর্ব থেকে একজন প্রগাঢ় বন্ধু হিসেবে হুজুর (সঃ)–কে দেখার এবং জানার সুযোগ পেয়েছেন। তাদেঁর বন্ধুত্ব ছিলো, তাদেঁর একজন ছিলেন মুহাম্মদ (সঃ) এবং অপরজন আবুবকর (রাঃ) একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুকে খুবই পসন্দ করে থাকেন। মনের কথা তার কাছে বললেন, কিন্তু এমন ভক্ত কখনো হতে পারে না যে, তাকেঁ নবী বলে মেনে নেবেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) কর্তৃক নির্দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের স্বীকৃতি দান একথার প্রমাণ করে যে, কুড়ি বছরের সুদীর্ঘ সময়ে তিনি হুজুর (সঃ) –কে পবিত্র চরিত্র, সুউচ্চ স্বভাব ও আচরণের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পেয়েছিলেন। তবেই তো তিনি নির্দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং ঘোষণা করেন, এমন উন্নত স্বভাব চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি অবশ্যই নবী হইতে পারেন এবং তাঁর নবী হওয়া উচিতও বটে।
হযরত আলী (রাঃ)
হযরত আলী (রাঃ) –এর নাম আমি প্রথমে এজন্যে উল্লেখ করিনি যে, তখন তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) –এর ঘরেই প্রতিপালিত হয়েছেন। কিন্তু দশ বছরের বালকও যে ঘরে থাকে, যার কাছে থাকে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সেও ওয়াকিফহাল থাকে। বিশেষ করে হযরত আলীর মতো মেধাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি কম বয়সে হলেও তাঁর নবুওয়াতকে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি তাঁর স্নেহ, সীমাহীন পবিত্র চরিত্র এবং সুউচ্চ স্বভাব ও মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন।
আমলে সালেহ সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সমূহ দ্বারা একথা পরিষ্কার হলো যে, কোনো ব্যক্তি যে জিনিসের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, তার জীবনটাকেও হুবহু সে দাওয়াতের মাপকাঠিতে তৈরী করতে হবে, তার ব্যক্তি জীবন হতে হবে তার দাওয়াতের বাস্তব সাক্ষ্য ও প্রতিচ্ছবি। তাকে এমন পূত চরিত্র, উচ্চ সআবভাব ও আচরণের অধিকারী হতে হবে-দাওয়াত ইলাল্লাহর আওয়াজ নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হলে যেনো তার কথায় লোকেরা প্রভাবিত হয় এবং তার আমল যেনো তার দাওয়াতের সাক্ষ্য বহন করে আর মানুষ যেনো একথা স্বীকার করে নেয় যে, এ ব্যক্তি কথা সত্য না হয়ে পারে না। লোকেরা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করুক আর না-ই করুক, কিন্তু তারা যেনো একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, এ ব্যক্তি যা কিছু বলছে, আন্তরিকতার সাথেই বলছে, এ মতবাদ, এ নীতি ও দাওয়াতই তার জীবন বিধান। এ জন্যেই রাসূলে করিম (সঃ) –এর নিকটতম দুশমন আবু জেহেলও একবার বলেছিলোঃ
“হে মুহাম্মদ (সঃ)! আমরা তো তোমাকে মিথ্যা বলছি না। আমরা তো ঐ দাওয়াতকে মিথ্যা বলছি যা তুমি নিয়ে এসেছো”।অর্থাৎ নিকৃষ্টতম দুশমনও তাঁর সত্যবাদিতার প্রবক্তা ছিলো। এটাই হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা, স্বভাব ও আচরণের উচ্চতা।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছেঃ
...এবং সে ঘোষণা করে আমি একজন মুসলামান।
একথার তাৎপর্য বুঝার জন্যে মক্কার মুয়াযযমার সেই পরিবেশকে সম্মুখে রাখতে হবে যা আমি প্রথমে উল্লেখ করেছি। নবুওয়াতের সে অধ্যায়ে কোনো ব্যক্তিরি এ ঘোষণা দেয়া যে ‘আমি একজন মুসলমান’ সহজ ও মামুলি ব্যাপার ছিলো না। বরং এটা ছিল হিংস্র পশুদেরকে নিজের উপর হামলা করার আহ্বানের নামান্তর। বাস, এখেন সত্য দ্বীনের দাওয়াত দানকারীর এ বৈশিষ্ট্য পরিস্কার হলো যে, তিনি কেবলমাত্র আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীই নন, কেবলমাত্র পবিত্র আমলের অধিকারীই নন, বরং তিনি নিকৃষ্টতম শত্রুদের সম্মুখে এবং চরম বিরুদ্ধবাদী পরিবেশেও নিজের মুসলমান হবার কথা অস্বীকার করেন না, লুকিয়ে রাখেন না। নিজের মুসলমান হবার কথা স্বীকার করতে এবং তার ঘোষণা দিতে কোনো লজ্জা, সংকোচ ও ভয় ভীতির পোয়া করেন না। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দেন, ‘হ্যাঁ, আমি মুসলমান, যার যা ইচ্ছা করুক’। অন্য কথায় দ্বীনে হকের দাওয়াত দাকারীর একটি দুরুত্বপূর্ণ গুণ এটা হতে হবে যে, তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও বাহাদুর ব্যক্তি হবেন। আল্লাহর পথে ডাকা কোনো ভীরু কাপুরুষের কাজ নয়। সামান্য চোটেই যে ভেঙ্গে পড়ে, এমন ব্যক্তি কখনো মানুষকে আল্লাহর পথি ডাকতে পারে না। ঐ ব্যক্তি খোদার পথে মানুষকে ডাকার যোগ্যতা রাখে, যে কঠিনতম শত্রুতার পরিবেশ, বিরুদ্ধতার পরিবেশ এবং মারাত্মক বিপজ্জনক পরিবেশেও ইসলামের ঝান্ডা নিয়ে দণ্ডায়মান হবার সৎসাহস রাখে এবং পরিনামের কোন পরোয়াই করে না। হুজুর (সঃ) স্বয়ং এরূপ বাহাদূরীর বাস্তব ও পরিপূর্ণ নমুনা ছিলেন। মক্কার ঘোরতর পরিবেশে তিনি প্রকাশ্যে দাওয়ত পেশ করেছেন। সত্যের সাক্ষ্যর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেই সব লোকদের মধ্যেই এ আন্দোলনকে জারী রেখেছিলেন, যারা ছিলো তাঁর খুনের পিয়াসী এবং যারা তাকেঁ, তাঁর সাহাবীদেরকে চরম অত্যাচার ও নির্যাতনে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেনি। এ ঘোরতম বিরুদ্ধতা, নির্যাতন ও মুসীবতের পরিবেশেও তিনি একাধারে তের বছর যাবত দাওয়াত পেশ করেছিলেন। অতঃপর মদীনায় পৌঁছার পর যে পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যেসব ভয়াবহ লড়াইর সম্মুখীন হতে হয়, তাতেও তাঁর কদম কখনো পিছে হটেনি। হুনাইনের যুদ্ধে মুসলমানরা যখন পরাজয়ের যখন পরাজয়ের প্রায় মুখোমুখি হয়ে পড়ে, হুজুর (সঃ) স্বয়ং তখন যুদ্ধের ময়দানে কেবল নিজস্থানে শুধু অটলই ছিলেন না বরং সম্মুখে শত্রুদের সারির দিকে অগ্রসর হছ্চিলেন এবং তিনি যে কে সে কথাও গোপন রাখেন নি। তিনি বলছিলেনঃ
“মিথ্যার লেশ নেই আমি নবী মহা-সত্য জেনে রাখো আমি আদুল মুত্তালিবের পৌত্র”।
এ ঘোষণা তিনি ময়দানে জং-এর এমন পরিবেশে দিচ্ছিলেন, যখন তিনি শত্রুদের ছোবলের আওতায় অবস্থান করছিলেন এবং সাথে মাত্র ২/৩ জন সাথীই বাকী ছিলো। সে সময়ও তাঁর ‘আমি নবী’ এ ঘোষণা দ্বারা পরিস্কাভাবে বুঝা যায়-দা’য়ী ইলাল্লাহকে এমনিই সাহসী ও বাহাদুর হতে হবে। যদি দাওয়াত দানকারী হিম্মৎ দৃঢ়তা ও বাহাদুরীর মতো গুণাবলীর অলংকারে ভূষিত না হয়, তবে সে এ পথে পা বাড়াবার যোগ্যতাই রাখে না। যদি পা বাড়ায়ও তবে সে তার ভীতি ও দুর্বতার কারণে উল্টো গোটা আন্দোলনেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ কথাকটাই আমি আপনাদের সামনে রাখলাম। এ কথাগুলো সম্পর্কে যদি চিন্তা করা হয়, তবে পরিস্কারভাবে বুঝা যাবে যে, স্বয়ং এ কথাকটাই আল্লাহর পথে দাওয়াত দানের একটা গোটা কর্মসূচী। এ অনুযায়ী যে কোনো স্থানে যে কোনো পরিবেশে কাজ করা সম্ভব।
দায়ী ইলাল্লাহ দাওয়াত ইলাল্লাহ বইয়ের ৫-১১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন