বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ পড়ুন, গঠনমূলক সমালোচনা করুন। জাযাকুমুল্লাহ
০১. আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ। তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত প্রায় একশত কিতাবের লিস্ট আমার কাছে ছিল। আল্লামা তাকি উদ্দিন সুবকী রহ. একাই সাতটি কিতাব লেখেন।
বড় ইমামদের তাদের পড়াশোনার গভীরতা ও চিন্তার বিস্তৃতির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামদের মতের বাহিরে গিয়ে তারা কিছু মতামত দিয়ে থাকেন৷ এগুলোকে তাফাররুদাত বা একক মত বলা হয়।
এমন উদাহরণ প্রচুর।
আমাদের নিকটবর্তী মনীষী ও আলেমদের থেকেও এমনটা হতে পারে। যেমন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. রমজান মাসে সবাইকে ডেকে এনে তাহাজ্জুদ পড়তেন। তাদায়ীর সাথে এমনভাবে নফল সালাতের জামাত হানাফি এবং দেওবন্দি মাসলাকের খেলাফ। মুফতি শফী রহ. এর নির্দেশ মাওলানা তাকী উসমানী সাহেব এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রবন্ধ লেখেন। যা ফাতাওয়া উসমানীতে ছাপা হয়েছে।
তাফাররুদাতের কারণে কোনো ইমামকে অভিযুক্ত করা যায় না। এবং এ কারণে তাঁর অন্যান্য খেদমতও বাতিল হয় না। তাফাররুদাত সত্ত্বেও আপন খেদমতের কারণে তাঁরা ইতিহাসে একটা স্থান দখল করে রাখেন।
০২. একজন ব্যক্তির চেয়ে একাধিক ব্যক্তির চিন্তা বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ দেখুন চার মাযহাবের মধ্যে হানাফি মাযহাব একটু বেশি শক্তিশালী এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম এই মাযহাবের অনুসারী। এর একটি বড় কারণ হল, এই মাযহাবের মাসায়েল প্রণয়নে যুগে যুগে যেসব ইমাম কাজ করেছেন তাদের সংখ্যা অন্য মাযহাবের তুলনায় অনেক বেশি। যে কারণে হানাযি মাযহাবে এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা রয়েছে, যেসব বিষয়ে অন্য মাযহাবে কোনো আলোচনাই হয়নি। জুযইয়াত তথা শাখাপ্রশাখার বিস্তৃতির মূল কারণ অনেক ইমামের ইজতিহাদ ও গবেষণা।
মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ এর সাথে যেসব আলেম কাজ শুরু করেছিলেন তাদের অনেকে বেরিয়ে যান। মাওলানার সাথেও ছিলেন অনেকে এবং পরেও অনেকে যুক্ত হয়েছেন। যারা ছিলেন এবং যারা পরে তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছেন, সবমিলিয়ে গবেষক ও আলেমদের সংখ্যা ওলামায়ে দেওবন্দের ধারেকাছেও না।
আরেকটা বিষয় হল, মাওলানা মওদুদী রহ. এবং তাঁর সাথে যারা ছিলেন তাদের মাঝে ফকিহ এবং শরিয়া-বিশেষজ্ঞ আলেমের সংখ্যা কম।
স্বয়ং মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ একজন চিন্তাবিদ, গবেষক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শক্তিমান লেখক, সাংবাদিক এবং সংগঠক ছিলেন; কিন্তু তাকে একজন বড় মাপের ফকিহ ও উসুলবিদ ধরা যায় না। রাসায়েল মাসায়েল ছাড়া ফিকহ, ফাতাওয়া এবং ইজতিহাদ সম্পর্কে তাঁর তেমন কোনো কাজ নেই। এবং কোনো প্রতিষ্ঠানে ফিকহ পড়ানওনি, যে কারণে তাঁকে একজন বড় মাপের ফকিহ ধরা যায়।
আর শরিয়তের কোনো বিষয় জানতে হলে ফকিহের ফয়সালা গৃহীত হয়।
মোটকথা, মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গী ফকিহ ছিলেন কম; বিপরীতে ওলামায়ে দেওবন্দের বড় মাপের ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের একটি দল মাওলানা মওদুদী সাহেবের বিচ্যুতি তুলে ধরেছেন।
এখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ও সাধারণ আলেমদের জন্য সেসব বিতর্কিত বিষয়গুলো আদ্যোপান্ত পড়া এবং সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা মুশকিল। কারণ, তাদের সবগুলো কিতাব পড়া এবং সেগুলোর ব্যাপারে ফয়সালা করা যোগ্যতার দরকার এবং অনেক সময় প্রয়োজন।
একারণে নিরাপদ হল, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের ফয়সালাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া এবং মাওলানা মওদুদী সাহেবের বিচ্যুতিগুলোকে বিচ্যুতিই মনে করা।
তাঁর বিচ্যুতির কারণে তাঁর অসামান্য খেদমত আপন জায়গায় ঠিক থাকবে এবং বিচ্যুতিগুলোকে তাফাররুদাত মনে করতে হবে। যেমন বড় বড় ইমামদের তাফাররুদাত ছিল।
০৩. এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য, তা হল : ওলামায়ে দেওবন্দ মাওলানার যেসব ভুল ধরেছেন সেগুলোকে আরেকটু সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা যায় এবং ব্যাখ্যা করে সঠিকও বলার সুযোগ থাকতে পারে। এজন্য বিজ্ঞ আলেমগণ আবারও মূল কিতাবগুলো সামনে রেখে গবেষণা করতে পারেন। গবেষণার জন্য সময় এবং অর্থ দরকার।
বাংলাদেশের ইসলামের স্বার্থেই এ কাজটা হওয়া দরকার। উভয়পক্ষ আরও সহনশীল ও আন্তরিক হলে আশা করা যায় দূরত্ব কমানো সম্ভব।
০৪. কোনো দল (রাজনীতির দল না) বা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হকপন্থী হলে ওই সংগঠনের সবলোক হকপন্থী হওয়া আবশ্যক নয়, তারা বাতিলও হতে পারে; এবং তাদের মাঝে হকের সাথে সাথে কিছু বাতিল বিষয়ও থাকতে পারে। যেমন আজকের তাবলীগ জামাতের কথাই ধরুন। তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তী মুরুব্বিগণ হকের পক্ষে ছিলেন; কিন্তু ধীরে ধীরে তাবলীগের মাঝে বিচ্যুতি প্রবেশ করতে থাকে। এসব বিচ্যুতির দায়ভার কি মাওলানা ইলিয়াসের? মাওলানা যাকারিয়ার?
রাহিমাহুমুল্লাহ
অর্থাৎ কোনো দলের হক ও বাতিল নির্ণীত হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি প্রতিষ্ঠাতা নয়; বরং দলের লোকদের আকিদা ও আমল আখলাকের ওপর নির্ভর করে। শেখ মুজিবের সব বিশ্বাস কি আওয়ামীলীগের সব লোকের? জিয়ার সব বিশ্বাস কি বিএনপির সব লোকের?
মাওলানা মওদুদীর বিতর্কিত আকিদার একটা লিস্ট করুন, তারপর সেগুলো জামায়াতের একশত লোককে জিজ্ঞেস করুন, দেখুন কয়জনে সেগুলো জানে৷ কারণ, মওদুদী সাহেবের সমালোচিত বিষয়গুলো বেশ উচ্চাঙ্গের।
০৫. ওলামায়ে দেওবন্দ মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে কলম ধরেছেন ইসলামের কারণে। ইলমী আমানত রক্ষার জন্য। যারা বলেন রাজনৈতিক কারণ, তাদেরকে আমি জাহিল নয়তো মাজুর মনে করি। তারা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখে এসব বলতেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এগুলো রাজনৈতিক বিষয় না। ডাক্তার জাকির নায়েক ও আহলে হাদিসের বিষয়ে ওলামায়ে দেওবন্দের সমালোচনাও কি রাজনৈতিক?
০৬. যারা সমালোচনা করেছেন তারাও অত্যন্ত আদবের সাথে মাওলানা মওদুদীর নাম নিয়েছেন। আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. কিতাব লেখেন : আল উস্তায আল মওদুদী : শুযুযুহু ওয়া আখতাউহু নামে। এখানে তো তিনি মাওলানা মওদুদীকে আল উস্তায বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশী কিছু পুচকে পোলাপান মিস্টার মওদুদী বলে বেড়ায়। আফসোস।
০৭. বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জামায়াতের এগিয়ে যাওয়ার কারণ হল দুইটি : ক. কওমিদের বিচ্ছিন্নতা, পশ্চাদপদ চিন্তা, অনৈক্য, ভুল কর্মপন্থা নির্ধারণ, নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে না পারা ইত্যাদি।
খ. জামায়াতে ইসলামী সঠিক, সুচিন্তিত সুদূরপ্রসারী ও যুগোপযোগী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পেরেছে, নিজেদের ঐক্য নিশ্চিত করেছে, কঠোর পরিশ্রম করেছে, যুগোপযোগী কাজ করেছে, ইত্যাদি।
তাদের এ সাফল্য ও অগ্রগতির পেছনে মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহর কোনো কারিশমা নেই। তাই হলে ভারত ও পাকিস্তানে জামায়াতের অবস্থান নড়বড়ে হতো না।
০৮. মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ ইখওয়ানী ধারার লোক। সাইয়েদ কুতুব ও হাসানুল বান্নাদের দ্বারা প্রভাবিত। এবং বলা চলে জামায়াত ইখওয়ানের ফটোকপি।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, জামায়াত ও মওদুদী নিয়ে এত সমালোচনা হলেও ইখওয়ানকে পছন্দ করে। তার মানে হল, শাখা অপছন্দ হলেও মূল পছন্দ। এটা কি ইনসাফ?
জামায়াতকে অপছন্দ করলে ইখওয়ানকেও করেন। মওদুদীকে অপছন্দ করলে সাইয়েদ কুতুবকেও অপছন্দ করেন।
এটাই তো ইনসাফের কথা।
০৯. ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভিন্ন রাষ্ট্র। প্রত্যেক রাষ্ট্রের অবস্থা বিবেচনা করে ইসলামপন্থীদের কর্মপন্থা নির্ধারণ উচিত।
ভারতে সকল মুসলমান একসাথে মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড গঠন করেছেন।
পাকিস্তানে জামায়াতের সাথে কওমি আলেমদের রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে।
আন্তজার্তিক অঙ্গনে মাওলানা তাকী উসমানী সাহেবরা ভিন্ন মত ও পথের গবেষকদের সাথে কাজ করেছেন, করছেন; তো আমরা কি তাদেরকে অনুসরণ করতে পারি না?
১০. আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জামায়াতের মূল সমস্যা মাওলানা মওদুদীর অনুসরণ না। তাদেরকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, আরও বিস্তৃত অঙ্গনে দীনি খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য এবং বাংলাদেশী মুসলমানদের মাঝে বৃহৎ ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে নতুন কর্মপন্থা ঠিক করা দরকার। কর্মপন্থা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
১১. আমার মতো কিছু লোক হচ্ছে নির্বোধ টাইপের। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। বিবেকের তাড়নায় টুকটাক লিখি, বলি। ফায়দা হোক না হোক পরের বিষয়। লেখালেখির কারণে শত্রু বাড়বে, শুভাকাঙ্ক্ষী কমবে জেনেও লিখি। নিজ ঘরানার কাছেই পর হয়ে যাবো।
১২. বাংলাদেশের মানুষের মাঝে হিলম বা সহনশীলতা খুব কম। অতি সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়৷ সবার মাঝেই এই দোষটা আছে। সহনশীল না হলে, অন্যের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা না থাকলে মুসলমানদের সেবা করবেন কীভাবে?
১৩. বর্তমান সরকার জামায়াতের ওপর ক্ষিপ্ত ভিন্ন কারণে। তাদের সাথে সুর মিলিয়ে জামায়াতের সমালোচনা করা অন্যায়৷
১৪. ইসলামবিরোধী শক্তি সবসময় ইসলামপন্থীদের মাঝে অনৈক্য দেখতে চায়। কারণ, বাংলাদেশের সকল ইসলামপন্থী একজোট হয়ে গেলে তাদেরকে মাইনাস করে এককভাবে কেউ ক্ষমতায় যেতে পারবে না৷
মোটকথা, মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহর প্রতি ইনসাফ করা হোক।
জামায়াত ইনসাফ করবে, তাঁর বিচ্যুতিগুলোকে তাফাররুদাত মনে করে এড়িয়ে যাবে।
আর দেওবন্দি ওলামায়ে কেরাম গঠনমূলক আলোচনা করবেন ইনসাফ ও সম্মানের সাথে। এবং এই বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাদের সাথে একসঙ্গে কাজ করা যায়।
( Muhtaram Mohiuddin Kashemi)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন