অবশেষে ফিলিপাইনের মুসলিম জনপদ মিন্দানাও দ্বীপে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হলো। সব কিছু ঠিক থাকলে ফিলিপাইনের মরো মুসলিম এলাকায় দীর্ঘ ৫০ বছরের সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। অবসান হবে নিরন্তর রক্তপাত ও হানাহানির। সম্প্রতি মরো মুসলমানদের আইনগত ও ভৌগলিক স্বায়ত্তশাসন দিয়ে আইন পাস করেছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। ইতোমধ্যে ‘বাংসোমোরো অর্গানিক আইন’ অনুমোদনের যাবতীয় কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে। দুতার্তে এই আইনে স্বাক্ষর করায় মিন্দানাও দ্বীপে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৫০ বছর মিন্দানাওয়ে সঙ্ঘাতের ফলে এক লাখ ৫০ হাজার মুসলমান নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মাল-সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ‘বাংসোমোরো অর্গানিক আইন’-এর বাস্তবায়ন সম্ভব হলে প্রকৃত অর্থে সেখানকার মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের বিজয় সাধিত হবে।
কী আছে ‘বাংসামোরো আইনে’
‘বাংসোমোরো’ ফিলিপাইনি শব্দ। এর অর্থ ‘নেশন অব দ্য মরো’ বা ‘মরো জাতির দেশ।’ মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল খ্রিষ্টান ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষের সাথে। সরকার এতদিন ধরে মিন্দানাওকে নামমাত্র স্বায়ত্তশাসন দিয়ে রেখেছিল। দ্বীপ শাসন করত কেন্দ্র থেকে। মুসলমানরা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। বর্তমান যে আইন তৈরি হয়েছে, তার শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এর সূত্র ধরে বর্তমান প্রয়াসটি আইনের অবয়ব ধারণ করেছে। এই আইনের ফলে শান্তিচুক্তির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শর্ত বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন স্বায়ত্তশাসন আইন বাস্তবায়িত হলে ‘বাংসোমোরো’ সরকার নিজেরাই একটি সংসদ বা পার্লামেন্ট চালাতে পারবে। সরকার তার স্থানীয় রাজস্ব থেকে বড় অংশ তার এলাকার উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারবে। তবে রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে নিয়মিত প্রদান করতে হবে। তা ছাড়া মিন্দানাও অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ তার নিজস্ব কর্তৃত্বে থাকবে। ‘বাংসোমোরো’ সরকার এই অঞ্চলের বিচারব্যবস্থায় ইসলামি আইনের প্রয়োগও করার ক্ষমতা লাভ করবে। তবে শর্ত হচ্ছেÑ স্বায়ত্তশাসনের বদলে ‘বাংসোমোরো’ সরকারকে মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের হাজার হাজার যোদ্ধার বাহিনীকে ভেঙে দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলোÑ ‘বাংসোমোরো’ আইনের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য দেশে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এটি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠানের আশা করা হচ্ছে। আর গণভোটে জয়লাভের পরই আইনটি কার্যকর করা হবে। ফলে গণভোট পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।
ফিলিপাইনে ইসলাম ও মুসলমান
ফিলিপাইনে মুসলমানরা ধর্মীয় বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটিতে ইসলামের প্রথম আগমন ১৩১০ সালে। আরবের ব্যবসায়ী এবং সুফি সাধকের মাধ্যমে ফিলিপাইনের সুলু ও জুলু দ্বীপে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে ‘তুয়ান মাশায়েখের’ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সুলু দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এখানকার গোত্রপ্রধানের কন্যাকে বিয়ে করেন। ফলে সমাজে তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছেলেমেয়েদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। তারা মিলে ইসলামের কাজে আত্মনিয়োগ করায় ধীরে ধীরে সুলুতে ইসলামের প্রসার ঘটে। ক্রমে জুলুসহ অন্যান্য দ্বীপেও ইসলামের বিস্তার ঘটে। ১৩৪০ সালে মালয় থেকে ‘করিমুল মাখদুম’ নামের এক দরবেশ সুলু দ্বীপে আগমন করেন। তার উদ্যোগে মিন্দানওয়ের সুলুতে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। এটি ফিলিপাইনের ও প্রথম মসজিদ। চতুর্দশ শতাব্দীতে সুমাত্রা দ্বীপ থেকে রাজা রাগুইন্দারের নেতৃত্বে একটি নৌবহর জুলু দ্বীপে আগমন করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই নিজেকে সুলুর মুসলমানদের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
ক্রমেই সুলুতে ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং সেখানে সুলু সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিন্দানাও দ্বীপেও ইসলামের প্রসার ঘটে। পরবর্তীকালে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ও পারস্য থেকে মুসলমানরা ফিলিপাইনে গমন করেন। এভাবে ফিলিপাইনে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুসলমানদের দ্রুত উত্থান দুশমনদের কাছে অসহ্য বলে মনে হলো। ফলে ১৫৭৮ সালে স্পেন ফিলিপাইনের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫৯৬ সালে মিন্দানাওয়ের স্পেনীয় শাসক মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। পরবর্তীকালে ডাচ ও স্পেনীয় শাসকরা যৌথভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে ১৬৩৭ সালে মিন্দানাও এবং ১৬৩৮ সালে সুলুর পতন ঘটে। তারপর ফিলিপাইনে কায়েম হয় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। ১৯৪৯ সালে ফিলিপাইন স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পরপরই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি ওঠে। ফলে ম্যানিলা সরকারের সাথে মুসলমানদের সঙ্ঘাত শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে তা সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয়।
মরো মুক্তি আন্দোলন : পেছন ফিরে দেখা
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে মরো মুসলমানরা স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭২ সালে উচ্চশিক্ষিত নেতা নূর মিশৌরির নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’। এরপর মরো মুসলিম আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সরকারও মুসলমানদের দমন করার জন্য চালায় অত্যাচারের স্টিমরোলার। ফলে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক মুসলমানের মৃত্যু ঘটে। সরকার স্বাধীনতাকামীদের দমন করার জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করে। সরকারের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে স্বাধীনতাকামীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালে হাশিম সালামাতের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট।’ ১৯৯৬ সালে নূর মিশৌরি ম্যানিলা সরকারের সাথে এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে মিন্দানওয়ের চারটি অঞ্চলে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নূর মিশৌরি সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মরো মুসলমানদের দ্বিতীয় সশস্ত্র গ্রুপ ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’ নূর মিশৌরির সাথে একমত না হয়ে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখে। এমআইএলএফের সৈন্যসংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ হাজার। মিন্দানাওয়ের এই স্বায়ত্তশাসন প্রক্রিয়ায় ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
বাংসোমোরো আইন নিয়ে প্রতিক্রিয়া
মিন্দানাওয়ের স্বায়ত্তশাসন আইনে দুতার্তে স্বাক্ষর করায় মরো মুক্তি আন্দোলনের নেতারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এমআইএলএফের সেকেন্ড-ইন কমান্ড গাজালি জাফর বলেন, ‘এই আইন হয়তো সর্বোৎকৃষ্ট আইন নয়, কিন্তু সূচনা হিসেবে এটা ভালো। আল্লাহ চাইলে আমরা এই সরকারের সাথে আছি এবং আমাদের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে আমরা কাজ করব।’ মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম মুরাদ বলেন, ‘আমি আশা করি, বর্তমান আইনের ফলে আমাদের আন্দোলনরত সব দল স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসবে এবং এই এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।’ জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংসামোরো আইনকে স্বাগত জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি একটি মাইলফলক। এতে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো।’ মিন্দানাওয়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে উচ্ছ্বাস। তারা এটাকে দেখছেন শান্তির পক্ষে একটি বড় বিজয় বলে। মরো আন্দোলনের ৬১ বছর বয়স্ক এক যোদ্ধা নাসের সালমান তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘এটি একটি স্বপ্ন। আমি মনে করি, আমরা যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারি, তা হলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব।’
মিন্দানাওয়ের স্বায়ত্তশাসন আইন নিঃসন্দেহে ফিলিপাইন সরকার ও মিন্দানাওয়ের জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মিন্দানাওয়ে ফিরে আসবে শান্তি। ৫০ বছর ধরে এই এলাকার মানুষের জীবনে যে দুর্বিষহ অনাচার ও রক্তপাতের দুঃসহ যন্ত্রণা চলছিল তার অবসান হবে। ফলে মিন্দানাওয়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য।
Daily Nayadigantaদেশ মহাদেশ
ইকবাল কবীর মোহন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন