বাংলাদেশ বার্তাঃ ‘স্মৃতি ও ঐতিহ্যে বহমান বাংলা’র জনপ্রিয় লেখক আবদুল হামিদ মানিকের ’চলতে চলতে দেখা’ বইটি ২০০৩ সালে বেরিয়েছে। ২০০১ সালে বের হয় তার ‘সিলেটে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি’।২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে রবার্ট লিন্ডসের বইয়ের অনুবাদ ‘সিলেটে আমার বারো বছর’।
আবদুল হামিদ মানিক অন্তর্ভেদী সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। সুবক্তা হিসেবেও তার সুনাম সাংবাদিকতার সমান্তরালেই বহমান। তার বক্তব্য পরিশীলিত ও আধুনিক রুচিঋদ্ধ।উচ্চারণও চমৎকার। তার লেখা ও কথায় আকর্ষণ অফুরন্ত। প্রাণ সঞ্চারক। সূর্যালোকের মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। তার মনি-মুক্তার ভান্ডার থেকে যতই আহরণ করা হোক না কেন তা অপরিমেয়ই থেকে যাবে।
বিশ শতকের ৭ম দশক আবদুল হামিদ মানিকের উত্থানের যুগ। প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরীর অসাধারণ প্রতিভা ব্যাপ্তি স্মরণে রেখেও আবদুল হামিদ মানিকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করতে পারি। দৈনিক জালালাবাদে তার সাথে কাজ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বিস্মিত হতাম। তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন তাৎক্ষণিকভাবে।চলমান ঘটনাবলির সাথে ইতিহাসের অনেক তথ্য উপাত্ত স্মৃতি থেকে লিখতেন।বইপত্র ঘাটিয়েও তাতে কোন ভুল আবিষ্কার করা যায়নি। তিনি এক বিস্ময়কর প্রতিভা।
সত্তর দশকে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিলেটি লেখকদের মধ্যে গণমানুষের কবি দিলওয়ার, প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরী ও কবি মোফাজ্জল করিম ছিলেন ধ্রুব তারার মতো। আশির দশকে আমরা যখন নতুন লেখিয়ে, তখন রাগিব হোসেন চৌধুরী, আব্দুল হামিদ মানিক, কালাম আজাদ, শাকুর মজিদ, পীর হাবিব, সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী, তমিজ উদ্দিন লোদী, নিজাম উদ্দিন সালেহ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার সহ সিলেটের বেশ কিছু কবি-সাহিত্যিক জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত ও সমাদৃত।
আমি তখন একেবারেই তরুণ। শুরুতেই সংলাপের সাথে সম্পৃক্ত হই। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের কারণে অগ্রজের সাথে কাজ করতে হয়। প্রবীণেরা আমাকে অধিক ভালোবাসতেন। শিক্ষাবিদ মুসলিম চৌধুরী, ভাষা সৈনিক শাহাদত খান, সাংবাদিক-কলামিস্ট বোরহান উদ্দিন খান, গবেষক-অধ্যাপক আসাদ্দর আলী সহ অনেক প্রবীণের একান্ত সাহচর্য পেয়েছি এবং তাদের স্মৃতি ও ইতিহাসের অংশ হয়েছি।
নব্বই দশকে সিলেটের ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী সাহিত্য সংগঠন সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরী এবং আমি ছিলাম সেক্রেটারি জেনারেল। তখন প্রতি বছর নিয়মিত মাসিক সাহিত্য আসর ছাড়াও বছরে অন্তত দুটি বড় অনুষ্ঠান আমরা করেছি। আমাদের সাহিত্য আসরে অনেক নামীদামী লেখক অতিথি হয়ে আসতেন। কিন্তু আফজাল চৌধুরী ও আবদুল হামিদ মানিকের বক্তব্যই ছিল মূল আকর্ষণ।
১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে সংলাপের শরৎকালীন কবিতা পাঠের আসরে দেশের বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক অংশ গ্রহন করেন। অনুষ্ঠানের অতিথি খুলনা বিএল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী রফিকুল হক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর আলোচনায় আবদুল হামিদ মানিকের বক্তব্যের প্রশংসাই প্রধান ছিল।
সেদিন তার বক্তব্যের উপজীব্য বিষয় ছিল, আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ঘরে বাইরে শত্রু পরিবেষ্টিত। অনিকেত বৃত্তির বিরুদ্ধে যুব সমাজ আড়ষ্ট ও ম্রিয়মান। আজ এখানে কিছু সাহসী লেখক হিম্মৎ ও আশার বানী শোনালেন। অস্তিত্ব রক্ষা নয়, শির উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা জোগালেন। এদের প্রজ্ঞার কাছে স্লোগান সর্বস্ব তথাকথিত লেখক -সাংবাদিকেরা দাঁড়াতে পারবেনা। তখন সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংলাপের মতো ঐতিহ্যবাদী লেখক গোষ্ঠি এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।
সে দিন তিনি আরো বলেছিলেন, আমাদের এই ভূখন্ড উপমহাদেশের সাথে বৃটিশদের অধীনস্থ ছিল এবং উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এই দেশের তরুণ যুব সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল, আমাদের ধর্ম আমাদের জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির এক বড় উৎস্য ও প্রেরণা ছিল- এ সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করে আমাদেরকে ঔপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কলম সৈনিক হতে হবে।
আবদুল হামিদ মানিক দৃষ্টিতে ও সৃষ্টিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সমকালিন লেখক-সাংবাদিকদের মধ্যে তার এই পার্থক্য বিপুল, বিশাল। মানসে ও মনোভূমিতে এমনকি উচ্চারণে ও উপস্থাপনায়। এদেশের ভাষা, সাহিত্য ও কালচারের ক্ষেত্রে ইতিহাস চেতনার প্রয়োজনীয়তা তার লেখায় ও বক্তব্যে বার বার বিধৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি অনন্য সাধারণ ও আপষহীন।
সংলাপের সাহিত্য আসরে চেয়ারম্যান আফজাল চৌধুরী এবং প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হামিদ মানিকের মত দুই গুরুর প্রতি একসাথে আনুগত্য প্রকাশে আমরা হিমশিম খেতাম। তবে এক সময় প্রাজ্ঞ জহুরির মতো আফজাল চৌধুরী বুঝতে পেরেছিলেন, তার বিপুল সাহিত্য প্রতিভার বাইরে নতুন প্রতিভার উদয় হয়েছে এবং তিনি তার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেনই। আমাদের কাছে আফজাল চৌধুরীর এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়।
আবদুল হামিদ মানিক কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময় সংসদের নতুন ভবন সহ ব্যাপক আধুনিকায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তার সম্পদনায় সাহিত্য সংসদের মুখপত্র মাসিক আল ইসলাহ নতুন মাত্রা পেয়েছে।
আবদুল হামিদ মানিক আমাদের চৈতন্যের রূপকার, সামনে চলার প্রেরণা। যার অবিনাশী প্রতিবেদন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় অনাচার-অত্যাচার, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সুপ্ত চেতনার বিকাশ সাধনে তার অভিভাষণ সমূহ বর্তমান প্রজন্মের জন্য শিক্ষাপ্রদ ও উৎসাহব্যঞ্জক ।
সিলেটে সংবাদপত্র, সম্পাদক ও সাংবাদিকের সংখ্যা কম নয়। কিন্ত সম্পাদকীয় লেখার মতো লোকের অভাব সব সময় ছিল।এক সময় যুগভেরীতে সিনিয়র সাংবাদিক অজয় পাল ও মাহবুবুর রহমান নিজস্ব সম্পাদকীয় লিখতেন। চৌধুরী মমতাজ শ্যামল সিলেটে এবং আহমদ নূর সিলেট প্রতিদিনে সম্পাদকীয়তে নিজস্বতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। আবদুল হামিদ মানিক গত চার দশকে সাপ্তাহিক সিলেট কন্ঠ, সাপ্তাহিক সিলেট সমাচার, দৈনিক জালালাবাদী ও দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলামে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমানে দৈনিক সিলেটের ডাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণ তথা দারিদ্র্যপীড়িত, শোষিত-বঞ্চিত মানুষ তার লেখায় বিচিত্ররূপে বিধৃত হয়ে আছে। এ দেশবাসির আত্মপরিচয়, মানসচেতনা, জনজীবন, জাতীয় আশা-আকাঙ্কা ও সংগ্রাম সাধনার কথা অনবদ্যরূপে ও অনুপ্রেরণা সঞ্চারীরূপে প্রতিভাত হয়ে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন