বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানুষ শারীরিক-মানসিক যেসব জটিলতায় ভোগছেন তন্মধ্যে অনিদ্রা অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের মতে অনিদ্রা এখন অন্যতম স্নায়বিক রোগ। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ বিভিন্নভাবে এই সমস্যায় আক্রান্ত। শতকরা ৮০ভাগ মানসিক রোগ অনিদ্রার কারণে সৃষ্ট। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে অনিদ্রা মানসিক রোগের প্রধান কারণ। স্বাস্থ্যের জন্য ঘুম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বিষন্নবোধসহ কাজে মনোযোগ থাকে না, সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে ও উত্তেজিত হয়ে যায়। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। যাদের রাতে ভাল ঘুম হয় না, তারা কখনো একথা দাবি করতে পারবে না যে, তারা সুস্থ আছে। মনে রাখতে হবে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার সুস্থতার জন্য পরিমিত ঘুম দরকার। ভাল ঘুম আপনার যে কোন রোগ পঞ্চাশ সেরে তুলবে।
ঘুমের সময় : ঘুমের সঠিক ও প্রকৃত সময় রাত। অনেকে মনে করেন দিন হোক বা রাত, ঘুম হলেই হল। এটি ভুল ধারণা। শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির জন্য রাতের নি্নিদ্র ঘুম অপরিহার্য।
কতটুকু ঘুম প্রয়োজন : গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। একজন মানুষের জন্য কয় ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন তা নির্ভয় করে ব্যক্তির বয়স, শারীরিক গঠন ও পরিশ্রমের উপর। নবজাতক শিশু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭/১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমায়। কিশোর বয়সে ঘুমের পরিমাণ ৯/১০ ঘণ্টা। প্রাপ্তবয়স্ক একজন সুস্থ মানুষের জন্য ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। বৃদ্ধ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য রাত্রে একটানা ৩/৪ঘণ্টা ভাল ঘুম দরকার। বাকি সময় ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘুম হতে পারে। আবার এমনো দেখা যায় যে, কেউ কেউ ২৪ ঘন্টায় মাত্র ৩/৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে দিব্যি আরামে আছেন। এটা ব্যতিক্রম।
অনিদ্রা : অনিদ্রা কোন রোগ নয়, বরং রোগলক্ষণ। বিভিন্ন কারণে যে কোন বয়সের যে কেউ অনিদ্রায় ভোগতে পারেন। এ জাতীয় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে তার জন্য উদ্বিঘ্ন হবার কোন কারণ নেই। কিছু নিয়ম মেনে চললে অনিদ্রা কেটে যাবে।
ধূমপান-মাদকদ্রব্য সেবন সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে পারলে ঘুমের জন্য ভাবতে হবে না। ক্ষুধা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ক্ষুধা নিয়ে ঘুমানো যাবে না। শোয়ার আগে আলো নিভিয়ে দিন। অন্ধকার ঘুমের সহায়ক। শোয়ার ঘর কোলাহলমুক্ত রাখুন। বালিশ-বিছানা আরামদায়ক কি না দেখে নিন। অনেক সময় বালিশের কারণে ঘাড়ব্যথাসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়।
মধু, দুধ, কলা ঘুমের সহায়ক। মধুতে থাকা গ্লোকোজ ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারি ওরেক্সিনের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। দুধ মাংসপেশিকে শিথিল করে, কলায় থাকে ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম। শোয়ার আগে সামান্য মধু, এক গ্লাস বা এক কাপ হাল্কা গরম দুধ, একটি কলা খেলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসে।
রাতে শোয়ার আগে গোসলের অভ্যাস করতে পারলে ভাল। গোসল সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীরকে ঝরঝরে করে তোলে।
অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করুন, যারা অফিসের কাজ বাসায়-বাড়িতে নিয়ে আসেন, মনের ভেতরে এক প্রকার কাজের চাপ থাকে। এই চাপ অনেক সময় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। রাত্রে ভারি কাজ থেকে বিরত থাকুন। রাতে জার্নি করলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সম্ভব হলে রাতের জার্নি এড়িয়ে চলুন।
রাতে ভাল ঘুমের জন্য তিনটি বিষয় মনে রাখতে হবে- রতের খাবারে বিলম্ব না করা, রিসফুড পরিহার করা এবং পরিমাণে কম খাওয়া। এ তিনটি বিষয় মেনে চললে অনিদ্রা কেটে যাবে।
রাতে ভাল ঘুমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঘুমের রুটিন মেনে চলা। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করুন, অনুরূপ প্রতিদিন একই সময়ে বিছানা ছাড়ার অভ্যাস করুন। বই পড়ুন। বইপড়া এমনিতে একটি ভাল অভ্যাস। যারা অনিদ্রায় ভোগেন, শুয়ে শুয়ে যে কোন একটি ভাল বই পড়ুন। আস্তে আস্তে ঘুম চলে আসবে।
স্বপ্নবহুল নিদ্রা, যারা ঘুমানোর সাথে সাথে নানা স্বপ্ন দেখেন, ঘুমের মধ্যে কথা বলেন, দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাতে আর ঘুম হয় না। এমনকি অনেকে ঘুমের মধ্যে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরে হাঁটাহাঁটিও করে। যাদের প্রায়ই এরকম হয়, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
শারীরিক নানা রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক-বুকজ্বালা, বাত-ব্যথা, হাঁপানি, রক্তশূন্যতা, শারীরিক দুর্বলতা, আঘাত ইত্যাদি কারণেও নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে রোগ সারাতে হবে। রোগ সেরে গেলে আপনাআপনি অনিদ্রা কেটে যাবে।
ক্রনিক রোগের কারণে অনেককে সব সময় ওষুধ সেবন করতে হয়। ওষুধজনিত কারণে যদি কারো নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বিষয়টি খুলে বলুন। চিকিৎসক হয় ওষুধ পাল্টে দেবেন, নতুবা বিকল্প ব্যবস্থা দেবেন। ভাল ঘুমের জন্য পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম অপরিহার্য। অলস জীবন-যাপন পরিহার করুন, প্রতিদিন কোন না কোনভাবে শারীরিক পরিশ্রম করুন, হতে পারে তা অফিস থেকে হেঁটে বাসায় ফেরা, বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে হেঁটে বাসায় ফেরা, সময়-সুযোগ করে নিজ হাতে বাজার করা, হাল্কা ব্যায়াম করা ইত্যাদি। হেঁটে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করার ইসলামি বিধানটি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
হোমিওপ্যাথিতে INSOMNIA বা অনিদ্রাজনিত বিভিন্ন জটিল রোগলক্ষণের ভাল চিকিৎসা আছে। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অনেককে লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করে আমি ভাল ফল পেয়েছি।
অনেকের সাময়িক অনিদ্রা দেখা দিতে পারে। যেমন : পরীক্ষা, চাকরির ইন্টারভিউ, কর্মক্ষেত্রে বসের দুর্ব্যবহার, কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন, হঠাৎ টাকার সংকটে পড়া, বাসা পরিবর্তন, বন্ধু কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু ইত্যাদি। এসব কারণে সাময়িক নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটা স্বাভাবিক। উদ্বিগ্ন হতে হবে না, আপনাআপনি তা সেরে যাবে। যদি বিষয়টি দীর্ঘস্থায়ী হয়, লাগাতার ঘুমের সমস্যা হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন