বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ ধর্মের প্রভাবকে বিলীন করার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী হৈচৈ করা বামপন্থী সমাজতন্ত্রীদের একটা কৌশল। কারণ জাতিকে ধর্মীয় অনুভূতির প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে ধর্মহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আমাদের মুসলিম সমাজ কখনও সাম্প্রদায়িক ছিল না এবং সাম্প্রদায়িকতার দোষে তাদের নিন্দা করা মোটেও কাম্য নয়। তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতিকে সতর্ক করতে গিয়ে তারা ধর্মীয় সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে বলেই আমার ধারণা। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের সততার সঙ্গে বলা প্রয়োজন, তারা সাধারণ মানুষের নির্বাচনে বিশ্বাস করেন না। তারা ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পথ ধর্মহীনতাকেই মনে করেন। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থায় তারা আস্থাশীল নন। তারা দলীয় একচ্ছত্র শাসনের প্রবক্তা।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুরু করেন স্বাধীনতার পক্ষের বামপন্থীরা, স্বাধীনতাবিরোধী কোনো চরম ইসলামপন্থীরা নয়। অথচ এসব বামপন্থী গ্র“পের স্বাধীনতাপূর্ব রাজনীতিতে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার মতো না ছিল জনসমর্থন, না ছিল পেশিশক্তি।
স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রবক্তারা ভয়াবহ সন্ত্রাসী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। গণতন্ত্রের বদলে এ দেশের মানুষের ওপর সমাজতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার উত্তাপ-উত্তেজনা থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম উৎসাহ পাচ্ছে কিনা তা আমাদের ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কারণ ধর্মীয় জঙ্গিবাদ যেমন দেশের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না, ঠিক তেমনি একইভাবে সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও বাইরের উৎসাহ-সহযোগিতা থাকে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে ধর্মহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহারের জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টি ও সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে তার ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করতে হয়।
এ দেশের জনগণই তাদের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে তৈরি করেছে। জনগণের নেতা জনগণের সৃষ্টি। তার সংগ্রামের প্রকাশ্য লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র তথা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তিনি প্রায়ই গর্বের সঙ্গে বলতেন : এ দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে এবং আমিও তাদের ভালোবাসি। জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি তার রাজনীতি ছিল না।
তিনি ছিলেন সত্যিকারের জনগণের নেতা, সমাজতান্ত্রিক ছাঁচে গড়া গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী নেতা তিনি ছিলেন না এবং সমাজতন্ত্রের ডগমাভিত্তিক রাজনীতিতে তার বিশ্বাস ছিল না। জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। রাষ্ট্রপরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ভুল-ভ্রান্তি তারও নিশ্চয়ই হয়েছে। কম-বেশি সবারই হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে গণমানুষের মতামতের প্রাধান্য অস্বীকার করা যাবে না। তার ছয় দফার প্রতি সমর্থন জনগণের ভোটেই পেয়েছিলেন। সমাজতন্ত্রের ডগমাটিক চিন্তায় জনগণের মঙ্গল হচ্ছে কিনা তা জনগণ থেকে জানতে হবে না। সমাজতান্ত্রিক থিওরি বৈজ্ঞানিক। তাই বৈজ্ঞানিক উপায়ের ওপর আস্থা রাখলেই হল।
বঙ্গবন্ধু যদি জনসমর্থিত নেতা বা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নেতা না হবেন, তাহলে তিনি যে আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন ভোগ করলেন তার এসব কর্মকাণ্ডকে তাহলে নিষ্ঠুরতম ভাষায় লোক দেখানো চাতুর্য বলতে হবে। বিপ্লবী কোনো নেতা জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি নিজেই নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুকে বিপ্লবী নেতা বলা হলে তিনি যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত সাগরেদ ছিলেন, নেতা হিসেবে যিনি ছিলেন গণতন্ত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তি, শাসনতান্ত্রিক পন্থা ও ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, সেই মহান নেতার সঙ্গে তার সম্পর্কের গুরুত্ব বলতে গেলে কিছু থাকে না। অস্বীকার করতে হয় তার প্রিয় মানিক ভাইয়ের প্রভাবের কথাও।
তাহলে এটাও বলতে হবে, যেসব নেতাকর্মী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংগ্রাম করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, তারা গণতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না। উদ্দেশ্য হাসিলের পথ ও পন্থার হেরফের হতেই পারে। তবে দর্শন ফেলে দিয়ে নয়। সেটা হলে তো তা হবে ক্ষমতালোভীদের সুবিধাবাদী রাজনীতি।
পাকিস্তান আমলে দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বামপন্থীদের কাছ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জ এল তখন আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে শক্তি জোগান বঙ্গবন্ধু। কাউন্সিলররা বিপুল ভোটে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব সমর্থন করেন। গণতন্ত্রের সংগ্রামকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আস্থাশীল হয়ে তার সঙ্গেই থাকেন। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ভাঙনের ঝুঁকি নিয়েছিল, তবু বামপন্থীদের বিপ্লবী রাজনীতির কাছে নতি স্বীকার করেনি।
আওয়ামী লীগের ভেতরের একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে বামপন্থীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। মওলানা ভাসানীর ওপর পরম শ্রদ্ধা রেখেও স্বীকার করতে হবে যে তার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে ব্যক্তি ভাসানী শক্তিশালী ছিলেন।
বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের কথা শোনেননি। তিনি তখন জনগণের শক্তির ওপর বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বামপন্থী গ্র“পগুলো তাকে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। তাদের কৌশল পরিষ্কার। নির্বাচনে তো তাদের কোনো স্থান থাকবে না। নির্বাচন না হলে তারা বড় বড় নেতা সেজে বড় বড় বিপ্লবী কথা শোনাতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু জনগণের শক্তির ওপর বিশ্বাস রাখতেন। অস্ত্রনির্ভর বিপ্লবী রাজনীতির কোনো চিন্তাভাবনা তার ছিল না এবং তিনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রেরও অংশীদার হতে চাননি। বামপন্থী রাজনীতি কখনও জাতীয়তাবাদী হতে পারে না। সমাজতন্ত্র অবশ্যই আন্তর্জাতিক।
তিনি জানতেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিলে জনগণের সমর্থন পেয়ে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে। গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, জনগণের রায় পেলে প্রধান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আরোপিত আইনি বাধ্যবাধকতার কোনো গুরুত্ব থাকবে না।
যে মানুষটির শক্তির উৎস ছিল জনগণ এবং জনসমর্থন, তাকে কোনোভাবে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক নেতা বলা যায় না। তিনি বৈজ্ঞানিক অথবা অবৈজ্ঞানিক কোনো ডগমারই নেতা ছিলেন না।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ নেতাদের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে না, তারা মার্কসবাদ অনুসরণে তাদের মার্কসবাদী জ্ঞান দিয়ে জনগণকে সেবা দেয়ায় বিশ্বাসী। কথায় বলে পাগলেও নিজের ভালো বুঝে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভালো বুঝে না- তারা ভাবে, সমাজতন্ত্রই তাদের মুক্তি আনবে।
সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে কার্যকর করতে জনমত নয়, রাষ্ট্রীয় শক্তিই সবকিছু। অবশ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শক্তি প্রয়োগ তাদের কাছে এত স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রীয় শক্তির অপপ্রয়োগ কাকে বলে সেটাই তাদের জানা নেই।
সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করেন না যে জনগণের কিছু অলংঘনীয় অধিকার থাকতে হয়, যেসব অধিকারের প্রতি সরকারকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আজকের আধুনিক যুগে পশুদেরও কিছু অধিকার আছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে জনগণের কোনো অধিকার নেই, আছে কেবল নির্দেশ মানার দায়িত্ব।
সোজা কথায় বলতে হয়, ক্ষমতার দাপটে বিশ্বাসী কিছু লোক স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার আধুনিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অন্ধ ভক্ত। নিজেদের মজলুম জনগণের নিঃস্বার্থ দরদি বলে দাবি করে রাষ্ট্রীয় সব স্বার্থের মালিক তারা হয়ে যান। সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সুবিচার কায়েমের নীতিগত দিক প্রশংসনীয়। কিন্তু সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক দিক কঠিন স্বৈরতন্ত্র ভিন্ন কিছু নয়। সমাজতান্ত্রিক প্রশাসনে জনগণের ভোটাধিকারকে অস্বীকার করা হয়। যুক্তি হল দেশ শাসনের প্রশ্নে তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত শাসকরাই একমাত্র জানেন দেশ ও জনগণের মঙ্গল কিসে। তারা যাকে বলবে উন্নয়নের রাজনীতি সেটাই জনগণের উন্নয়ন বলে মেনে নিতে হবে। বর্তমান বিশ্বে সর্বাত্মক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাকি দুনিয়া এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
তথাপি এখনও বাংলাদেশের মতো অস্থিতিশীল এবং দুর্নীতিতে ভরা দেশে বিদ্যমান দুর্বল ও ব্যর্থ গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের ঘাড়ে চেপে বামপন্থীরা ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ পোষণ করে চলেছেন। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন না দিয়ে রাজা-বাদশাদের মতো তারা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বাসনা পোষণ করে থাকেন।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সত্যিকার আস্থার প্রমাণ স্বরূপ ১৯৭২ সালে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র দিয়েছিলেন এবং গণতান্ত্রিক পথ ও পন্থার প্রতি তার নিষ্ঠার কারণে ১৯৭৩ সালে সেই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকারও তিনি গঠন করেছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি গণতন্ত্র ও নির্বাচনী রাজনীতির বিলোপ সাধনে আগ্রহী ছিলেন না।
কিন্তু শিগগিরই বামপন্থী গ্রুপগুলো একটা সুযোগ পেয়ে গেল বঙ্গবন্ধুকে সমাজতন্ত্রের দিকে পরিচালিত করার। সরকার পরিচালনায় তিনি নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। নিজের লোকদের দুর্নীতি ও বেপরোয়া কর্মকাণ্ড তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। বামশক্তিগুলো সন্ত্রাস আর হাট-বাজার লুট করার পথ বেছে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য সরকার পরিচালনার কাজটি অধিকতর কঠিন করে তোলে। উগ্রপন্থীদের হাতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর জীবন হারাতে হয়। যে কারণে প্রতিটি সংসদ সদস্যের জন্য অস্ত্রধারী লোক দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও এক ধরনের অসাংবিধানিক পরিবর্তনের আশংকায় ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল। এমনকি তারা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর চামড়া খুলে ফেলার স্লোগান দেয়ার মতো সাহস দেখিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরই একাংশ ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য জরুরি প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন না। তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। কর্তৃত্ববাদী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি গ্রহণ করলে তাকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছিল। সেক্ষেত্রে জনগণের ভোটের আর প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন থাকবে না জনসমর্থন লাভের। সরকার জনপ্রিয়তা হারালেও কিছু যাবে আসবে না। সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য স্বাধীন সংবাদপত্রের অস্তিত্ব থাকবে না। এভাবেই ১৯৭৫ সালে বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সরকারের অংশে পরিণত হয়। এভাবে গঠিত হয় একদলীয় বাকশাল সরকারের যৌক্তিকতা। যাদের পেছনে কোনো জনসমর্থন নেই, তারাই আওয়ামী লীগের বিপ্লবী অংশ হয়ে রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা গ্রহণ করলেন- এখনও আছেন। কোনোরূপ বিপ্লব ছাড়াই দেশ বিপ্লবী সরকারের অধীনস্থ হল। বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপিয়ে দেয়া পরিবর্তনকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব না বলে কী-ই বা বলবেন? দেশে তাই দ্বিতীয় বিপ্লব হয়ে গেল। গণতন্ত্র নিধনের পরিবর্তনকে তো গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বলা যেত না।
কিন্তু আমাদের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা এবং মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ হিসেবে আমাদের বিশ্বাস ও আবেগের জায়গাটি অবিচল ও অপরিবর্তিত থেকে গেল, যেমনটি ঐতিহাসিকভাবে প্রত্যাশিত। দেশে সংঘাতের রাজনীতি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটাতে হলে আমাদের অবশ্যই এ দেশের মানুষের মন-মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করে ক্ষুদ্র সম্মিলিত শক্তির আধিপত্য বিস্তার বর্তমান যুগে অসম্ভব। নৈরাজ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হবে।
তাই উগ্রবাদের মোকাবেলা করার সর্বোত্তম পন্থা হবে রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের ইচ্ছাকেই শেষ কথা হিসেবে মেনে নেয়া। আমরা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সংঘাত ঘটিয়ে ইন্দোনেশিয়ার মতো নির্মম রক্তপাতের মুখোমুখি হতে চাই না। ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসীরা এবং সমাজতন্ত্রীরা কখনও প্রতিপক্ষের ব্যাপারে সহনশীলতা দেখায় না এবং শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথও তাদের পথ নয়।
ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সমাজতন্ত্রবাদ- দুটিই সন্ত্রাসী শক্তির ওপর নির্ভরশীল। ধর্মের নামে হত্যা করা এবং বিপ্লবী রাজনীতির মাধ্যমে জীবন নেয়ার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। তাই আমরা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং বৈপ্লবিক রাজনীতি কোনোটাই চাই না।
আমরা আমাদের মধ্যকার ঐক্য ও ধর্মীয় বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন হতে দিতে পারি না। আমরা সবাই মিলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই আমাদের গর্বের বাংলাদেশ গড়তে পারি। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে নয়, একের ওপর অপরের মনিবসুলভ কর্তৃত্ব দাবি করেও নয়। আমাদের মেধা ও মননশীলতার সুস্থ প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা নিজেদের শান্তি ও স্বস্তির জীবন গড়তে পারি। শেষ কথা হিসেবে যা বলতে চাই তা হল, বিপ্লবী রাজনীতি করতে গিয়ে জনজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আহ্বান জানাবেন না।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন