বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ তুরস্কের বর্তমান অবস্থা অনেকটা আগুন নিয়ে খেলার মতই। প্রথমে প্রচন্ড দেশপ্রেমিক আটকোটি মানুষের এই দেশটিতে আগুন লাগাতে উদ্যত হয় গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিশালী বিদ্রোহীরা। এরা সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, প্রশাসন ও সমাজে সমানভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে সমান ভাবে তারা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। জনগণের সাপোর্ট না থাকায় নিজ নামে কোন রাজনৈতিক দল তারা প্রতিষ্ঠা করেনি। অথচ সরকারের ভেতরে প্যারালাল সরকার হিসেবে সব সাময় সোচ্চার ছিল তারা। এরদোগান তাদের এমন তৎপরতা আগে থেকে সহ্য এবং তাদের দাবি পুরণ করে আসলেও গেল কয়েক বছর থেকে তিনি বিভিন্ন ভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। গুলেন মুভমেন্ট নামে প্যারালাল এই শক্তি ইসলামের নামে এবং বাহ্যত ইসলামী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় মুসলিম বিশ্বের অনেকেই এই মুভমেন্টের বিরুদ্ধে পরিচালিত এরদোগানের পদক্ষেপকে সাপোর্ট করতে পারছিলেন না। এই মুভমেন্টের ব্যাপারে স্বয়ং টার্কিশদের মনের ধোয়াশাই যেন কাটছেনা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মুভমেন্টের মুল নেতা অনেক বছর থেকেই আমেরিকায় স্বেচ্ছায় নির্বাসনে আছেন। তার বিরুদ্ধে পরিচালিত এরদোগানের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু এ সবে কান না দিয়ে তাদের তাদের রিক্রুটমেন্ট বন্ধ করতে গুলেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালগুলোর কোন কোনটি সরকারের অধীনে নিয়ে আসতে শুরু করেন এরদোগান। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে তাদের ধীরে ধীরে বরখাস্ত করতে শুরু করেন। সরকারের এই আচরণ সহ্য করতে না পেরে ২০১৩ সালে তারা সেনা ক্যু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। গতবছর গুলেনপন্থী ২৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বহিস্কার করতে উদ্যত হলে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব এরদোগানের গলা চেপে ধরার উপক্রম করেছিল।
গুলেনপন্থীদের চুড়ান্ত আক্রমণ?
পরিস্থিতি যখন এমন, এই অবস্থায় গত ১৫ জুলাই সর্বশক্তি নিয়ে সরকারকে হটাতে উদ্ধত হয় তারা। এতে অংশ গ্রহন করে সব সেক্টরে লুকিয়ে থাকা গুলেনপন্থী সদস্যরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এবারও তারা এখনো সফল হতে পারেনি। তবে তাদের এবারের প্লানটি ছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক গভীর ও সুদুরপ্রসারী। ক্ষমতা দখল অথবা এরদোগানকে অন্তত দুনিয়া থেকে শেষ করে দেয়া ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু শুরুতেই সেনা প্রধানকে কাবু করতে না পারা কিংবা এরদোগানকে এরেস্ট করতে না পারায় প্রতিটি পদক্ষেপে হোচট খায় তারা।
পাল্টা আক্রমণে এরদোগান?
স্বাভাবিক কারনেই বিদ্রোহ পরবর্তি পদক্ষেপ হিসেবে এরদোগান পাল্টা আক্রমণে ব্যস্ত এখন। এ পর্যন্ত বিদ্রোহের ভেতরের বাইরের ৬০০০ জনের মত গুলেনপন্থীদের এরেস্ট করা হয়েছে। এদের মধ্যে সেনা বাহিনীর জেনারেল পর্যায়ের অনেকেই রয়েছেন। যেহেতু এরদোগানকে শেষ করতে চেয়েছিল তারা, কাজেই এরদোগানও এখন তাদের শেষ দেখতে চাচ্ছেন।
হামলায় কি আমেরিকার হাত রয়েছে?
বিদ্রোহের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের পাশাপাশি আমেরিকায় থাকা গুলেন মুভমেন্টের প্রধান গুরু মি. গুলেনকে তুরস্কে ফিরিয়ে দিতে আমেরিকার প্রতি আহবান জানিয়েছেন এরদোগান। এ দিকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তার এক বক্তব্যেও এ ক্যুর সাথে আমেরিকার জড়িত থাকার ইংগিত দিয়েছেন। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এমন অভিযোগ তুরস্কের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে। গুলেনকে ফিরিয়ে দেয়া না দেয়ার ব্যাপারে তার ও তার মুখপাত্র জন কিরবির বক্তব্যে কোন ইংগিতই দেয়নি আমেরিকা।
আমেরিকার বিমান উড়তে নিষেধাজ্ঞা
এ দিকে তুরস্কের আদানা শহরে অবস্থিত (১৯৯০ সাল থেকে) আমেরিকার বিমান ঘাটি থেকে যে কোন বিমান উঠানামার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তুরস্ক। ১৬ জুলাই এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অন্য দিকে এ বিদ্রোহের মাঠের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে বিবেচিত বিমান বাহিনির সাবেক কমান্ডার জেনারেল আকিন অজতুরক ১৯৯৮ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ইসরাইলের সামরিক এটাচী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে সে সময় থেকেই তিনি অন্তরে এমন বিদ্রোহের আগুণ পুষে আসছিলেন। ঘটনার সাথে এমন ব্যক্তির জড়িত থাকার ফলেই এ বিদ্রোহের সাথে আমেরিকা ও ইসারাইলের সম্পর্ক রয়েছে, এরদোগান ও টার্কিশ জনগণের বদ্ধমুল ধারণ এমনই। আর এ ধারনাই টার্কিশ জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করতে পেরেছে একই মঞ্চে একই পয়েন্টে। সব গুলো মিডিয়া একযোগে সেনাদের বন্দুকের নলের সামনে জীবন বাজি রেখে সরকারকে সাপোর্ট করার মুলেও এই ধারনাই।
আশংকা কি কেটে গেছে?
ঘটনার পেছনে যারাই থাকুক সাদা চোখে দেখতে গেলে আপাতত তাদের পরাজয় হয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যুদ্ধের মাঠে শত্রুর পরাজয় হলেও এখনই সেটাকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছেন না এরদোগান, তার দল একে পার্টি কিংবা তুরস্কের জনগণ। ১৫ জুলায়ের ঘুমহীন রাত কেটে গেলেও এখনই বিছানায় গিয়ে আরাম করার কোন ইচ্ছেই নেই টার্কিশদের। টানা ৩ য় দিনের মত এখনো তারা রাজপথে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন টার্কিশদের ভাগ্য বদলে দেয়া এক স্বপ্ন পুরুষ রেজেপ তাইয়্যেপ এরদোগানকে।
রাজপথ কেন ছাড়ছেনা টার্কিশরা?
টারকিশ জনগণ ও একে পার্টির নেতাদের ধারণা, এরদোগানকে শেষ করে দেয়াই এ হামলার পেছনের মুল কারণ।আর এ জন্যই বিদ্রোহীরা এরদোগানের অবস্থানরত হোটেল ও রাষ্ট্রপতি ভবনে বিমান থেকে বোমা হামলা করেছে কয়েক দফায়। একে পার্টির নেতারা মনে করছেন, এ ধরণের বড় হামলায় শত্রুরা কমপক্ষে তিনটি প্লান নিয়ে মাঠে নামে। সে হিসেবে তাদের এ প্লান সফল না হলেও এখন তারা বি প্লান নিয়ে কাজ করছে নিশ্চয়। অতএব, এ প্লানের মত বি প্লানও ব্যর্থ করে দিতে জনগণকে বাসা কিংবা অফিসে নয়, রাজপথেই দেখতে চান এরদোগান। সে জন্য বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন সরকার দলীয় নেতারা। মোবাইল টেলিকম গুলো নিয়মিত বিরতিতে জনগণকে মেসেজ পাঠাচ্ছে এরদোগানের পক্ষ থেকে। এরদোগান আজও দলীয় নেতা কর্মিদের (প্রয়োজনে) কমপক্ষে এক সপ্তাহ রাজপথে থাকার প্রস্তুতি নিতে দলীয় নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বুরসা শহর একে পার্টির যুব নেতা এবুবকর আরমান।
এখনো অনিরাপদ রাজধানী আংকারা
এ দিকে ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের সব গুলো শহর পুরোপুরি সরকারের কন্ট্রলে থাকলেও রাজধানী আংকারার ভিতরের অবস্থা এখন সরকারের পক্ষে আসে নি। প্রচুর কাজ প্রিয় টার্কিশরা বাহ্যত সব কিছুতে স্বাভাবিকতা বজায় রাখলেও আংকারা সেনা রেজিমেন্টের সব কিছু এখনো নিরাপদ মনে করছেন না সরকারী নেতারা। যার ফলে রাষ্ট্রপতি এরদোগান রাজধানীতে যেতে চাইলেও এখনো তিনি নিজ শহর ইস্তাম্বুলেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
হেলিকপ্টার ও বিমান নিখোজের গুঞ্জন
বিদ্রোহের রাতে সেনা ও নৌবাহিনীর ব্যবহার করা বিমানগুলোর মধ্যে ২/৩ টি এবং ৪০ টিরও বেশি হিলিকপ্টার নিখোজ রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে সরকার দলীয় নেতা কর্মিদের মাঝে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্রোহীরা একে একে সারেন্ডার করলেও আংকারা রেজিমেন্টের বিদ্রোহীরা সহজেই সারেন্ডার করতে রাজি হয় নি। এক সময় এমনও শোনা গিয়েছিল যে, তারা আলোচনা করতে চায় সরকারের সাথে। কিন্তু ব্যর্থতার ষোল আনার মধ্যে পনের আনাই পুরণ হতে যাওয়া বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসতে বড় ঠেকা পড়েছে এরদোগানের। ফলশ্রুতিতে বিদ্রোহের রাতে ভোর হওয়া পর্যন্ত আকাশেই উড়াউড়ি করেছে বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো। পরবর্তীতে মাটিতে ল্যান্ড করে তারা সারেন্ডার করলেও সব গুলো ক্যাম্পের ভিতরে ল্যান্ড করেনি বলে কারো কারো ধারণা। একই সাথে বিদ্রোহী সেনাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ জনগণের সাথে মিশে পালিয়ে গেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে তুরস্কের চা বাহচেগুলোর টেবিলে। এদের মধ্যে ৮ জন একটি হেলিকপ্টারসহ পালিয়ে আশ্রয় নেয় গ্রিসে। এরদোগানের অনুরোধের এক দিনের মধ্যেই তাদের তুরস্কে ফিরিয়ে দেবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে গ্রীস সরকার।
গুলেনপন্থীদের পুরোপুরি নির্মুল করতে পারবেন কি এরদোগান?
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরে গৃহীত এরদোগানের পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে গুলেনপন্থীদের আর কোন সুযোগ করে দিতে মোটেই রাজি নয় এরদোগান সরকার। আর এ উদ্দেশ্যেই সব গুলো সেক্টরেই গুলেন পন্থীদের খোজে বের করতে দিন রাত কাজ করছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন সেক্টরে ঘাটি গাড়া এ শক্তির সব খবর কি জানে গোয়েন্দারা? যদি জেনেই থাকে, তাহলে এত বড় আকারের বিদ্রোহের কোন অাঁচই করতে পারে নি কেন গোয়েন্দারা? তাছাড়া বিদ্রোহের রাতে প্রথম পদক্ষেপগুলো ব্যর্থ হওয়ায় অভ্যুত্থানটি সফল হবে না বুঝতে পেরে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্ট, বিমান ও নৌ বাহিনীর অনেকেই তখন সুর পাল্টে ' আমরা বিদ্রোহের সাথে নেই' বলেন নি এটা কে বলতে পারে? তার চেয়েও বড় আশংকার বিষয় হচ্ছে, টার্কিশদের ধারণা অনুযায়ী এ ঘটনার পেছনে আমেরিকা ও ইসরাইলের হাত কি নেই?? যদি থেকেই থাকে তাহলে এরদোগান সরকারের " গুলেনপন্থীদের শেষ দেখে ছাড়া"র শেষ কি বসে বসে দেখতে থাকবে আমেরিকা ইসরাইল গং? আপাতত করার কিছু নেই মনে হলেও গোটা মুসলিম বিশ্বকে জাহান্নামে পরিণত করতে প্রয়াসী এই অপশক্তি যে হাল ছেড়ে পরাজয় মেনে নেবে না এটা সহজেই অনুমেয়। তাই যদি হয় তাহলে ছবির মত সুন্দর, গোছালো, সবুজে সবুজে ভরা, একাধিক নবি-সাহাবির জন্ম ও কবর ধারণ কারী মুসলিম মিল্লাতের প্রত্যাশার কেন্দ্রভুমির ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে কে জানে।
অবস্থাদৃষ্টে তুরস্ককে আগুনের উপর দাড়িয়ে আছে মনে হলেও নো রিটার্ণ ওয়ে'তে দ্রুত বেগে ছুটতে থাকা তুরস্কের স্বপ্ন পুরুষ এরদোগান যদি এ দফায় শতভাগ জয়ী হতে পারেন, তাহলে এটিই হবে নির্যাতিত মুসলিম বিশ্বের জন্য এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সুসংবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন