বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ গাড়ি চালকের শার্ট ছেঁড়া। দেখে মনে হচ্ছে একদফা তাকে পেটানো হয়েছে। চালক মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। চালকের শার্ট বাম হাতে খামচে ধরে দাঁড়ানো ট্রাফিক সার্জেন্ট। ডান হাতে পকেটের কিছু একটা বের করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক কনস্টেবলের হাতে দিলেন। তারপর চালকের ওপর শুরু করলেন চড়-থাপ্পড়। এরপর তাকে জোর করে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে সজোরে আঘাত করে চেপে ধরলেন তার মাথা। এমন সময় প্রতিবাদ করতে করতে এগিয়ে এলেন চারপাশের মানুষ। তারা সেই ট্রাফিক সার্জেন্টকে টেনে সরালেন খানিকটা।
এমন এক দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। এক মিনিট ২১ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে শনিবার রাত সাড়ে ১০টায়। এরপর থেকে তা দেখা হয়েছে লক্ষাধিকবার। আর শেয়ার হয়েছে তিন হাজারেরও বেশি। ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ট্রাফিক সার্জেন্টের নিষ্ঠুরতার এই চিত্র। সাধারণ মানুষ পুলিশের এই আচরণকে ধিক্কার জানাচ্ছেন মন্তব্যের ঘরে।
গতকাল সরেজমিন অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে ঘটনার সত্যতা। এমনকি গাড়িচালককে পিটিয়ে থানায় নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। তবে রাতেই বিষয়টি মীমাংসা করা হয়। গাড়িচালকের পক্ষ থেকে ট্রাফিক সার্জেন্টকে দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। সার্জেন্টের মোবাইল, চশমা ও ঘড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলে নেওয়া হয় এই টাকা। পরে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান এই চালক, যার নাম ইউসুফ ফরাজী।
চালক ইউসুফ ফরাজীর গাড়ির মালিক আরিফুল ইসলাম জানান, শনিবার একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছিল। তা মীমাংসা হয়েছে। আমরা নিজেরাই তা সমাধান করে নিয়েছি।
ঘটনার বর্ণনায় জানা গেছে, শনিবার বিকেলে মালিকের ছেলেকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৭/এ সড়কের কেএফসি রেস্টুরেন্টে নামিয়ে দেন চালক ইউসুফ ফরাজী। এরপর গাড়িটি রাস্তার পাশে পার্কিং করেন। এ সময় ৭/এ সড়কের ট্রাফিক বক্সের সার্জেন্ট মেহেদী ইউসুফের কাছে কাগজপত্র দেখতে চান। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে চালককে বেধড়ক মারধর করেন সার্জেন্ট মেহেদী। পরে পথচারীরা এগিয়ে এলে সার্জেন্ট মেহেদী মারধরে ক্ষান্ত দিয়ে চালককে পাশের পুলিশ বক্সে নিয়ে যান। গাড়িটি রেকারিং করে নিয়ে যান ধানমণ্ডি থানায়। ইউসুফ ফরাজীকে ঢোকানো হয় থানার লকাপে। খবর পেয়ে গুলশানের বাসিন্দা গাড়ির মালিক আরিফসহ অন্যরা ছুটে আসেন থানায়। তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি রফাদফা করেন। সার্জেন্ট মেহেদী তার একটি মোবাইল, একটি চশমা ও একটি ঘড়ি ভেঙেছে দাবি করে ক্ষতিপূরণ চান। পরে তাকে গাড়িচালকের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় শনিবার রাত সাড়ে নয়টায় ধানমণ্ডি থানায় একটি জিডি নোট করা হয়। যার নম্বর ১০৫০। গতকাল দুপুরে ধানমণ্ডি ট্রাফিক বক্সে গিয়ে কথা হয় সার্জেন্ট মেহেদীর সঙ্গে। তিনি এ সময় দাবি করেন, তিনি চালক ইউসুফের কাছে কাগজপত্র চাইলে তিনি প্রথমে দিতে অস্বীকার করেন। পরে কাগজপত্র দিলেও বলেন, ‘আমার বস আপনার মতো পুলিশ সদস্যদের পকেটে রাখেন।’ তিনি এ কথা শুনে কাগজপত্র নিয়ে ট্রাফিক বক্সের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় পেছন থেকে চালক তার শোল্ডার ব্যাজ ধরে টান দেন। তিনি ঘুরে চালককে একটি থাপ্পড় দেন।
সার্জেন্ট মেহেদী জানান, এ সময় ইউসুফ তাকে একটা ঘুষি মারেন। এতে তার চশমা ভেঙে যায়। পরে তিনি কোমরে থাকা পিস্তলটি সহকর্মীর হাতে দিয়ে চড়-থাপ্পড় দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
মাটিতে ফেলে মাথায় বুট দিয়ে চেপে ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তাকে অ্যারেস্ট করতে চাইছিলাম। এটি আমাদের অ্যারেস্ট করার কৌশল। তবে আমি মাথায় বুট দিয়ে চেপে ধরিনি। চেপে ধরেছি ঘাড়ে, যাতে সে পালাতে না পারে। মেহেদী বলেন, এ সময় কয়েকজন লোক এগিয়ে আসেন। যাদের পরনে কোর্ট-টাই পরা ছিলো। মুখে দাড়ি ছিলো। তাদের জামায়াত-শিবিরের লোক বলে মনে হয়েছে। আমার ওপর তারা হামলার চেষ্টা করেন। পরে আমি চালককে নিয়ে থানায় যাই। গাড়িটিও রেকারিং করে থানায় নিয়ে যাই।
ধানমণ্ডি থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি রাতেই মীমাংসা হয়। গাড়ি চালকের পক্ষে তার লোকজন আসেন। তারা পুরো ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। রেকারিংয়ের বিল পরিশোধ করেন। এছাড়া সার্জেন্ট মেহেদীকে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণও দেন। চালক ইউসুফ দোষ স্বীকার করে পা ধরে মাফও চান। সবকিছুই ঠিকঠাকই ছিলো। কিন্তু ফেসবুকে কে বা কারা ভিডিওটি আপলোড করে দিয়ে পরিস্থিতি উল্টে দিয়েছে।
সার্জেন্ট মেহেদীর সহকর্মীরা দাবি করেন, পুরো ঘটনার ভিডিও দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে খণ্ডিতাংশ। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এটি পূর্ব পরিকল্পিত বলে মনে করেন তারা।
এদিকে ফেসবুকে আপলোড হওয়া ভিডিও নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এমনতিইে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেছে। তার ওপর ট্রাফিক সার্জেন্টের এমন আচরণ এবং তার ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে পুলিশের প্রতি বিদ্বেষ বাড়বে।
ঘটনার পর করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি দক্ষিণ) খান মোহাম্মদ রেজোয়ান বলেন, ওই ট্রাফিক সার্জেন্টকে ক্লোজ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ট্রাফিক দক্ষিণের এডিসি সোমাকে বিষয়টি অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সার্জেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ব্যাচে যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেহেদী এখনও শিক্ষানবীশ পর্যায়ে রয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়।
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন