ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক দেশব্যাপী জুমার নামাযের খুতবা নির্দিষ্ট করে দেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে এটাকে ধর্মীয় বিষয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপ অবিহিত করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ঈমান-আক্বীদা ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটি মসজিদের খতীবগণের প্রতি আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ মানুষ, সমাজ ও দেশ গঠনমূলক পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামের শুরু থেকে চলে আসা নিয়মে খুতবাদানের আহ্বান জানান। একই সাথে হেফাজতে ইসলাম আগামী ২৯ জুলাই শুক্রবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে সন্ত্রাস বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের এক বৈঠকে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সম্প্রতি দেশে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা, খুন, গুম এর আশংকাজনক বৃদ্ধি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক দেশের মসজিদ সমূহে জুমার বয়ান ও খুতবা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়ে গতকাল (রবিবার) হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন হেফাজত আমীর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। শরীক ছিলেন মহাসচিব প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, নায়েবে আমীর ও ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী, সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী, আমীরের প্রেসসচিব মাওলানা মুনির আহমদ, কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান পেশোয়ারী, মাওলানা হাকীম আব্দুল করীম খান, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মুফতী আব্দুস সাত্তার, মুফতী আজহারুল ইসলাম, মাওলানা শরীফুল্লাহ প্রমুখ।
বৈঠকে সন্ত্রাসী হামলা, খুন, গুমসহ সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি এবং মানুষের মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার হরণের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীসহ দেশের আলেম সমাজের আরো বেশী ভূমিকা রাখার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই লক্ষ্যে মানুষের দ্বারে দ্বারে শান্তির ধর্ম ইসলামের সঠিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে আরো বেশী তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ধর্মহীন শিক্ষানীতি চালু হওয়ার পর থেকে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভর্সিটির ছাত্ররা সঠিক ইসলামী জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যে কারণে দেশের দুশমনরা সন্ত্রাসী কাজে ইসলামের জিহাদের অপব্যাখ্যা করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এই জন্যে আলেমদেরকে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো বেশী ধর্মীয় সভা-সেমিনার আয়োজনে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, এসব সভা-সেমিনারে পবিত্র কুরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামের সুন্দর বাণীসমূহ এবং ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক দেশ ও সমাজ গঠনের বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি সমাজে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, খুনাখুনি, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ ও অমুসলিম নাগরিকদের উপর অন্যায়-অত্যাচারের বিষয়ে ইসলামের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারী ও ধমকির বিষয়ে পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ তুলে ধরে বক্তব্য রাখতে হবে।
বৈঠকে উলামায়ে কেরাম, মসজিদের ইমাম-খতীবকে সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণায় সহযোগিতা করার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, দেশ ও সমাজ থেকে সন্ত্রাস ও সকলপ্রকার অন্যায়-অবিচার নির্মুলে সরকার যদি প্রকৃতই আন্তরিক হয়ে থাকে, তবে তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং অবশ্যই সহযোগিতা করবে। বৈঠকে আগামী ২৯ জুলাই শুক্রবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাদ জুমা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে সন্ত্রাস বিরোধী বিশাল বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হেফাজতের ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিকে সন্ত্রাসবিরোধী ব্যাপক জনমত গঠনের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সন্ত্রাস বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে জোরালো প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে বৈঠক থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হেফাজত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বৈঠকে সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক দেশের জামে মসজিদসমূহে প্রেরিত বিতর্কিত ও ভুলে ভরা খুতবা প্রত্যাখান করে বলা হয়, এক সময় তারা নামাযের সূরা-ক্বিরাতেও বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চাইবে। ইবাদত-বন্দেগীতে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের হঠকারিতা দেশের মুসলমানরা মেনে নিবে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তার ডিজি’র নানা ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডে এমনিতেই দেশের মুসলমানরা চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। নামায ইসলামের মৌলিক ইবাদত। নামায-রোযাসহ ইসলামের ইবাদত-বন্দেগীকে দলীয়করণ ও সরকারীকরণ করা যায় না। দেশের উলামা-মাশায়েখ ও দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলিম জনতা ইবাদত-বন্দেগীতে সরকারের অবৈধ ও অন্যায় হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণারোপ কখনোই বরদাস্ত করবে না। হেফাজত নেতৃবৃন্দ ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ইবাদতে হস্তক্ষেপ করে মুসলমানদেরকে ভয়ানক বিক্ষুব্ধ করে তোলার বিধ্বংসী মিশন বন্ধ করার আহ্বান জানান।
বৈঠকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, পবিত্র জুমার খুতবা ওয়াজিব ইবাদত। মসজিদের খতীবগণ নামাযের আগে আরবী ভাষায় পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূল (সা.)এর হাদীস সন্নিবেশিত খুতবা দিয়ে আসছেন ইসলামের শুরু থেকেই। খুতবার পূর্বে কোন কোন মসজিদে কুরআন-হাদীসের আলোকে খতীব সাহেবগণ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুসল্লীগণের উদ্দেশ্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা মতে চলা, যে কোন অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নামায-রোযাসহ ইসলামের বিধি-বিধান সঠিকভাবে পালনের নিয়মত-কানুন নিয়ে শিক্ষামূলক বয়ান রাখেন। খতীব সাহেবগণ খুতবা পূর্ববর্তী বয়ান প্রকাশ্যেই দিয়ে থাকেন, যা সকল মুসল্লী শুনে থাকেন। আর মুসল্লীদের মধ্যে সরকারী-বেসরকারী নানা পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল দলমতের মানুষ থাকেন, মসজিদ কমিটির লোক থাকেন। সুতরাং খতীব সাহেবদের কোন বিভ্রান্তিমূলক বয়ান পেশের সুযোগই নেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ পর্যায়ে সরকার চাইলে মসজিদের খতীবগণকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ইসলামের আলোকে বয়ান উপস্থাপনের জন্যে অনুরোধ করতে পারেন। আর সরকারের জনস্বার্থমূলক অনুরোধে খতীবসাহেবগণ অবশ্যই সহযোগিতা করবেন। কিন্তু খুতবা লিখে দিয়ে তা পড়তে বাধ্য করা, মসজিদসমূহ নজরদারির প্রচারণা এগুলো সুষ্ঠু চিন্তা নয়। কোন অমুসলিম দেশেও এতটা ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব দেখা যায় না। তারা বলেন, এই যে হঠাৎ করে মসজিদের ইমাম-খতীব ও ওয়াজ-মাহফিল নজরদারির ব্যাপক প্রচারণা, সরকারীভাবে খুতবা নির্ধারণ, এতে তো বিশ্ববাসীর এমন ভাবনা জাগতে পারে যে, বাংলাদেশের লাখ লাখ মসজিদের খতীব জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণের কাজে জড়িত। হেফাজত নেতৃবৃন্দ মুসলমানদেরকে নানাভাবে বার বার বিক্ষুব্ধ করে তোলার মিশন পরিত্যাগের জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইসলাম উচ্ছেদ নয়, বরং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে পদক্ষেপ নিন।
Courtesy: ইনসাফ টোয়েন্টিফোর ডটকম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন