11 Jul, 2016 আবারো কমে গেল রেমিট্যান্স প্রবাহ। দীর্ঘ ২১ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। গত অর্থবছরে এর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এটা আবারো কমে সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৪৯২ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। এ বছরে কম এসেছে প্রায় ৪০ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্লেকেরা নানা কথা বলেছেন। তাদের মতে, দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৬৭ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে গত কয়েক বছর ধরে যে হারে শ্রমিক ফিরে এসেছে ওই হারে যায়নি। বরং কয়েকটি দেশে শ্রমিক নেয়াই একপ্রকার নিষিদ্ধ রয়েছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বে নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে না পারলে সামনে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরের প্রায় সারা মাসজুড়েই রেমিট্যান্স কম এসেছে। যেমন অর্থবছর শুরু হয়েছে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। গত জুলাই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের তিন মাস অর্থাৎ আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সামান্য বেড়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে ছিল; কিন্তু নভেম্বরে আবার তা কমে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যায়। ওই মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে হয় ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে সামান্য বাড়লেও জানুয়ারি থেকে একটানা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। যেমন জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, মার্চে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, এপ্রিলে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং মে মাসে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়। এমনকি বছরের শেষ মাস অর্থাৎ ঈদের মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। সাধারণত প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে তাদের আত্মীয়পরিজনের কাছে বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠান; কিন্তু এবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রেমিট্যান্স প্রবাহের আগের বছরগুলোর মতো রেমিট্যান্স আসেনি। ফলে এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তার আমলে অর্থাৎ চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেযা হয়েছিল। ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে রেমিট্যান্স আনার নীতিমালা সহজ করা হয়েছিল। এরই ভিত্তিতে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বেড়েছিল, যার প্রভাব পরবর্তী কয়েক বছরে ছিল; কিন্তু হঠাৎ করে গত কয়েক বছরে শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিক ফিরে আসতে থাকে; কিন্তু যে হারে ফিরে এসেছে সে হারে অন্য কোনো বাজারে যায়নি। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিক ফিরে আসার কারণ হিসেবে তিনি জানান, প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে যে হারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার কথা ছিল সেই হারে হয়নি। ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করেছে ভারতসহ অন্যান্য দেশ। দ্বিতীয়ত, প্রবাসীরা দেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠান ফ্যাট, বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করার জন্য; কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্যান্য খাতের মতো, আবাসন খাতেও বিরাট ধস নেমেছে। কয়েক বছর ধরে আবাসিকে নতুন করে গ্যাসসংযোগ বন্ধসহ নানা প্রতিকূলতায় এ খাতের খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছে। সব মিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তৃতীয়ত, বিনিয়োগ মন্দার কারণে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। আর ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ায় টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমে গেছে। সব মিলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী হতে পারেÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ গভর্নর জানিয়েছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বেশি রয়েছে। এ কারণে আপাতত এর কোনো প্রভাব পড়বে না, তবে যখন বিনিয়োগ চাহিদাসৃষ্টি হবে তখন বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যাবে, এতে টান পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখন থেকেই নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে বিদেশগামীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর বলেন, রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য থেকে গত কয়েক বছর ধরে যে হারে শ্রমিক ফিরে এসেছে ওই হারে যায়নি। এ কারণে মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। তিনি আশঙ্কা করেন, যে হারে কমে গেছে তা অব্যাহত থাকলে সামনে চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক হয়ে পড়বে। বিনিয়োগচাহিদা সৃষ্টি হলে বৈদেশিক মজুদে টান পড়বে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেন শ্রমিক ফিরে আসছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। যে কারণে ফিরে আসছে তার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন