এই প্রসঙ্গে ইসলামি ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব নুরুল ইসলাম খলিফা একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেই পোস্ট দেখেই আমার এই অবতারণা।
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার প্রমোশন না দেয়ার ফলে ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের মাঝে যে হতাশা দেখা দিয়েছে এবং সোশাল মিডিয়া জগতে তার যে বহিঃপ্রকাশ দেখা দিয়েছে তাতে ইসলামি ব্যাংকের নির্বাহীদেরকেই দায়ি করা যায়। তবে প্রমোশোন বঞ্চিতদের এই যে হতাশা প্রকাশ তা ইসলামি ব্যাংকের কর্মচারীদের নিকট থেকে যে প্রত্যাশিত আচরণ তার সাথে বেমানান এবং অবশ্যই এটি একটি অশনি সংকেত। আবার, এটিও ঠিক যে, প্রমোশোন কোন সমাধান নয় এবং এই প্রমোশোনের মাধ্যমে এই সমাধান খোঁজা সুবিবেচনা প্রসূতও নয় বলে আমি মনে করি।
আমরা জানি, পৃথিবী এবং এখানে ঘটমান যে কোন বিষয়কে ব্যাখা করার ডমিন্যান্ট দুটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে- একটি সেকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যটি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই আলোচনা তাই ইসলাম বনাম সেকিউলার চিন্তায় সমীকৃত হয়। ইসলামি ব্যাংকসহ অন্যান্য হাতেগোণা কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ইসলামকে ব্র্যান্ড হিসাবে ব্যবহার করে এবং ইসলামকে তাদের গাইডেন্স সোর্স হিসাবে উল্লেখ করে থাকে। স্বভাবতই ইসলামি ব্যাংকের নিকট থেকে ইসলামি আচরণই প্রত্যাশিত।
কর্পোরেট যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তেমন জটিলও বটে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার এক অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে - মোটিভেশন। বর্তমান যুগে আমরা মোটিভেশনের যে সকল তত্ত্ব দেখে থাকি সেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ক্লাশিক্যাল তত্ত্ব এবং পোস্ট ক্লাসিক্যাল বা আধুনিক তত্ত্ব। উভয়ই তত্ত্বের মধ্যে এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হচ্ছে আব্রাহাম মাশলোর “হায়ারারকি অফ নিডস” তত্ত্ব। এই তত্ত্বে মানুষের যে পাঁচটি চাহিদার কথা বলা হয়েছে সেগুলো ক্রমানুসারে হচ্ছে- জৈবিক চাহিদা, নিরাপত্তা, ভালবাসা, সম্মান ও ক্ষমতা (Physiological
Needs, Safety and Security, Love & Belongingness, Self Esteem, Self
Actualization) । ক্লেইডন আল্ডারফারের “আর্গ তত্ত্ব” (ERG Theory) তে এই পাঁচটি চাহিদাকে “অস্তিত্ব রক্ষা, পারস্পরিক সম্পর্ক, এবং বৃদ্ধি (Exixtence needs, Relatedness needs
and Growth needs)” এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং এসকল চাহিদা একই সাথে একই ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে যা মাশলোর তত্ত্বে অনুপস্থিত ছিল। উল্লেখ্য, আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সেকিউলারিজম কে ভিত্তি হিসাবে ধরে নিয়েই গড়ে উঠেছে। ফলে মানব সম্পদ উ ন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সকল ক্ষেত্রেই সেকিউলারিজম ভিত্তিক তত্ত্ব দর্শন গড়ে উঠেছে। পশ্চিমা সমাজের সর্বত্রই এই সেকিউলার ফিলোশোপফির ভিত্তিতে রচিত এবং এর প্রভাবও কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান। চাকুরীর বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন ইত্যাদির মাধ্যমে সম্মান ও পার্থিব ক্ষমতার্জন ইত্যাদিই হচ্ছে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের নেই কোন পরকালিন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ফলে তারা পরিতৃপ্ত হতে চায় এই নশ্বর জগতেই। তাদের মূলনীতি- “খাও, দাও আর ফূর্তি কর”। ফলে চাকুরি কিংবা ব্যবসার আর্থিক মুনাফার্জন, সম্মানার্জন ক্ষমতার্জনে ব্যর্থ হয়ে হতাশাগ্রস্থ জীবনযাপন পশ্চিমাদের এক অতি পরিচিত চিত্র।
মুসলিম প্রধান দেশে ইসলাম কে ভিত্তি করে এবং ইসলামের গাইডেন্স অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্যেই ইসলামি ব্যাংকের জন্ম ও বিকাশ। এই ব্যাংকের প্রথম দিকেই এই শ্লোগানকে সামনে রেখেই এর কর্মসূচী নির্মিত হয়েছিল। এর যারা এমপ্লয়ি নিযুক্ত হয়েছিলেন তারাও নিশ্চয়ই এই শ্লোগান দেখে, মুগ্ধ হয়ে এখানে যোগাদান করেছিলেন। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এই ব্যাঙ্কের শত ভাগ বিনিয়োগকারি ছিলেন সুদমুক্ত অর্থনীতি ব্যবস্থার চরম সমর্থক ও লড়াকু সৈনিক। ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা জনগণের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেই অর্থ উদ্যক্তাদের নিকট বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ সংগ্রহ এবং বিনিয়োগ প্রদান এই দুয়ের মাঝে যে প্রফিট মার্জিন তাই হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার ইন্সেন্টিভ। নিঃসন্দেহে তাই বলা চলে, একটি ব্যাংক গড়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের মাঝে এর বিনিয়োগকারিদের ভূমিকাই মুখ্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে এবং বর্তমানের সুদি বিশ্ব অর্থনীতির মাঝে সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠা একেবারে সহজ কথা নয়। ব্যাংকের প্রথম দিকে উদ্যোক্তা এবং কর্মকর্তাচারিদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকলেও এই ব্যাংকের যারা বিনিয়োগকারি তাদের জন্য পার্থিব কোন ইন্সেন্টিভ কিংবা প্রণোদনা ছিলনা। স্রষ্টা প্রদত্ত বিধান অনুসারে স্রষ্টার সন্তোষ অর্জনই ছিল এই বিনিয়োগকারিদের একমাত্র আরাধনা ও প্রণোদনা। ক্লাসিক্যাল কিংবা আধুনিক কোন তত্বেই এই বিনিয়োগকারিদের উৎসাহ প্রদানের কোন সূযোগ নেই। কারণ প্রচলিত যে কোন সুদি অর্থনীতির ব্যাঙ্কেই এই সকল বিনিয়োগকারিদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও আর্থনীতিক মুনাফাই ছিল অধিকতর নিরাপদ।
উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী এই তিন স্তর মিলেই হচ্ছে ব্যাঙ্কের প্রাণসত্তা। উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী এই তিন গ্রুপের সদস্যদের যে স্বার্থ তা অনুধাবনের মাঝেই রয়েছে ইসলামি ব্যাংকের শক্তিশালি ভিত্তি। কারণ ইসলামি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠিত হবার যে ভিত্তি ও দর্শন তা কিন্তু অধিকতর মুনাফা অর্জন নয়। বরং আল্লাহর বিধান প্রতিপালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন। সুদমুক্ত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা হলে সামগ্রিক সমাজের উন্নয়ন হবে, এটি প্রমানিত। আর গোটা সমাজের উন্নয়ন হলে, সেই সমাজের সকল নাগরিকদের জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন হবে, এটিও সত্য। কিন্ত সামগ্রিক সমাজের উন্নয়ন আর ব্যাংকের প্রফিট মার্জিন বেশি হওয়া কিংবা কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রমোশন ও বেতন ভাতা বেশি হওয়া এক কথা নয়। ইসলামি ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর সাথে প্রচলিত সুদ-ভিত্তিক অন্যান্য ব্যাংকের যেমন পার্থক্য, এই ব্যাংকের বিনিয়োগকারি গ্রাহকদের সাথে প্রচলিত সুদ-ভিত্তিক অন্যান্য ব্যাংকের বিনিয়োগকারিদের যেই পার্থক্য সেই পার্থক্য থাকা উচিত প্রচলিত সুদ-ভিত্তিক ব্যাংককর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে ইসলামি ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারিদের। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, এখানেই রয়েছে প্র্যতাশা ও প্রাপ্তির মাঝে এক বিশাল ব্যবধান যা হতে পারে ইসলামি ব্যাঙ্কের জন্য এক অশনিসঙ্কেত।
ইসলামি ব্যাংকে বিদ্যমান এই ব্যবধান বুঝা ইসলামি ব্যাঙ্কের নির্বাহী কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কারণ উদ্যোক্তা কিংবা বিনিয়োগকারিদের উদ্দেশ্য যতই মহৎ থাকনা কেন, ব্যাংকের পুঁজি সঞ্চালন ও ব্যবহারের পুরো ক্ষমতা অর্পিত থাকে ব্যাংকের নির্বাহী ও কর্মকর্তাদের হাতে। আর এই বিষয়টি সম্যকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত ও প্রচলিত সমাজ কাঠামো ও সমাজ দর্শনের সম্যক, সঠিক, আবেগহীন, নির্মোহ এক বিশ্লেষণ।
একজন ব্যক্তি যখন কোন ইসলামি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসাবে এগিয়ে আসেন তখন তিনি থাকেন একজন পরিণত বয়স্ক, যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ। আব্রাহাম মাশলোর তত্ত্বানুসারে বলা যেতে পারে, এ সকল উদ্যোক্তারা জীবনের পাঁচটি চাহিদা পূরণের পর এগিয়ে আসেন ষষ্ঠ চাহিদা পূরণে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তা, ভালবাসা, সম্মান কিংবা ক্ষমতা এসবের মোহ থাকেনা। তারা ইসলামি জ্ঞান এবং এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও থাকেও অনেক সচেতন। অন্যদিকে, যারা ইসলামি ব্যাংকে বিনিয়োগকারি তারাও এক ধরণের উদ্যোক্তা এবং অন্যান্য গুণাবলীতে তারাও উদ্যোক্তাদের কাছাকাছি। এই দুই গ্রুপের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে - উদ্যোক্তারা উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারিদের চেয়ে একটু বেশি সাহসী ও অগ্রগামি।
কিন্তু ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিষয়টি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। তারা বয়স, শিক্ষা দীক্ষা, অভিজ্ঞতা, ইসলামের জ্ঞান ও বাস্তব জীবনে তার অনুসরণ ইত্যাদি যে কোন ক্ষেত্রেই উপর্যক্ত দুগ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে। আমরা জানি, বাস্তবসম্মত কারণেই চাকুরীতে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ফ্রেশ গ্রাজুয়েটরা। তারা বয়সে যেমন তরুণ, তেমনি অনভিজ্ঞ। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সেকিউলার শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই ব্যাংকের চাকুরিতে নিয়োগকৃত এই ফ্রেশ ফ্রেস গ্রাজুয়েটরা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা্, ইসলামি অর্থনীতি, সুদমুক্ত অর্থনীতি, প্রকৃত কল্যাণ অর্থনীতি ইত্যাদির সাথে যেমন অপরিচিত বা কম পরিচিত। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের খপ্পরে পড়ে এরা ইসলামি জীবন-যাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার এবং ইসলামি জীবন যাপনের কলা কৌশল সম্পর্কেও জ্ঞাত হবার সূযোগ পাচ্ছেনা। ফলে এই সকল তরুণ, অনভিজ্ঞ, সেকিউলার চিন্তা দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত, ইসলামি জ্ঞান-বিশ্বাস ও কলাকৌশল সম্পর্কে অনবহিত কর্মকর্তাদের ইসলামি ব্যাঙ্কিং সেবা দানের বিষয়টি অনেকটা অসম্ভবও বটে।
আধুনিক শিক্ষিত তরুণরা সময়ের সৃষ্ট। এটি তাদের কোন অন্যায় নয়, নয় অপরাধ। কারণ তারা যে বয়সে বেড়ে উঠে সে বয়সে তারা নিজেরা গাইডেড হতে পারেনা। তারা অন্যদের দ্বারা গাইডেড হয়। কাজেই এই সকল তরুণ গ্রাজুয়েটদের ইসলামি ব্যাংকে নিয়োগের পর যে বিষয়টি সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন -সেটি হচ্ছে রিগোরাস ট্রেইনিং। কারণ একমাত্র ট্রেনিং এর মাধ্যমেই সম্ভব তাদের সামনে সেকিউলার চিন্তার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া, ইসলামি চিন্তা দর্শনের সকল দিক উপস্থাপন করা, ইসলামি শিক্ষার মৌলনীতি ও সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত করানো, ইসলামের স্বর্ণযূগের কারণ ও তার ধারাবাহিক ইতিহাস অবহিত করা, এবং তাদেরকে ইসলামি জীবনাচার অনুসরণে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তোলা। ইসলামি ব্যাংকের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ইতিহাস, এর অনন্য বৈশিষ্ট্য, ইসলামি সুদ মুক্ত অর্থনীতির প্রকৃত কল্যাণ, দারিদ্র দূরিকরণে এর ভূমিকা, নারি-শিশু ও অসহায়দের উন্নয়নে এই সুদ-মুক্ত, অংশিদারিত্বভিত্তিক অর্থনীতির অবদান ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন, এটি বাস্তবায়নের যারা লড়াকু সৈনিক তাদের গুরুত্ব উপলধ্বি করানো, অনুপ্রেরণাদান ইত্যাদির মাধ্যমেই কেবল অপসংস্কৃতি ও সেকিউলার পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা তরুণ গ্রাজুয়েটদের কে নব উদ্যমে, নব চেতনায় শানিত করে নব জীবন পরিচালনায় আগ্রহী করে তোলা সম্ভব।
আমার অভিজ্ঞতায়, এই বিষয়টি অনুধাবন, এবং এর জন্য গৃহিত কলাকৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই ইসলামি বাংকের রয়েছে সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। কারণ ইসলামি ব্যাংকের গ্রেড লেভেল, মাইক্রোক্রেডিট লেভেল কিংবা প্রবেশনারী, যে কোন লেভেলেই হোক না কেন, নতুন কর্মকর্তা- কর্মচারি নিয়োগের পর তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। যা আছে তা সময়ের বিবেচনায় যেমন অপর্যাপ্ত, তেমনি কোর্স কন্টেন্ট কিংবা প্রশিক্ষণের মানের বিবেচনাতেও অপর্যাপ্ত। যে প্রশিক্ষণ ছিল ছয় মাসের, তা এখন আনা হয়েছে এক মাসে। ফলে একজন আধুনিক সেকিউলার শিক্ষা-দীক্ষার্জনকারি, এবং এই চর্চার ভেতর দিয়ে লালিত পালিত এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মন-মানসিকতার যে পরিবর্তন হবার কথা তা হয়না। এর ক্রমাগত প্রভাব দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের কর্মচারীদের জীবন যাপনে ও সেবা প্রদানের মাঝে।
আর তরুণ অফিসারদের অ্থনীতি কিংবা ব্যাংক পরিচালনার বাইরে জীবনের অন্যান্য দিক সম্পর্কে আর কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নেই দীর্ঘ মেয়াদি কোন পরিকল্পনা। নেই উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশে কিংবা বিদেশে পাঠানোর কোন কাঠামো। জীবনের যে সকল দিক একজন মানুষের সামগ্রিক জীবনাচারকে প্রভাবিত করে সেই সব বিষয়ে ব্যাংকের বিনিয়োগ একেবারেই কম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দর্শন, ঐশী জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দৃশ্যমান কোন ভিশন অনুপস্থিত। তাই এই সকল বিষয়ে মনোযোগ দেয়া আবশ্যক।
এই বিষয়টি প্রভাব ফেলছে ব্যাংকের সিনিয়র নির্বাহীদের মাঝেও। একটি ইসলামি ব্যাঙ্কের শক্তি-মত্ততা যখন ফুটে তার সর্বমোট লাভের পরিমাণের উপর, যখন ব্যাংকের সকলকে দেখা যায় ব্যাংক কত লাভ করলো তার উপর ভিত্তি করে আনন্দ করতে, তখন এই ব্যাংক কিংবা ব্যাংককর্মচারীদের নিকট কিইবা বা আর প্রত্যাশা করা যেতে পারে। ব্যাংক অবশ্য প্রফিট করবে, এর কোন বিকল্প নেই। তাই বলে প্রফিট করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে, এটিই যদি হয়ে ব্যঙ্কের সফলতার মাপকাঠি, তাহলে ইসলামি অর্থণীতির কল্যাণ সাধণ হবে কিভাবে। বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করায এতে পারে- বিবাহ এবং ব্যাভিচারের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য থাকলেও অনেক বৈশাদৃশ্য রয়েছে। বিবাহ অনেক ব্যা্পক বিস্তৃত ও কল্যাণকর। বিবাহিত জীবনেও সেক্স, প্রজনন ও জনসংখ্যার গণণা সবই আছে, ছিল, থাকবে। কিন্তু সেক্স কিংবা প্রজনন কোনটাই মুখ্য নয়, মখ্য হচ্ছে স্রষ্টার ওনুশাসন অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর সন্তোষ অর্জন করা। কিন্তু ব্যাভিচার একটি সংকীর্ণ পাপাচারক্রিয়া, সেক্সই এখানে মুখ্য, অনিয়ন্ত্রীত খায়েস মিটানোই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। । ইসলামি ব্যাংক এবং সুদ ভিত্তিক ব্যাংকের বিষয়টি ও এমনি।
ইসলামই ব্যাংকেও লাভ থাকবে, কিন্তু সেটি একমাত্র বা মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে পড়বেনা। সেটি সর্বোচ্চ হতে পারে একটি উপায় বা টুল মাত্র
ইসলামি ব্যাংকের অফিসারদের মাঝে প্রমোশোন নিয়ে দৃশ্যমান এই প্রতিক্রিয়া তাই একবারে অবাঞ্চিত নয়। এমনকি এই প্রতিক্রিয়া খুব মারাত্মক কিংবা সর্বশেষ কোন প্রতিক্রিয়াও নয়। আমাদের ধারণা, এই প্রতিক্রিয়া কেবল মাত্র ব্যাংকের কর্মকর্তা-নির্বাহীদের মাঝে বিদ্যমান শত সমস্যার একটি প্রকাশিত কণামাত্র। সমুদ্রে ভাসমান আইসবার্গের অগ্রভাগ তুল্য। তাই এখনই সাবধান হওয়া দরকার। হয়তো প্রমশোন কিংবা বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে এর আপাত সমাধান সম্ভব, কিন্তু প্রকৃত সমস্যা আরো অনেক বেশি গভীর এবং তার সমাধান প্রক্রিয়াও আবশ্যিকভাবে ভিন্ন। পদ, প্রমোশন, বেতনই সমস্যা নয়। সমস্যা “জীবনবোধের” ধারণার ক্ষেত্রে। সমস্যা জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সমস্যা সেকিউলার জীবনবোধ কে বুঝার, অনুধাবনের। সেকিউলার জীবনদর্শন হতে ইসলামি জীবনদর্শন কে আলাদা করার, তা মেনে চলার প্রতিজ্ঞার। এই সমস্যাটি দর্শনজাত এবং তাই দর্শনজাত সমস্যাকে দর্শনের সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব। আর তাই আপাত সমাধান করে ক্ষান্ত দিলেই চলবেনা, সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করে একে সমূলে উৎখাত করতে হবে, নইলে তা একদিন তা ব্যাংকের জীবন নাশ করে ফেলতেও কার্পন্য করবেনা।
মনে রাখতে হবে, ইসলামি ব্যাংক কোন সাধারণ ব্যাংক নয়। সুদমুক্ত অর্থনীতি কোন সাধারণ শ্লোগান নয়, নয় জাতীয় পর্যায়ে সীমিত কোন পদক্ষেপ। গ্লোবাইজড এই বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে আমরা অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি যাই দেখি না কেন সবই হচ্ছে পশ্চিমাদ্ভূত এবং তাদের নির্দেশ ও পরচালনায় পরিচালিত। আর অর্থনৈতিক শক্তি সকল জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শনের চালিকাশক্তি। আর্থনীতিক কাঠামোর পুরোটাই হচ্ছে সুদ ভিত্তিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। ফলে সুদভিত্তিক কাঠামোর বিপরীতে যদি সুদমুক্ত ইসলামি অংশীদারিত্বভিত্তিক আর্থনীতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি ও এর পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের জন্য কল্যণ বয়ে আনবেনা। এই ইসলামি অর্থনীতি ব্যবস্থার সফলতাও তারা চেয়ে চেয়ে দেখবেনা, এটিই স্বাভাবিক। ফলশ্রুতিতে এর বিরুদ্ধে থাকবে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্র যা মোকাবিলা না করে সামনে এগিয়ে যাওয়া ইসলামি ব্যাংকের জন্য সম্ভব নয়।
সেকিউলারিজম হচ্ছে একটি দর্শন, একটি আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে সেকিউলারিমের আলোচনা, ডিসকোর্স এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লষণ ও মূলনীতি। ষোড় শতকের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেকিউলারিজমের যে বিকাশ তা বিশাল মহিরুহের আকার ধারণ করেছে। জন্ম থেকে মত্যু, সকাল থেকে সন্ধ্যা, সকালের ঘুম ভাংগার পর হতে পুনরার ঘুমুতে যাবার স্ময় পর্যন্ত, এমনকি ঘুমের সময়টুকুও কিভাবে কাটাতে হবে তারও সেকিউলার ব্যাখ্যা রয়েছে। পড়াশুনা, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি বাকুরি, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সেক্স-প্রজনন, নারি পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, সন্তান সন্ততি, পিতামাতা, বাড়িঘরসহ জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র ও ব্যাপ্তি নেই যেখানে সেকিউলারি ব্যাখ্যা তার আধুনিক, চমকপ্রদ, রংবাহারি, মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক রুপে হাজির নেই। এই সেকিউলারি ব্যখ্যা আমাদের চারপাশে এমন সব ডিসকোর্স হাজির করেছে যাতে আমাদের সব পূর্ব পুরুষকে, এবং তাদের সকল চিরন্তন সংস্কৃতি, ধর্ম, পোশাক আষাক, সকল চিন্তা পদ্ধতিকে আমাদের নিকট আজ সেকেল, প্রাচীন, গেঁয়ো এবং অচল বলে প্রতিভাত হয়। প্রাচীণ এবং মধ্যযুগকে এমনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যে, আমরা অতীতকে সম্মান করার মত সাহসই করতে পারিনা। এ হচ্ছে সেকিলারের এক বিশাল পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র। সেকিউলার দর্শন এবং এর সকল প্রকাশভঙ্গিকে যাতে আমরা ক্রিটিক করতে না পারি, সেই জন্য সেকিঊলার আমাদের সকল অতীত ঐতিহ্য, গর্বকে আমাদের নিকট অকেজো, আযাচিত ও অনাধুনিক হিসাবে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আজ আমারা এই লড়াইয়ের স্বীকার হচ্চি। আমারা চাই বা না চাই, জানি বা না জানি, আমরা কিন্তু প্রতিটি মুহুর্ত এই সেকিঊলার চিন্তাদর্শনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করছি। তারা যেভাবে তাদের লেন্স দিয়ে পৃথিবীটাকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে আমরাও ঠিক সেভাবেই দেখছি, মূল্যায়ন করছি, আমাদের পছন্দ অছন্দের ঢালি সাজিয়ে চলছি।
ইসলামি ব্যাংকি কিনতি জীবনের একটি মাত্র অংশ মাত্র। অ্থনীতি জীবনের অনেক কাজের একটমাত্র মাত্র কণা। তাই সুদমুক্ত অর্থনীতি মেনে চলা সম্ভব নয় যতক্ষণ না আমরা আমাদের জীবনের অন্যান্য অংশকে ইসলামের রঙ্গে সাজানোর চেষ্টা করবো। আর আমাদের সামগ্রিক জীবনকে ইসলামের আলোকে সাজাতে হলে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের জ্ঞান, এর আলোচনা, এর প্রশিক্ষণ এবং মেনে চলার অনুপ্রেরণা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাঙ্কের উদ্যোগ একেবারেই অনুপস্থিত। নেই বললেই চলে। মনে রখতে হবে, নারি,সেক্স, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি, পতিতাবৃত্তি, মদ, মাদক, জুয়া, যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া যেমন সেকিউলার অর্থনীতি তথা পশ্চিমা দর্শন টিকে ঠাকতে পারেনা, তেমনি একজন মুসলমানের সামগ্রিক জীবনকে ইসলামের আলোকে সাজানোর সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ব্যতীত কখনোই ইসলামের আংশিক আচার-আচরণকে ধারণ করা সম্ভব নয়।
তাই ইসলামি অর্থনীতি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যান্য শাখা -প্রশাখাকে ক্রমাগত ইসলাময়িত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। নতুবা এই ইসলামি অর্থনীতি যেমন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা, তেমন সম্ভব হবেনা এই কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অন্যান্য নির্বাহীদের থেকে ইসলামি আচরণ পাওয়া। প্রমোশন না পেয়ে হতাশা, কিংবা ভাল জায়গায়/ শাখায়/ডেস্কে পোস্টিং না পেয়ে মানসিক কষ্ট এক ধরণের সেকিউলার আচরণ, যা আমাদের চারপাশের সেকিউলার সমাজ-দর্শন থেকে অন্যান্য অনেক গুণাবলীর ন্যায় আমাদের ভেতর আবেশিত হয়েছে।
এহেন পরিস্থিতিতে যা করণীয় তা শুরু করবে কে, কোথা থেকে আসবে এই উদ্যোগ। অবশ্যই এটি আসতে হবে- উভয়ই দিক থেকেই। “শীর্ষবিন্দু থেকে পাদবিন্দু” এবং “পাদবিন্দু থেকে শীর্ষুবিন্দু” উভয়ই পদ্ধতিই অনুসৃত হতে হবে। শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ব্যাংকের ডাইরেক্টরবৃন্দ আর পাদবিন্দু্তে রয়েছে ব্যাংকের কর্মচারীবৃন্দ। তাই ব্যাংক পরিচালকদের যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি উদ্যোগী হতে হবে ব্যাংক কর্ম নির্বাহীদের। এই যৌথ উদ্যোগেই সম্ভব হতে পারে দৃশ্যমান এবং বিদ্যমান সকল সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
কি হতে পারে সেই সমাধান? “মানুষের চাহিদা অসীম”। সেকিউলার অর্থনীতিতে আলোচিত একটি অতি পরিচিত, জননন্দিত ও গৃহীত তত্ত্ব। দুঃখের বিষয়, এর বিপরীতে ইসলামি তত্ত্বের যে বাণী তা আমাদের নিকট পরিচিত না । ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি “সম্পদের মালিকানা আল্লাহর, সেই সম্পদের সদব্যবহারের দায়িত্ব বান্দার” এই তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। সম্পদের সঠিক ব্যবহারের উপরই নির্ভর করছে বান্দার সফলতা তথা আল্লাহর সন্তোষ। একজন মুসলমানের নিকট তাই “আর্থনীতিক চাহিদা কখনোই একজন একত্ববাদি বান্দার নিকট অসীম নয়, বরং অসীম হচ্ছে সম্পদের সদব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের অভিলাস ও অভিপ্রায়”। আর এটি সম্ভব একমাত্র স্পিরিচুয়ালিটি তথা আধ্যাত্মিকতা অর্জনের মাধ্যমে; অধিকতর মুনাফা, বেশি বেতন, মানুষের বানানো তথাকথিত বড় বড় পদ-পদবী (যা খুবই আপাত একটি বিষয়), সম্মান, ক্ষমতা, প্রমোশন এসবের মাধ্যমে নয়।
আর এই বিষয়টির প্রতিধ্বনি দেখা যায়, আব্রাহাম মাশলোর “হায়ারারকি থিওরি অব নিডস” এর ষষ্ঠ স্তর আবিস্কারের মাধ্যমে। ১৯৪৩ সালে সাইকোলজিক্যাল রিভিউ জার্নালে “এ থিওরী অব হিউম্যান মোটিভেশন” নামে তিনি যখন এই গবেষণা প্রকাশ করেন, তখন তিনি মানুষের চাহিদাকে পাঁচটি স্তরে বিভক্ত করেছিলেন। এই পাঁচটি চাহিদার সবগুলোই ছিলো দৈহিক বা পার্থিব চাহিদা। এখানে স্পিরিচুয়ালিটি বা আধ্যাত্মিকতার স্থান ছিলোনা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার এই গবেষণার ষষ্ঠ স্তর আবিস্কার করেন। এটি হচ্ছে-
"Self-Transcendence যা দৈহিক বা পার্থিব চাহিদাকে অতিক্রম করে মানুষের চাহিদাকে আধ্যাত্মিকতার দিকে নিয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন