বাংলাদেশের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা কদর পেয়ে চলেছে। এই সরকার ব্যবস্থার সুফল ইতোমধ্যে পেয়েছে পাকিস্তান, নেপাল ও বুলগেরিয়া। আর এখন তা তুরস্ক ও গ্রীসে গৃহীত হয়েছে।
সর্বশেষ গ্রীসে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবার কথা জানা গেছে। গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সামাল দিতে গ্রীসের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ভাসিলিকি থানৌর (৬৫) নেতৃত্বে গত ২৭ আগস্ট এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। দেশটিতে এই প্রথম কোনো নারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। এর আগে তুরস্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। আগামী ১ নবেম্বর সেখানে যে সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার তদারকিতে তুরস্কের সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সব দলকে নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু। গত সপ্তাহে আঙ্কারায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন তদারকির জন্য তিনি বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি এবং ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চাচ্ছেন। তুরস্কে গত জুন মাসের সংসদ নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় এবং কোয়ালিশান সরকার গঠনের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় আগামী ১ নবেম্বর আবার দেশটিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তুরস্কে ৭ জুনের নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য ৪৫ দিন সময় ছিল সংবিধানে। সেই সময়সীমা শেষ হবার ফলে কোয়ালিশন সরকার গঠনের আলোচনা ভেঙে যায়। তবে তুরস্কের বিরোধী দুটি দলের নেতারা বলছেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভার জন্য দলীয় কোনো নেতার নাম সুপারিশ করবেন না।
এদিকে, বাংলাদেশের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণা গ্রহণ করে পাকিস্তান। গত ২০১৩ সালের ১৩ মে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মীর হাজার খান খোসো। তার নেতৃত্বে একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা দায়িত্ব পালন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার পর বিচারপতি মীর হাজির ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা নয়, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন সম্পন্ন করাই তার সরকারের প্রধান লক্ষ্য হবে। তিনি বলেন, দেশের বিদ্যমান সমস্যায় নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন বলেও জানিয়ে দেন বিচারপতি খোসো। পাকিস্তানে যথারীতি সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রতিবেশী দেশ নেপালেও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে। প্রবল রাজনৈতিক সংকটের মুখে গত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয় নেপালের রাজনৈতিক দলগুলো। প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাইও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রধান বিচারপতি রিগমি খিলারাজ রেজমি। তার নেতৃত্বে সাবেক ১১ জন সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। তাদের অধীনে একই বছর জুনে যথারীতি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, প্রায় ১০ মাস ধরে সেখানকার রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলে আসছিল। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে, ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ায় সরকার ভেঙে দিয়ে ২০১৪ সালের ১২ মে নির্বাচন দেয়া হয়। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সে দেশের প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লেভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। রায়কভ মে মাস পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
উল্লেখ্য, উক্ত দেশসমূহ কমবেশি গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে বিশেষ করে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক তথা কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিই বেছে নেয়। গ্রীসের মতো দেশ- যেখানে একসময় গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেখানেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল সরকারের নীতি নির্ধারকদের একটি তত্ত্বাবধায়কের ধারণা গ্রহণ করতে। ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ না থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে সংকট মোকাবিলা করার কথা জানা যায়। আরেক তথ্যে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৭৫ সালে সাংবিধানিক সংকটের সময় তৎকালীন গবর্নর জেনারেল স্যার জন ক্যার একটি নতুন সরকার ব্যবস্থা গঠন করেন মাইকেল ফ্রাজারকে প্রধান করে। শর্ত ছিল মিস্টার মাইকেল ফ্রাজার খুব শিগগির একটি সাধারণ নির্বাচন দেবেন এবং এই সময় তার সরকার তত্ত্ব¡াবধায়ক ভিত্তিতে স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করবেন। এই ব্যবস্থা ছিল সে সময়কার সংকট নিরসনের একটি চমৎকার সমাধান। সেই থেকে অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিভাষা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শুরু হয় সাধারণ নির্বাচনের আগে যখন গবর্নর জেনারেল সংসদ ভেঙে দেন তখন থেকে পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ গঠন হবার পূর্ব পর্যন্ত তা বলবৎ থাকে। এটা আশা করা হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রণীত কতিপয় সুনির্দিষ্ট নিয়ম কাঠামোমাফিক পরিচালিত হবে। স্বাভাবিক অবস্থায়, সেখানে তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের কোন আলাদা নিয়োগ ব্যবস্থা নেই। দায়িত্বরত সরকারই সাধারণভাবে নিজেদের মনে করে তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধরণে দায়িত্বে রয়েছেন।
বিশ্লেষকদের অভিমত, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন আয়োজনের সময় সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় রাজনৈতিক দলসমূহ ও জনগণের আস্থার প্রতি। কে নির্বাচনে আসলো আর কে না আসলো তার পরোয়া নেই- এমনটা ভাবা হয় না। ‘প্রহসনের নির্বাচন’ কেবল একটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে সকল রাজনৈতিক দলের দাবি ও সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলেও এই ব্যবস্থার অন্যতম দাবিদার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে সেই সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করে। এর ফলে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ও নির্বাচনকালীন সংকট শুরু হয়। এই পরিস্থিতির অবসানে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
উল্লেখ্য, এদেশে কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ভাষা আন্দোলনের নেতা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম। ১৯৮০ সনের মাঝামাঝি জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য “কেয়ারটেকার সরকার” সংক্রান্ত একটি সুচিন্তিত রূপরেখা জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশনে পেশ করেন। ১৯৮০ সনের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান রমনা গ্রীনে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই রূপরেখা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্ব প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে পরপর ৩ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সূত্র- দৈনিক সংগ্রাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন