বাংলাদেশ বার্তাঃ ১২ অক্টোবর ২০১৭ইং:উত্তম পরিবার
عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْبَعٌ مِنَ السَّعَادَةِ: الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ، وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ، وَالْجَارُ الصَّالِحُ، وَالْمَرْكَبُ الْهَنِيءُ، وَأَرْبَعٌ مِنَ الشَّقَاوَةِ: الْجَارُ السُّوءُ، وَالْمَرْأَةُ السُّوءُ، وَالْمَسْكَنُ الضِّيقُ، وَالْمَرْكَبُ السُّوءُ-
অনুবাদ : সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, চারটি বস্ত্ত হ’ল সৌভাগ্যের নিদর্শন: পুণ্যবতী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ী, সৎ প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন। আর চারটি বস্ত্ত হ’ল দুর্ভাগ্যের নিদর্শন : মন্দ স্ত্রী, সংকীর্ণ বাড়ী, মন্দ প্রতিবেশী ও মন্দ বাহন।
উক্ত হাদীছে একটি উত্তম পরিবারের জন্য আবশ্যিক বিষয়গুলি বিধৃত হয়েছে। যার মধ্যে ক্রমিকের হিসাবে পুণ্যবতী স্ত্রীকে প্রথমে আনা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সকল সম্পদের সেরা সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ ‘দুনিয়াটাই সম্পদ। যার সেরা সম্পদ হ’ল পূণ্যশীলা স্ত্রী’। যার নমুনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِرِجَالِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: النَّبِيُّ فِي الْجَنَّةِ، وَالصِّدِّيقُ فِي الْجَنَّةِ، وَالشَّهِيدُ فِي الْجَنَّةِ، وَالْمَوْلُودُ فِي الْجَنَّةِ، وَرَجُلٌ زَارَ أَخَاهُ فِي نَاحِيَةِ الْمِصْرِ يَزُورُهُ فِي اللهِ فِي الْجَنَّةِ، وَنِسَاؤُكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ الْوَدُودُ الْعَؤُودُ عَلَى زَوْجِهَا، الَّتِي إِذَا غَضِبَ جَاءَتْ حَتَّى تَضَعَ يَدَهَا فِي يَدِهِ، ثُمَّ تَقُولُ: لَا أَذُوقُ غَمْضًا حَتَّى تَرْضَى-
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকদের বিষয়ে খবর দিব না? নবী জান্নাতী, ছিদ্দীক জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, ভূমিষ্ট সন্তান জান্নাতী, ঐ ব্যক্তি জান্নাতী যে স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য শহরের এক কোণে বসবাসকারী ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং ঐ স্ত্রী জান্নাতী, যে তার স্বামীর প্রতি সর্বাধিক প্রেমময়ী, অধিক সন্তান দায়িনী ও স্বামীর দিকে অধিক প্রত্যাবর্তনকারিনী। স্বামী অসন্তুষ্ট হ’লে সে দ্রুত ফিরে আসে ও স্বামীর হাতে হাত রেখে বলে, আপনি খুশী না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমের স্বাদ নেব না।
অন্যদিকে উত্তম স্বামী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ ‘পূর্ণ মুমিন সেই যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’। অন্যত্র তিনি বলেন
, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى
‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম’।বুঝা গেল যে, জান্নাতী হওয়ার জন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্য উভয়ের সাক্ষ্য প্রয়োজন।
এজন্য বিবাহের পূর্বে দ্বীনদার স্বামী ও স্ত্রী বাছাই করা একান্ত কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্য সবকিছু ছাড় দিয়ে দ্বীনকে অগ্রাধিকার দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যখন এমন কোন ছেলে তোমাদের কাছে বিয়ের পয়গাম নিয়ে আসে, যার দ্বীন ও চরিত্র সম্পর্কে তোমরা খুশী হবে, তাহলে মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দাও। যদি তা না দাও, তাহলে পৃথিবীতে ফিৎনা ও বিশৃংখলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে’।
আল্লাহ বলেন,
الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ أُولَئِكَ مُبَرَّءُوْنَ مِمَّا يَقُولُونَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ أُولَئِكَ مُبَرَّءُوْنَ مِمَّا يَقُولُونَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
‘দুষ্টু নারী দুষ্টু পুরুষের জন্য ও দুষ্টু পুরুষ দুষ্টু নারীর জন্য এবং পবিত্রা নারী পবিত্র পুরুষের জন্য ও পবিত্র পুরুষ পবিত্রা নারীর জন্য। লোকেরা যা বলে এরা সেসব থেকে মুক্ত। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রূযী’ (নূর ২৪/২৬)।
শ্রেষ্ঠ স্ত্রীর ব্যাখ্যা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
المَرْأةُ الصَّالِحَةُ تَراها فَتُعْجِبُكَ وَتَغِيبُ عَنْها فَتَأْمَنُها على نَفْسِها ومالِكَ
المَرْأةُ الصَّالِحَةُ تَراها فَتُعْجِبُكَ وَتَغِيبُ عَنْها فَتَأْمَنُها على نَفْسِها ومالِكَ
‘পূণ্যশীলা স্ত্রী সেই, যাকে দেখলে তুমি খুশী হও। তোমার অসাক্ষাতে তুমি তার ব্যাপারেও তোমার মাল-সম্পদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাক।
২. বর্ণিত হাদীছে উত্তম পরিবারের জন্য দ্বিতীয় স্থানে রাখা হয়েছে প্রশস্ত বাড়ী
(وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘প্রশস্ত ও বহুবিধ সুবিধা সম্পন্ন বাড়ী’
(الدَّارُ تَكُونُ واسِعَةً كَثِيرةَ المَرافِقِ)
(وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘প্রশস্ত ও বহুবিধ সুবিধা সম্পন্ন বাড়ী’
(الدَّارُ تَكُونُ واسِعَةً كَثِيرةَ المَرافِقِ)
।অর্থাৎ যে বাড়ীতে কিচেন, বাথরুম, টয়লেট, অতিথি কক্ষ, পাঠকক্ষ, খাবার কক্ষ, ইবাদত খানা, লাইব্রেরী, খোলা বারান্দা, বাগান-পুকুর, গাড়ী ঘর, কর্মচারী কক্ষ, হাস-মুরগীর ঘর, গরু-বকরীর গোয়াল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে, সর্বোপরি যে বাড়ীর চারদিকে খোলামেলা ও আলো-বাতাসে ভরা সেটাকে ‘বহুবিধ সুবিধাসম্পন্ন বাড়ী’ বলা চলে।
সেই সাথে এ যুগের আবিষ্কৃত এসি, ফ্রিজ, কুকার, ওভেন, ফ্যান, লাইট, ওয়াশিং মেশিন, আনুষঙ্গিক বিষয় সমূহ কোন বিলাস সামগ্রী নয়, বরং নিঃসন্দেহে অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এগুলিকে তাক্বওয়া বিরোধী মনে করা ঠিক নয়। সামর্থ্য থাকলে এগুলি দ্বারা বাড়ীকে সর্বাধিক সুবিধা মন্ডিত করা দোষণীয় নয়। যদি না সেখানে কোনরূপ বিলাসিতা ও অপচয় থাকে এবং গর্ব ও অহংকার প্রকাশ উদ্দেশ্য না হয়।
কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
إِنَّ اللهَ يُحِبَّ أَنْ يُرَى أَثَرُ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ
إِنَّ اللهَ يُحِبَّ أَنْ يُرَى أَثَرُ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দার উপরে তার নে‘মতের নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন’।তবে এগুলির জন্য ঋণ করা জায়েয নয়। কেননা ঋণগ্রস্তের জানাযা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পড়েননি। এমনকি শহীদের সবকিছু মাফ হলেও তার ঋণ মাফ হয় না।
উত্তম বাড়ীর জন্য কেবল ভৌতকাঠামোই যথেষ্ট নয়। বাড়ীটি হ’তে হবে আল্লাহর রহমতে পূর্ণ ও শয়তান হ’তে মুক্ত।
এজন্য বাড়ীটিকে সর্বদা (১) আল্লাহর যিকরে পূর্ণ রাখতে হবে। বাড়ীতে প্রবেশকালে ও বের হবার সময় এবং ঘুমানোর সময় ছহীহ হাদীছের দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যখন কেউ গৃহে প্রবেশকালে এবং খাবার সময় বিসমিল্লাহ বলে, তখন শয়তান তার সাথীদের বলে, আজ তোমাদের এ বাড়ীতে থাকার ও খাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যখন সে আল্লাহর নাম স্মরণ করে না, তখন শয়তান খুশী হয়ে বলে আজ তোমাদের এ বাড়ীতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হ’ল’।আর বের হওয়ার সময় দো‘আ পড়লে শয়তান এক পাশে সরে যায় ও তার সাথী আরেক শয়তানকে বলে, লোকটি হেদায়াত প্রাপ্ত হ’ল এবং তার জন্য যথেষ্ট হ’ল ও সে বেঁচে গেল’। এতদ্ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে প্রবেশ করার পর প্রথমে মিসওয়াক করতেন।
তিনি বলেন, যে বাড়ীতে আল্লাহর স্মরণ করা হয় ও যে বাড়ীতে হয় না, দু’টির তুলনা জীবিত ও মৃতের ন্যায়’। এজন্য ফরয ব্যতীত সকল সুন্নাত ও নফল ছালাত বাড়ীতে পড়া উত্তম। ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা এতে আকাংখী থাকতেন। পরিবারের কোন সদস্য সকালে কুরআন তেলাওয়াত না করে ঘর থেকে বের হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের বাড়ীগুলিকে কবর বানিয়ো না। কেননা শয়তান ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করে না, যে বাড়ীতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়। বিশেষ করে বাক্বারাহর শেষ দু’টি আয়াত পরপর তিন দিন পাঠ করলে শয়তান সে বাড়ীর নিকটবর্তী হয় না’।
এতদ্ব্যতীত বাড়ীকে পাপমুক্ত রাখতে হবে। যেমন বাড়ীতে ছবি-মূর্তি টাঙানো, গায়ের মাহরাম নারী-পুরুষের অবাধ প্রবেশ, গান-বাজনা, গীবত-তোহমত, চোখলখুরী ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখা। সর্বদা উন্নত চিন্তা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, উন্নত চরিত্র মাধুর্য ও ধর্ম চর্চার মাধ্যমে বাড়ীকে পবিত্র রাখতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন