বাংলাদেশ বার্তাঃ ১০৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রবার্ট নর্ ম্যান্ডির ডিউক হন। তিনি নরম্যান্ডির ডিউক হওয়ার কয়েক বছর পরে পিটার নামে একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ইউরোপের সকল খ্রিস্টান বীরকে মুসলামনদের হাত হতে প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান তীর্থগুলি উদ্ধার করবার জন্য আহবান করেন এবং সে আহবান শুনে ইউরোপের অনেক রাজা ও যোদ্ধা মুসলমানদের সথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হন। খ্রিস্টটনদের এই ধর্ম যুদ্ধের নাম ‘ক্রুসেড। ‘ক্রুসেড' অর্থ ক্রস চিহ্নিত। যে সকল খ্রিষ্টান সেনারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের ঢালে খ্রিষ্ট ধর্মের চিহ্ন স্বরূপ একটি করে ক্রুস অাঁকা থাকত। সে জন্যই এ যুদ্ধের নাম হয়েছে ‘ক্রুসেড'। একাদশ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত তিন শত বছর ধরে ঈর্ষাপরায়ন খ্রিষ্টান জগৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড' পরিচালিত করেছিল। এখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান জগতের ‘ক্রুসেড' চলছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। প্রলয়ঙ্কারী শতাব্দী ব্যাপী এই ‘ক্রসেড' সংঘটিত হয়েছিল যে সব কারণে তার মধ্যে প্রধান ছিল জেরুজালেমের ওপর মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। হযরত ওমরের খেলাফত কালে ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে আমর ইবনুল আস সর্বপ্রথম খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে প্যালেস্টাইন দখর করেন এবং খলিফা ওমর স্বয়ং জেরুজালেম গমন করে শহরের হস্তান্তর গ্রহণ করেন। হযরত ঈসার জন্ম ভূমি মুসলমানদের করতল গত হলে খ্রিষ্টান জগতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তদুপরি ১০০৯ সালে মিসরের ফতেমী খলিফা আল হাকিম জেরুজালেমের পবিত্র গীর্জার ক্ষতি সাধন করলে এবং সেলজুক তুর্কিদের খ্রিষ্টান তীর্থ যাত্রীদের প্রতি অনুদার ব্যবহারের বাহানায় ইউরোপীয় খ্রিষ্টানগণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। সেলজুক সুলতানাতের সময় জেরুজালেমে যে সব খ্রিস্টান তীর্থ যাত্রী আসতো তারা পথিমধ্যে ডাকাত দ্বারা আক্রান্ত হত। তীর্থ যাত্রীরা দেশে ফিরে গিয়ে ডাকাতীর কথা গোপন রেখে সেলজুকদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কথা প্রচার করে খ্রিষ্টান সমাজকে উত্তেজিত করতো।
ইসলামের আবির্ভাব গ্রীক ও রোমান সভ্যতার প্রতি
বিরাট হুমকি স্বরূপ ছিল। সপ্তম ক্রুসেড শুরু হয় ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে পোপ সপ্তম গ্রেগরীর প্ররোচনায়। অষ্টম ও সর্বশেষ ক্রুসেড সংঘটিত হয় ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে। ফ্রান্সের নবম লুইয়ের নেতৃত্বে যোদ্ধাগণ মিসরে অবতরণ করে; কিন্তু আইয়ুবের পুত্র তুরান শাহ কর্তৃক পরাজিত হন। লুইকে বন্দী করা হয় কিন্তু সন্ধি স্বাক্ষরিত করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। শেষ ক্রুসেডে তৃতীয় হেনরীর পুত্র এডওয়ার্ড যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসলমানগণ বীরবিক্রমে জিহাদ করে খ্রিস্টানদের দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলগুলো ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে পুনরুদ্ধার করেন। ঐতিহাসিক হিট্রি ক্রুসেড সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘‘ক্রুসেড মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান ইউরোপের তীব্র প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ।’’ ধর্মীয় উত্তেজনা, ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামির পরিণতি হিসাবে খ্রিস্টানরা ধ্বংস লীলায় ৩ শতাব্দী ধরে মেতে ওঠে যে কলঙ্কময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দী ইসলামের স্বর্ণযুগ হওয়ায় আটটি ক্রুসেডের কোনটিতেই ক্রুসেডারগণ বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। এবারে তারা শেষ ক্রুসেডের প্রায় সোয়া ছয় শতাব্দী পরে ১৯১৭ সালে সুযোগ পেল ক্রুসেডে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ নেবার। ১৯১৭ সালে বিজয়ী মিত্র জোট জেরুসালেম দখল করে এবং ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি মিঃ ব্যালফোরের ঘোষণা অনুযায়ী ঐ বছরেই ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম হয়। জেরুসালেম দখল করার পর হতে খ্রিস্টানরা নতুন আঙ্গিকে একটা নতুন ক্রুসেড শুরু করে দিয়েছে। এবারে ক্রুসেড যাজকদের নেতৃত্বে নয়, খ্রিস্টান রাষ্ট্রপতিদের নেতৃত্বে। এবারের ক্রুসেডের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্যে সাবেক ক্রুসেডগুলোর প্রতিশোধ গ্রহণ করা। হাল জমানার মুসলমান নিধন পর্বটা শুরু হয়েছে প্রথমে ফিলিস্তিনে পরে বসনিয়াতে এখন চলছে সিরিয়া, কাশ্মীর মায়ানমার। খ্রিস্টান মোড়লেরা ইহুদীদের দ্বারা ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র কায়েমের পর হতে আজ পর্যন্ত এবং সার্বিয়া ও ক্রোট খ্রিস্টানদের দ্বারা বসনিয়া ও হারজেগোভিনাতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে পূর্ব ক্রুসেডের প্রতিশোধ গ্রহণ করছে। ৩ সুদূর অতীতে তিন শতাব্দী ধরে একটি নয়, দুটি নয়, আটটি ক্রুসেডের মাধ্যমে খ্রিস্টানরা মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুসালেম দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল ভাগ্যচক্রে সেই জেরুসালেম যখন তাদের দখলে এসেছে তখন কি তারা অতি সহজে শুধুমাত্র আলোচনা ও দাবির কারণে তা মুসলমানদের কাছে ফিরিয়ে দেবে? না, দেবে না। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূমি দখলের মধ্য দিয়ে বিশ্বে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। আর সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরাইলকে স্বীকৃতি জানায়। এর ফলে নৃশংস ইহুদী জাতির মনোবল বেড়ে যায় এবং তারা ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে নিরীহ মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে প্রায় দশ লাখ মুসলমানকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে। যে কারণে বাধ্য হয়ে মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়। এতে ইহুদীদের মদদদাতা দেশগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি পাস করিয়ে ইহুদিদেরকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করে। পশ্চিমা দেশগুলো এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইসরাইলকে সমৃদ্ধ করেছে যেন তার চতুর্পার্শ্বে সমুদয় মুসলিম দেশ একত্রে সমবেতভাবে যুদ্ধে নামলেও তার সাথে এঁটে উঠতে না পারে। যার পরিণতিতে দেখা গেল যে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল মিসরের নিকট থেকে গাজা ও সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের পশ্চিম তীর জোরপূর্বক দখল করে নেয়। সম্প্রতি সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রস্তাবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের কাছে তা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চলীয় নেজেব মরুভূমি এলাকা থেকে ৫০ হাজার ফিলিস্তিনীকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেছে ইসরাইল। আমরা দেখতে পাই, বেআইনিভাবে কুয়েত দখল করার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ন্যায়বিচারের নামে ইরাকের ওপর বিভিন্ন অজুহাতে তিন দফায় আক্রমণ চালায়। সে অনুপাতে ইসরাইলের অপর দেশের ভূমি দখলের অপরাধে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উচিত ছিল নয়বার আক্রমণ করা। কিন্তু তারা তা না করে ইসরাইল বিরোধী প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে ইসরাইলের নিরাপত্তা অধিকতর মজবুত করেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিস্টান জগত অঘোষিত ক্রুসেড দ্বারা মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণে বেজায় তৎপর। কুয়েত দখলের ফলশ্রুতিতে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা দফায় দফায় ইরাকের ওপর বিমান হামলার একটা না একটা অজুহাত খুঁজে বের করেছে। প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে দুবার এবং ক্লিনটনের আমলে বুশের প্রাণনাশের সাথে জড়িত কল্পিত অভিযোগ একবার মোট তিনবার ইরাকের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। সাদ্দামের কবল থেকে কুয়েত উদ্ধার করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমেরিকা ও তার মিত্র জোটের যতটা না লক্ষ্য ছিল তার চেয়ে বেশি লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে যেন কোন মুসলিম শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে দিকে। তারা ইরাকের সাদ্দামের মধ্যে আর এক সালাহ উদ্দীনের অস্তিত্ব অনুভব করে চিরতরে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিল। ক্রুসেডররা তালেবান দমনের নামে আফগানিস্তানের ওপর চেপে বসেছে, হত্যা করেছে তাদের প্রধান শত্রু ওসামা বিন লাদেনকে। পাকিস্তানের ওপর তাদের রক্তলোলুপ জিহবা প্রসারিত করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানকে বাগে নেয়ার নানা চক্রান্ত চলছে। তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ার ওপর ন্যাটোর অব্যাহত হামলা চলছে। তাদের কূট চালে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, তার প্রমান সিরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশেই গণতন্ত্র নেই; আর গণতন্ত্র না থাকার কারণে এরা জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আর সে জন্যই তারা আমেরিকার প্রভুত্বের নিকট নতি স্বীকার করে তাদের গদি টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। ধূর্ত আমেরিকা ও পশ্চিমা খ্রিস্টান জগৎ তাদের নিজ প্রয়োজন মত ও সুযোগে তাদের পদলেহিদের নিপাত ঘটিয়ে অতীতের ক্রুসেডের প্রতিশোধ নিচ্ছে। নব্য ক্রুসেডের হাত থেকে মুসলমানকে বাঁচাতে হলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সমস্ত শক্তির মোকাবেলায় তাদেরকে সমবেতভাবে লড়তে হবে। তাদেরকে শক্তভাবে আল্লাহর রজ্জুকে অাঁকড়িয়ে ধরতে হবে আর শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধভাবে......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন