বাংলাদেশ বার্তাঃ হানিফ কোম্পানীর একটি বাস রংপুর শহরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করল। বাসটির ৪২ টি সিট যাত্রীতে পূর্ণ। বাসের হেলপার,কন্টাকটার এবং ড্রাইভার সাহেব বেশ খুশি মনে ‘বিসমিল্লাহ...’ পড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
ড্রাইভারের পিছনের সিটে দু’জন মাঝবয়সী লোক বসেছেন। তাদের একজন আজকের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকা পড়তে শুরু করলেন। পত্রিকার পাতাগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে উল্টানোর এক পর্যায়ে তার চোখ দু’টো বিনোদন পাতায় আটকে গেল। হালের উঠতি এক নায়িকা স্বল্প বসন পরিহিত ছবিতে তার নয়ন দু’টি থমকে গেছে। তার নয়নের এরূপ কড়া দৃষ্টি দেখে তার পাশের জনও পত্রিকার পাতার দিকে তাকালেন। তিনিও মোহগ্রস্থ হলেন। তিনি একবার সামনের দিকে তাকান আর একবার আড়চোঁখে পত্রিকায় দৃশ্যমান স্বল্প বসনের সেই নায়িকার দিকে তাকান।
এভাবেই এক সময় বাসটি গাজীপুর অতিক্রম করল। মাঝের দিকে বসেছেন দুই তরুন-তরুনী। তারা সম্ভবত নববিবাহিত দম্পতি। যাত্রী ভর্তি এই বাসেও তাদের ভালোবাসাময় দুষ্টামী থেমে থাকে না। এরই ফাঁকে মেয়েটি লজ্জা,শঙ্কা আর খানিকটা ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে তাকায়,এই বুঝি কেউ দেখে ফেললো...
বাসটি যমুনা সেতুতে এসে পড়ল। যমুনা সেতুতে বাসটি আসা মাত্রই বাসের যাত্রীদের মধ্যে হঠাৎ চাঞ্জল্য লক্ষ্য করা গেল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন যুবক জানালায় তার দুই হাত এলিয়ে তার উপর থুঁতনি রেখে, এক দৃষ্টিতে যমুনার কালো জলের যৌবনের জোঁয়ার দেখতে লাগল। দূর নদীতে দেখা যায়, হারিকিনের টিমটিম আলো। হয়তো নৌকার মাঝি, মাছভর্তি নৌকা নিয়ে খুশির চোটে প্রিয়ার আলিঙ্গন পাবার দূর্নিবার ইচ্ছা নিয়ে পাড়ের দিকে ছুটছে। ঠিক তখনই যুবকটির মনে আপনা থেকেই বেজে উঠল আব্বাস উদ্দিনের সেই গান, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে...’
এভাবে আরো খানিকটা পথ চলে বগুড়া পার হবার পর পিছনের দিক থেকে এক বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে এলো। কান্নার শব্দে বাচ্চাটির মায়েরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। পিঠে মৃদু থাপ্পড় দিতে দিতে মা বলে,
‘ওরে আমার বাবাটা! স্বপ্ন দেখছো, ভয় পাইছো। এইতো আম্মু তোমার পাশে আছি। ঐ যে দেখ চাঁদ। জানালা দিয়ে চাঁদ দেখ।’
আড়াই বছরের বাচ্চাটি আচমকা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কান্না থেমে যাওয়ায় আশ্বস্ত হন মা। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই বাচ্চাটি বলে, ‘দেখছো আম্মু, চাঁদটাও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। চাঁদটা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কেন?’
এই ‘কেন’ এর কোনো উত্তর হয় না। একটি বাসে এতোকিছু হচ্ছে কিন্তু তার কোনো কিছুই বাসের ড্রাইভারটিকে স্পর্শ করে না। সে যেমন স্বল্প বসনার সেই মডেলকে দেখতে যেমন নিজ আসন ত্যাগ করে না। ঠিক তেমনি যমুনার কালো জলও তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। আর ঠিক সেকারণেই গভীর রাত পেরিয়ে সবার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন সবাই নিজেকে বাসসমেত রংপুর বাসষ্ট্যান্ডে আবিষ্কার করতে পারে।
আর সবার মত ড্রাইভার সাহেবও যদি সেই নববিবাহিত দম্পতির দুষ্টামো দেখার জন্য মুখিয়ে উঠতেন, তবে সেই বাসটি আর কখনোই রংপুরে পৌঁছাতো না। হয়তো তা যমুনার অতল খাঁদে হারিয়ে যেত...
জীবন একটি চলন্ত বাসের মত। জীবনে চলতে গিয়ে অনেক মানুষের সাথেই পরিচয় হয়। নানা জন, নানান কথা বলে। কেউবা পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেয়। আর কেউবা ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি দিয়ে উপহাস করে। পিঠ চাপড়ানোর মুহুর্তটা যতোটানা অনুপ্রেরণা দেয় , বাঁকা হাসিটা তার চেয়ে সহস্রাধিক গুন বেশি জ্বালা দেয়। সেই জ্বালা স্মরণ রাখলে মুশকিল। আর কখনো জীবনের গন্তব্যে স্থলে পৌঁছানো হবে না। জীবন নামক বাসটি কোন এক খাঁদের কিনারাতেই থমকে থাকবে।
জীবনে কিছু করতে চাইলে নাইটকোচের বাসের ড্রাইভারদের মত হওয়া প্রয়োজন। বাসের ভিতরে যাই ঘটুক ড্রাইভারের যেমন তাতে কোন-ই যায় আসে না। তেমনি আমাদের আশে-পাশের মানুষ যাই বলুক না কেন, সেগুলো গায়ে মাখানো যাবে না। তবেই একদিন দেখবেন, আপনার ‘বাস’ নামক জীবনখানি সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে।
কার্টেসীঃ
লেখক, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক স্যার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন