ইসলাম ও রাজনীতি এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। এ কারণেই ‘ইসলাম’, ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’, ‘ইসলাম অ্যান্ড পলিটিক্স’ ইত্যাদি বিষয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে পাশ্চাত্যের জগতে। এসব গ্রন্থের মধ্যে পক্ষ ও বা বিপক্ষবাদীদের রচনা যেমন আছে, তেমনি আছে একাডেমিক বা গবেষণামূলক গ্রন্থ। কারণ পশ্চিমের মরক্কো থেকে পূর্বের ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সুবিশাল ভূভাগব্যাপী ইসলামী জগতের বিপুল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক জীবনে ইসলামের অবদানকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কোথাও ইসলামের উত্থান বৈপ্লবিক, কোথাও গণতান্ত্রিক; আবার কোথাও ইসলাম ক্রমবর্তমান ও বিকাশশীল। ফলে সর্বসাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতিতে ইসলামের নানা দিক আলোচনা-পর্যালোচনা-গবেষণা একটি অপরিহার্য বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারীর পিএইচডি গবেষণার ভিত্তিতে রচিত ‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির তিন দশক (১৯৭১-২০০০)’ এবং অসডার পাবলিকেশন্স প্রকাশিত গ্রন্থটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
প্রায় সাড়ে চার শ পৃষ্ঠার বিস্তারিত গবেষণায় ড. এনায়েত বাংলাদেশ জনপদে ইসলামী রাজনীতির উদ্ভব, বিকাশ ও কার্যক্রম সম্পর্কে একটি চমৎকার ঐতিহাসিক চিত্র উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তীতে গবেষণা সময়কালের পরিধিতে ইসলামী রাজনীতিতে লিপ্ত নানা রাজনৈতিক দলের কাঠামো ও কার্যক্রমকে সুবিস্তারে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর গবেষণা ধারায় জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট ও অন্যান্য ইসলামী দলের স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। বিশেষত জঙ্গিবাদ ও বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও সমসাময়িক বিষয়কে একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা এ গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাশাপাশি, বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি যে সুচিন্তিত ও গবেষণালব্ধ মতামত পেশ করেছেন, তার মূল্যও অপরিসীম।
মূল আলোচনার বাইরেও গ্রন্থে ইসলাম ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় প্রসঙ্গক্রমে আলোচনা এনেছেন ড. এনায়েত। তাঁর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, “বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি তথা ইসলামী সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তথ্য-সন্ত্রাসের শিকার। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে যে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় দেশ-বিদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের মূলধারার দলগুলোকে কোণঠাসা করার জন্য পরিকল্পিত ভাবে ভুল তথ্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে তিনি বিখ্যাত মার্কিন অধ্যাপক মাইকেল প্যারেন্টিকে উদ্ধৃত করেছেন।
বিস্তারিত তত্ত্ব ও তথ্যগত আলোচনার পর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, “আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচারণার কৌশল হিসাবে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যায়: (ক) মৌলবাদের জিগির তোলা, (খ) ইসলামী আন্দোলন ও সন্ত্রাসকে একাকার করে দেখানো, (গ) ইসলামী ব্যক্তিত্বকে কালিমালিপ্ত করার ব্যবস্থা করা, (ঘ) যে কোনো সন্ত্রাসের দায় ইসলামী আন্দোলন ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের ওপর যে কোনোভাবে চাপিয়ে দেয়া।” এসব বক্তব্য অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের পর আসল সত্য দিনে দিনে বের হয়ে আসছে। এই গবেষণার প্রধান শক্তিই হলো শত-বিরূপতার মধ্যেই ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত ও উন্মোচিত করা।
কিন্তু এই উন্মোচনের কাজেই গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ অধ্যাপক ড. এনায়েত থেমে থাকেন নি। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও কেন ইসলামী সেভাবে সমর্থন লাভ করে এগিয়ে যেতে পারছে না? এ ব্যাপারে ইসলামী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাঁরা ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির চক্রান্ত-অপতৎপরতা এবং মুসলমানদের ইসলামের মূল শিক্ষার ব্যাপারে অজ্ঞতাকে দায়ী করেন। কিন্তু এই বক্তব্যই শেষ কথা নয়। বরং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে। ইসলামী দলসমূহের নেতৃবৃন্দকে আরো গণমুখী চরিত্র অর্জন করতে হবে। মানুষের সুখে-দুখে নিজেদেরকে আরো সম্পৃক্ত করতে হবে। কথায় এবং কাজে মিল রেখে নিজেদের জীবন ও চরিত্রকে গঠন করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, সেবা এবং দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির সম্ভাবনা অধিক বৃদ্ধি পাবে।” ড. এনায়েতের এসব বক্তব্য অনেকাংশেই প্রণিধানযোগ্য। বস্তুত এই গবেষণা ইসলামী রাজনীতির সামনে আত্মসমালোচনা ও আত্মবিনির্মাণের অনেকগুলো সূত্র উপস্থাপন করেছে।
ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের কৃতী সন্তান তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারীর গবেষণা গ্রন্থ বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছে। ইসলামপ্রিয় মানুষের সামনে ইসলামী রাজনীতির প্রতিবন্ধকতা আর সীমাহীন সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে। গবেষক ইসলাম বিরোধী গবেষকদের মতো নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা বা অতি-প্রশংসার বশংবদীয় ধারার বাইরে একটি সত্যনিষ্ঠ, সাহসী, তথ্যনির্ভর গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন। বাংলাদেশ, ইসলাম ও রাজনীতি নিয়ে এখানে যেসব গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে, তার মধ্যে এই গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করবে বলেই মনে করি। বিশেষত তিনি যে সাহসী বক্তব্যের মাধ্যমে গবেষণার উপসংহার টেনেছেন, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও যথার্থতার সঙ্গে এই মীমাংসায় পৌঁছেছেন যে, “ইসলামী দলগুলোর পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এবং অনৈক্যের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা কোনো স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। ইসলামী দলগুলোর অনৈক্যের পেছনে আদর্শগত বিরোধের চেয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বই বেশি ক্রিয়াশীল। নেতৃত্বের প্রশ্নে দলগুলো আপস করতে পারেনি বলে বৃহত্তর কোনো ইসলামী জোট গঠিত হয় নি।” এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের বৃহত্তর ও কার্যকর ঐক্য ময়দানের গুণগত পরিবর্তন সাধনে সক্ষম। ব্যাপক জনসমর্থন ও আদর্শবাদিতার সমন্বয়ে ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের পক্ষেই মেরুকরণ সম্পন্ন হবে এবং ষড়যন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে বিজয়ী হওয়াও সম্ভব হবে। ড. এনায়েত এ দিকটির দিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সময়োপযোগী কাজই করেছেন। গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত এসব তথ্য ও দিক-নির্দেশনা ছোট-বড় ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করতে পারলে এদেশের ইসলামী আন্দোলনই উপকৃত হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, সমাজতন্ত্রের পতনের পর দেশে দেশে অবদমিত ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ঘটে। আবার বিশ্বায়ন ও এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নামে খ্রিস্ট-ইহুদি বলয়ের আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলার জন্যও ইসলাম রাজনৈতিক ময়দানে অবতীর্ণ হয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই ইসলামকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলেও সেটা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সুদানে, মিসরে এবং নানা দেশে জনপ্রিয় ভোটে জিতেও ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসতে পারে নি; কিংবা আসলেও থাকতে পারেনি। এর মানে কি এটাই যে, গণতান্ত্রিকভাবে একটি জনগোষ্ঠীর বিপুল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলামপন্থীদের বিজয়ী করলেও সেটা মানা হবে না? পশ্চিমা বিশ্ব গণতান্ত্রিক হলেও ইসলামকে সহ্য করবে না? ঘটনাক্রম তো সে কথাই বলছে। বাংলাদেশও এহেন বিপদের বাইরে থাকতে পারছে না। কিন্তু এটা শুধু জনগণের অধিকারের বিরুদ্ধে মস্ত বড় পাপই নয়; বিরাট ভুলও বটে। কারণ গণতান্ত্রিক পথে আগুয়ান শক্তিকে চেপে ধরলে সেখানে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা। যে সমস্যা চাপ-প্রদানকারীরা সহ্য করতে পারবে না। ইরাক ও আফগানিস্তানে নাক-গলিয়ে সেটা তারা এখন ভালোভাবেই টের পাচ্ছে।
বাংলাদেশ শান্তি ও সৌহার্দ্য-প্রিয় ইসলামী জনপদ, যেখানে নানা মত ও ধর্মের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠী ইসলামকে তাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং এ বাস্তবতা তৈরি হয়েছে শত শত বছরে; ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে। দিনে দিনে সেই ধারা শত বিরূপতার মধ্যেও পুষ্টি লাভ করেছে। এই জনশক্তিকে অবজ্ঞা ও মাইনাস করা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিকভাবেই অসম্ভব। বরং যারা ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে কাজ করছেন, তাদের উচিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আর যারা ইসলামকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে কাজ করছেন, তাদেরকে বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে কৌশলপূর্ণ ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। ড. এনায়েতের গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত-বক্তব্য এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা সবাইকে ভাবনার খোরাক যোগাবে এবং বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির পথচলাকে আরো বাস্তবানুগ ও সফল করতে সহায়তা করবে।
অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারীর ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন