ফর দ্য পুওর বাই দ্য পুওর-এই ছিল ডাক্তার এড্রিক বেকারের দর্শন। ৭৫ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। এর মধ্যে ৩৫ বছর ছিলেন বাংলাদেশে। বলতে গেলে মধুপুরের জঙ্গলে। ১৯৬৫ সালে তিনি এমবিবিএস ডাক্তার হন নিউজিল্যান্ডের ডানেডিন থেকে। ভালো বংশের ছেলে, সহায়-সম্পদও ছিল বিস্তর। কিন্তু ডাক্তারি পাস করার পরই চলে যান ভিয়েতনাম। তখনকার দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধপীড়িত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে থাকেন। ১০ বছর ছিলেন ভিয়েতনামে। তারপর শিশু চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন পড়াশোন করেন ইংল্যান্ডে। ১৯৭৯ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। ক্রিশ্চিয়ান মিশনের হয়ে যান মেহেরপুরে। মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালেও ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮৩ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর জেলার কাইলাকুড়িতে থিতু হন। প্রতিষ্ঠা করেন কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট। বাংলাদেশ বেছে নেওয়ার কারণ তিনি বলেছিলেন-এখানকার মানুষ খুব ভালো কিন্তু চিকিৎসা পায় না। প্রথম প্রথম যখন এসব মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে বুঝলেন কেউ কাউকে বুঝতে পারছে না। মানে বাংলা শিখতে হবে। মধুপুরের জলছত্র মিশনে গিয়ে বাংলা শিখতে লাগলেন আর স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বসে চা খেলেন। কান রাখলেন খাড়া। পেট ব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি আসে, পুইড়া গেছেসহ আরো অনেক কিছু শিখলেন। এক বছরের মধ্যে মোটামুটি বুঝদার হয়ে গেলেন।
কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টারে কর্মী সংখ্যা ৯০ জন। তবে ডাক্তার কেবল ওই বেকার। হাসপাতালের ওপরে করোগেটেড টিন আর দেয়াল মাটির। চিকিৎসা হয় প্রসূতি মা থেকে শুরু করে আগুনে পোড়া রোগীরও। তবে বেশি আর জরুরি প্রয়োজনের রোগীদের সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মুশকিল হলো রোগীদের সদরে যাওয়ার টাকা থাকে না। ডাক্তার বেকার (স্থানীয়রা যাকে ডাক্তার ভাই নামে ডাকে) বলেছিলেন, 'আমাদের হাসপাতাল দিনরাত খোলা থাকে। কারণ বন্ধ করার মতো গেট নেই আমাদের। ভর্তি রোগীর বিছানা আসলে চাটাই, যদিও বেড আছে কিছু।' শেষ দিকের এক হিসাবে দেখা যায়, ওই হাসপাতালে বছরে আউটডোরে ২০ হাজার, ইনপ্যাশেন্ট ১১ হাজার, ১১১৯ জন ডায়াবেটিক, ৮৯ জন যক্ষ্মারোগী এবং ৭০০ জন প্রসূতি মায়ের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৭টি গ্রামের মানুষ এখানে চিকিৎসা নেয়। ঘুরে ঘুরে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজও করে কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট। বছরে খরচ হয় এক কোটি টাকা। এর ৮৫ শতাংশ অনুদান আর বাকিটা আসে রোগীদের কাছ থেকে। তিনি বলেন, রোগীদের কাছ থেকে একদম টাকা না নিলে তারা কম যত্নবান থাকে। এখানে আউটডোরের টিকিট কাটতে পাঁচ টাকা। চেকআপ শেষ হলে ওষুধ দেওয়া হয় সেন্টার থেকেই। যার পয়সা নেই সে বিনা মূল্যে পায়। যারা ভর্তি হয় তাদের সঙ্গে একজন আত্মীয়কেও খাবার দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। নিউজিল্যান্ডের মানুষটি কখনো বিয়ে করেননি। ২০১২ সালে প্রজেক্টের দায়িত্ব নেবে এমন মানুষ খুঁজছিলেন। বলেছিলেন, ফিবছর কত মানুষ এমবিবিএস পাস করে বের হয়! একজন যদি দায়িত্ব নেন তো অনেক ভালো হবে। সে মানুষটির আশায় থেকে থেকে ১ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন ডাক্তার ভাই। কাইলাকুড়ি এখন অপেক্ষায় আছে, আবার কবে আসবে ডাক্তার ভাই?
.
আজকের কালের কন্ঠের প্রতিবেদনটি তুলে ধরলাম। কত ভুংভাং মানুষ নোবেল পুরস্কার পায়। কিন্তু ওনার মত মহান মানুষ সবসময় সবার অগোচরেই থেকে যায়। ডাক্তার ভাই আপনার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে। জানি সেটা সম্ভব না। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন ভালো থাকুন মহান আল্লাহর কাছে এটাই চাওয়া। আপনার প্রতি রইলো অসীম শ্রদ্ধা।
মুহাম্মদ ফরহাদ আলম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন