স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্রাম অপরিহার্য। জীবন জীবীকার তাগিদে মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়। তবে, সেই পরিশ্রম হতে হবে বিরতি সহকারে, কখনো একটানা নয়। একটানা পরিশ্রম স্বাস্থ্যে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অতি সম্প্রতি চিকিৎসা বিষয়ক একটি তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণায় ‘একটানা পরিশ্রম স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়’ বিষয়টি উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) এপিডেমিওলজি বিভাগের অধ্যাপক মিকা কিভিমাকি এর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক দীর্ঘদিন যাবত এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছেন।
বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকী দ্যা লানসেট গত ২০আগস্ট বৃহস্পতিবার উপর্যুক্ত গবেষণা বিষয়ের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এটি চিকিৎসা বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত একটি বহুমুখি গবেষণার। ৫ লাখ ২৮ হাজার ৯০৮ জন নারী-পুরশুষের উপর গড়ে ৭বছর ২মাস ধরে বিভিন্ন দিক নিয়ে ১৭টি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। অধ্যাপক মিকা কিভিমাকি এর নেতৃত্বে এই ১৭টি গবেষণার নানাদিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং উপযুক্ত অভিমত প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত পরিশ্রম করা চলে, এতে ঝুঁকির পরিমাণ কম। এর বেশি পরিশ্রম ঝুঁকিপূর্ণ। পরিশ্রমের পরিমাণ যত বাড়বে, ঝুঁকির পরিমাণও বেড়ে যাবে। সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ঘণ্টা পরিশ্রমে যারা অভ্যস্ত্ তাদের উপর বহু বছর ধরে বিভিন্নভাবে গবেষণা চালানো হয়েছে। এ রকম প্রতি হাজার কর্মজীবীর মধ্যে ১০ বছরে স্ট্রোকের ঘটনা দেখা যায় ৫টির কম। গবেষণায় সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা সপ্তাহে অন্তত ৫৫ঘণ্টা একটানা পরিশ্রম করেন, তাদের মস্তিষ্কে রক্ত রণের সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং তাঁদের স্ট্রোকের সম্ভাবনা ৩৩শতাংশ বেড়ে যায়। যারা কর্মস্থলে ৯টা-৫টার বাইরে অতিরিক্ত, একটানা দীর্ঘক্ষণ সময় ধরে কাজ করেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি আরো বেশি। পরিমিত বিশ্রাম না নিয়ে যারা সপ্তাহ জুড়ে পরিশ্রম করেন, টানা পরিশ্রমের ফলে মস্কিষ্কে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি তাদের হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায় ১৩শতাংশ। দীর্ঘ টানা পরিশ্রমের উপর এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূণ গবেষণা।
বর্তমান সময়ে স্ট্রোক এবং স্ট্রোকে মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে গেছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটানা দীর্ঘ পরিশ্রম। টানা পরিশ্রম মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। গবেষকরা বলেছেন, বারবার মানসিক চাপের মধ্যে থাকার কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদ, বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলাসহ উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাঝে স্ট্রোকের ঝুঁকিসহ হৃৎরোগে আক্রান্ত হবার হার তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- কর্মস্থলের নিয়মিত সময়ের বাইরেও একটানা দীর্ঘ পরিশ্রম, এবং বারবার মানসিক চাপে থাকা। মতা, যশ এবং টাকার পেছনে ছুটা যায়। তবে, তা হতে হবে পরিমিত, নিয়মমাফিক এবং বিশ্রাম সহকারে। কয়জন রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সঠিক সময়ে আহার করেন?
বর্তমানে শিশুদের মাঝেও এই ঝুঁকি বেড়ে গেছে। শিশুদের প্রধান কাজ খেলা-ধুলা এবং ঘুমানো। অথচ কেজি শ্রেণির একটি শিশু এতটা পড়ার চাপে থাকে যে, খেলা-ধুলা দূরে থাক ঘুমানোর সময়ও সে পায় না। সকালে অনেক সময় দেখা যায়, পিতার কোলে চড়ে শিশু স্কুলে যাচ্ছে, অথচ শিশুটি ঘুমিয়ে। পরী ার হলে ক্লান্ত শিশু বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবে বারবার মানসিক চাপ তৈরি হয়, হোক না সে শিশু কিংবা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণির। শরীর সর্বদা একটি নির্দিষ্ট নিয়মেই চলে। নিয়মের ব্যতিক্রম মানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ঝুঁকি এড়াতে পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্রাম অপরিহার্য।
বিরতিহীন একটানা পরিশ্রম একটি কু-অভ্যাস। স্বাস্থ্যঝ্বুঁকি কমাতে এ কু-অভ্যাস পারিত্যাগ করতে হবে। কু-অভ্যাস বললাম এজন্য যে, অনেক মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেন। অথচ একটু চেষ্টা করলেই কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেয়া যায়, টানা পরিশ্রম কমানো যায়। একজন মুসলমানের জন্য দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করা বাধ্যতামূলক। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধান ‘নামাজ’ পরিশ্রমের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রামের একটি চমৎকার ব্যবস্থা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন