আনন্দবাজার পত্রিকা। ভারতের
সবচেয়ে
প্রভাবশালী
বাংলা
দৈনিক। পত্রিকাটির সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অতীত-বর্তমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূলত
মইদুল
ইসলামের
লেখা-
‘লিমিটস
অব
ইসলামিজম/জামায়াত-ই-ইসলামি
ইন
কন্টেম্পোরারি
ইন্ডিয়া
অ্যান্ড
বাংলাদেশ’
গ্রন্থের
রিভিউ
হিসেবে
নিবন্ধটি
লেখা
হয়েছে। লিখেছেন কিংশুক চট্টোপাধ্যায়। তিনি
লিখেছেন,
ভারতীয়
উপমহাদেশে
আনুমানিক
প্রতি
তিনজন
মানুষের
এক
জন
মুসলিম
সমপ্রদায়ভুক্ত;
বিশ্বের
কোথাও
এত
সংখ্যক
মুসলিম
থাকেন
না। কিন্তু সাধারণত যে ধরনের রাজনীতিকে আমরা ‘ইসলামি রাজনীতি’ বলে মনে করি, তা ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলাংশেই দেখা যায় না। এ কথাতেই
কেউ
কেউ
‘গেল
গেল’
রব
তুলতেই
পারেন। বলতে পারেন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কথা যেখানে কিছু মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন রাজনীতির আঙিনায় বেশ সক্রিয়। সে
ক্ষেত্রে
বলতেই
হবে
যে,
মুসলিমদের
রাজনৈতিক
সংগঠন
মাত্রই
‘ইসলামি
রাজনীতি’
অনুসরণ
করে
না। ‘ইসলামি রাজনীতি’ হল এমন একটি রাজনৈতিক চিন্তা, যার মৌলিক উপপাদ্যগুলো কথিতভাবে ইসলামি মূল্যবোধ এবং/অথবা ইসলামি জীবনচর্যার নির্যাস। সেই
নিরিখে
ভারতবর্ষে
তো
বটেই,
এমনকি
পাকিস্তান
এবং
বাংলাদেশের
রাজনীতির
মূলস্রোতেও
খুব
অল্পসংখ্যক
রাজনৈতিক
দলই
আছে,
যারা
প্রকৃত
অর্থে
ইসলামি
রাজনীতির
কাণ্ডারি। ভারতীয় উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামি সেই মুষ্টিমেয় কিছু দলের মধ্যে পড়ে, যারা এ ধরনের রাজনীতির প্রবক্তা।
জামায়াতের
জন্ম
পরাধীন
ভারতবর্ষে। মাওলানা মওদুদীর মতো নেতার দৌলতে সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সিদ্ধকল্প এ আন্দোলনটি কালক্রমে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে যায়, এবং উপমহাদেশ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার পরে স্বাভাবিক কারণেই ভারতের তুলনায় পাকিস্তানে বেশি প্রভাবশালী সাব্যস্ত হয়। পরে
বাংলাদেশের
জন্মক্ষণে
জামায়াত
অবিভক্ত
পাকিস্তানের
পক্ষে
থাকলেও
স্বাধীন
রাষ্ট্র
হিসেবে
বাংলাদেশের
অস্তিত্ব
মেনে
নিয়ে
সেই
দেশেও
যথেষ্ট
প্রভাবশালী
হয়ে
উঠেছে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং প্রভাবের বিচারে জামায়াতের সংগঠন পাকিস্তানে সব থেকে বেশি পরিচিত এবং প্রভাবশালী হলেও আজ জামায়াত তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বেশি শক্তিশালী, এবং ভারতবর্ষের রাজনীতিতেও জামায়াতের কার্যকলাপের পরিসর ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু
মজার
কথা
হলো,
পাকিস্তানে
জামায়াতের
ভূমিকা
নিয়ে
একাধিক
গবেষণাধর্মী
কাজ
হলেও
ভারত
বা
বাংলাদেশে
জামায়াতের
ভূমিকা
বা
রাজনীতি
নিয়ে
তেমন
কাজ
হয়নি। সেই দিক থেকে দেখলে মইদুলের আলোচ্য বইটি একটা বড় অভাব দূর করবে।
ভারত
এবং
বাংলাদেশের
বহু
গুরুত্বপূর্ণ
এবং
সক্রিয়
জামায়াতের
কার্যকর্তার
সঙ্গে
সাক্ষাৎকার
এবং
দুই
দেশের
রাজনীতির
পুঙ্খানুপুঙ্খ
বিশ্লেষণের
ভিত্তিতে
মইদুল
দেখিয়েছেন,
ইসলামি
রাজনীতির
কাণ্ডারি
বলে
বাইরে
থেকে
জামায়াতকে
একটি
অভিন্ন
সংগঠন
মনে
হলেও
আসলে
আদৌ
তা
নয়। জন্মলগ্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার ফলে ১৯৭০ দশকের গোড়ায় জামায়াত সে দেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু
শেখ
মুজিবুর
রহমানের
ধর্মনিরপেক্ষ
জাতীয়তাবাদী
সরকার
বাংলাদেশের
অর্থনীতির
আধুনিকীকরণে
যে
প্রকল্প
নিয়েছিল
তা
ব্যর্থ
হওয়ায়
মুজিবের
বিরুদ্ধে
মানুষের
ক্ষোভের
প্রকাশ
ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই জামায়াত বাংলাদেশের জনজীবনে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পায়। আশির
দশকে
জেনারেল
জিয়া
এবং
এরশাদের
শাসনকালে
সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতা
পেয়ে
জামায়াত
নব্বইয়ের
দশকে
বাংলাদেশে
তৃতীয়
বৃহত্তম
শক্তি
হিসেবে
উঠে
আসে
এবং
বিএনপির
সহযোগী
দল
হিসেবে
সরকারেও
যোগ
দেয়। অন্য দিকে, ভারতবর্ষে জামায়াতের উপস্থিতি পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশব্যাপী আদপেই নয়, কিন্তু কেরলের মতো আঞ্চলিক রাজনীতির সীমিত পরিসরে আটকে থাকা জামায়াত বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে প্রন্তিক হলেও সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি।
তুলনামূলক
বিচার
করে
মইদুল
দেখিয়েছেন
পরিণামের
মতোই
ভারত
এবং
বাংলাদেশে
জামায়াতের
রাজনীতির
পরিপ্রেক্ষিত,
চরিত্র
এবং
কর্মসূচি
প্রায়
সম্পূর্ণ
আলাদা। ভারতে নব্য-উদারপন্থা বা উদারীকরণের রাজনীতির বিরোধিতাকেই জামায়াত তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রে রেখে বাম এবং অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে পুরোদস্তুর বিশ্বায়ন-বিরোধী রাজনীতির আঙিনায় নেমে এসেছে। ফলে
ইসলাম
ধর্মাবলম্বী
নয়
এমন
মানুষও
এখন
জামায়াতের
সঙ্গে
যুক্ত
হতে
শুরু
করেছেন। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে সরকারে প্রবেশ করার পরে জামায়াত অর্থনীতির বিশ্বায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে। ফলে
সাধারণত
যেটি
ইসলামি
রাজনীতির
অন্যতম
নির্দেশক
বলে
মনে
করা
হয়,
সেই
পুঁজিবাদ
তথা
নিরবচ্ছিন্ন
মার্কিন-বিরোধিতাও
বাংলাদেশের
জামায়াতের
রাজনীতিতে
আজ
বিরল। বাংলাদেশে জামায়াতের মূল পুঁজি আজ তাই রক্ষণশীল ইসলামি সামাজিক মূল্যবোধ।
পাঠকরা
যদি
ভেবে
বসেন,
মইদুল
ভারত
এবং
বাংলাদেশে
জামায়াতি
রাজনীতির
দুটি
ভিন্ন
সীমাবদ্ধতার
কথা
বলেছেন,
তবে
সেটা
হয়তো
খুব
ভুল
হবে
না। ভারতে সমাজের সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের অন্তর্গত অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে, অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরিণামে মানুষের (অর্থনৈতিক) অস্তিত্বের সংকটকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের (ধর্মীয়) সত্তার সংকটকে জামায়াত রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। পক্ষান্তরে,
বাংলাদেশে
সংখ্যাগুরু
সমপ্রদায়ের
প্রতিনিধি
হয়ে
সামাজিক
মূল্যবোধের
ক্ষেত্রে
ইসলামি
সত্তাকে
আঁকড়ে
ধরলেও
বৃহত্তর
সমাজের
স্বার্থে
তারা
অর্থনৈতিক
উদারীকরণের
পক্ষ
নিতে
বাধ্য
হয়েছে। পরিশেষে আরেকটি কথা। বইয়ের
গোড়ায়
গবেষণার
বৌদ্ধিক
উপাদানগুলো
আলোচনা
করতে
গিয়ে
মইদুল
ইসলামি
রাজনীতির
একটি
নির্দিষ্ট
সংজ্ঞা
দেয়ার
চেষ্টা
করেছেন। অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনও সংজ্ঞাই যতটা কম নির্দিষ্ট হয়, ততই ভাল; রাজনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই। ইসলামি
রাজনীতির
নির্দেশক
বলতে
আমরা
ধরেই
নিই
রক্ষণশীল
সামাজিক
মূল্যবোধ,
শরিয়তের
বিধান
অনুসারে
জীবনযাপন,
পুঁজিবাদের
বিরোধিতা,
ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার, আমাদের এ ধারণাগুলো বর্তমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক চিন্তনের বিপ্রতীপে একটি ‘বৌদ্ধিক অপর’ (ইন্টেলেকচুয়াল আদার) হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাই
বাধাধরা
গণ্ডির
বাইরে
গেলেই
মনে
হতে
পারে
‘এই
বুঝি
ইসলামি
রাজনীতির
সীমানা
টপকে
গেল।’ সময়বিশেষে যে কোনও রাজনীতিরই ব্যবহারিক সীমারেখা থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তনের কোনও সীমারেখা থাকলে বিবর্তন হবে কেমন করে? তাই মইদুল যেগুলোকে ইসলামিজমের সীমাবদ্ধতা বলছেন, সেগুলো বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক চিন্তনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন