প্রবন্ধের শুরুতেই জনাব সজীব ওয়াজেদ লিখেছেন-“বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) নিয়ে বাইরে বেশ কিছু সমালোচনা হচ্ছে”। জনাব জয় তার প্রবন্ধে আংশিক সত্য স্বীকারের জন্য প্রথমেই তাকে ধন্যবাদ। প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তিনি অনেক অসত্য ও ইতিহাস বিকৃত তথ্য দিয়েছেন যা সরকারের একজন তথ্য উপদেষ্টার কাছ থেকে জাতি ও তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাশা করে না। জনাব জয় সাহেব হয়ত ভাবতে পারেননি ওয়াশিংটনের প্রবন্ধ দেশের মানুষ ইন্টারনেটের বদৌলতে এত সহজে পেয়ে যাবে? স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে এত আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠবে? সম্ভবত ইতিহাস বিকৃতিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ।
বর্তমান আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে মানবাধিকার এখন মানুষের জীবনের অ-খন্ডিত চেতনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মনে করা হতো, মানবাধিকার কেবল কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাই কোন রাষ্ট্রে নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে অপর কোন রাষ্ট্র তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু এখন তা মনে করার কোন সুযোগ আছে কি? আইনের বিপত্তি ও বির্যয়ের কারণে পৃথিবীতে মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুন্ঠিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, জুলুম, লুটপাট, লুন্ঠন ও রাহাজানি অক্টোপাশের মত গোটা জাতিকে ঘিরে ফেলেছে।
এই বিচারের ব্যাপারে জাতিসংঘ, বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজ্ঞরা যখন সমালোচনা করছেন তখন সরকারের একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রবন্ধ গুরুত্ব সহকারেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন- “বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারে প্রশ্ন তোলার অধিকার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেই’। ‘যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে বলে দিতে চাই, যখন এ দেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলো, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত নেয়া হলো, এক কোটি মানুষকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হলো তখন আপনাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল?” তাহলে জনাব জয় ইনিয়ে বিনিয়ে সে দেশের ম্যাগাজিনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রবন্ধ লিখে বিদেশিদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করছেন কেন?
১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও যুদ্ধাপরাধ ইস্যু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বলে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন করবার কোন সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মনোভাব যেন “আমার মুরগী আমি যেভাবে ইচ্ছা জবাই করব কার কি বলার আছে।” এই প্রবাদের মতোই। বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় এটি একটি বিকৃত চেনতা।
এই বিচারের জন্য প্রণীত আইন ও বিধিমালা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞগণ প্রশ্ন তুলেছেন। ১৯৭৩ সালের আইনে সংশোধন, দলীয় তদন্ত সংস্থা, মিথ্যা অভিযোগ এবং সাজানো সাক্ষী, স্কাইপি কেলেংকারী, আসামী পক্ষের সাক্ষী গুমের ঘটনায় এ বিচার দারুণভাবে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার যুদ্ধাপরাধ বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছে এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে” বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার, আশঙ্কা করা হচ্ছে সরকার তার পরিচিত প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক শত্রুদেরকে দমন করতেই এ বিচারকে ব্যবহার করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ, আইনজীবিদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা এ নিয়ে নানা সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাতই করছেনা। বরং সরকার কখনও বলছে এটা দেশীয় ট্রাইবুন্যাল, আবার বলছে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আবার কখনও বলছে, আন্তর্জাতিক মানের দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। অথচ আইনজ্ঞগণ স্পষ্টই বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনালের না দেশীয় মান আছে, আর না আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং এর দ্বারা একজন নাগরিকের সামান্য অধিকার সংরক্ষণও সম্ভব নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জন বুজম্যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা এক চিঠিতে ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আটকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ করেছেন। সিনেটর বুজম্যান প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, যেহেতু আপনার সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের একনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত, সেহেতু জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাই হলো ট্রাইব্যুনালের প্রথম কাজ; এ বিশ্বাসই সমাজে এখন বিদ্যমান। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হতে পারে”। তাছাড়া এ বিচারের সাথে আন্তর্জাতিক কোন বিশেষজ্ঞ কে সম্পৃক্ত করা হয়নি। অনুমতি দেয়া হয়নি আসামী পক্ষের বিদেশি আইনজীবিকে দেশে আসার। বরং সরকার কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ টবি ক্যাডম্যান সহ অনেকেই বিভিন্ন ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জনাব জয় লিখেছেন-”কিন্তু দেশের ভিতরে যুদ্ধাপরাধের এই বিচার ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে। এ আদালত যে রায় দিয়েছেন তাকে জাতীয় ছুটির মতো উদযাপন করা হয়েছে। দেশাত্নবোধক গান গাওয়া হয়েছে। রাজপথে তাৎক্ষণিক পার্টি হয়েছে। শিশুদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকরের পর দু’দিন পর্যন্ত ঢাকার রাজপথে ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন। গত নভেম্বরে যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর একই রকম সমর্থন প্রকাশ পায়”। জনাব জয় আমেরিকায় বসে টিনের চশমা পড়ে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি কি অস্বীকার করছেন? এই বিচারের প্রতি জনগণ তো দূরের কথা, আওয়ামীলীগেরও সকল নেতা-কমীরও সমর্থন নেই।
সরকারের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে করা এই বিচারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ডাকা প্রতিটি হরতালে জনগণের সমর্থন ছিল স্বত:স্ফুর্ত। ঢাকার রাজপথ ছিল জন-মানব শুণ্য আর দোকান-পাট ও কলকারখানা ছিল বন্ধ। জনগনের সাংবিধানিক অধিকার সভা সমাবেশ করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, এই সবই কেড়ে নিয়েছে আওয়ামীলীগ সরকার। মিডিয়ার উপর চলছে অ-ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। জামায়াতের দলীয় সূত্র মতে, জনগনের রাজপথের প্রতিবাদ দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে পুলিশ-র্যাবের গুলি, ক্রসফায়ারে এ পর্যন্ত ৬৬৮ জন নিহত, ৭০ হাজার ৩’শ এর অধিক আহত, আটক করা হয়েছে ১ লক্ষ ৫১ হাজারের অধিক, ২ লক্ষ ৩’শ এর অধিক রাজনৈতিক মামলায় ১০ লক্ষ ২ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে।” দেশের জনগণ এটিকে নিছক রাজনৈতিক হত্যাকা- মনে করে। এই বিচারের প্রতি দেশের ৫% মানুষের সমর্থন নেই। তারপরও জনাব জয় জনগণের সমর্থনের কথা বলেন?
আওয়ামীলীগের সাবেক প্রবীণ নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন- “আওয়ামীলীগ আগামী নির্বাচনে জিতার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। তিনি আওয়ামীলীগকে নিজের ঘর থেকে বিচার শুরুর আহবান জানান”। কথিত আছে শেখ-হাসিনার বেয়াই, সরকারের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন সহ অনেকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আ.স.ম রব বলেন- “যুদ্ধাপরাধের বিচার রাজনৈতিক ইস্যু”। দেশে-বিদেশে এতসব সমালোচনার পরও সরকার রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে জনমতকে উপক্ষো করে বিচারের নামে নাটক মঞ্চস্থ করে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের হত্যা করে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে ফাঁসির মত ঘৃণ্য মৃত্যুদন্ডকে সবাই যখন প্রত্যাখ্যান করছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ফাঁসি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ আওয়ামীলীগের ঘৃণ্য জিঘাংসার বহি:প্রকাশ ছাড়া বৈই কি। এজন্য হযরত আলী (রা:) বলেছেন-“অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের অন্তরে যে-বিদ্বেষাগ্নির জন্ম হয়, তা অত্যাচারীকে ভস্ম করেই ক্ষান্ত হয় না, সে আগুনের শিখায় অনেক কিছুই বষ্মিভূত হয়। সে আগুনে পুড়ছে এখন গোটা দেশ।
মুলত আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে আদর্শিক প্রতিপক্ষকে যেকোন মূল্যে দমন করতে দ্বিধা করছে না তা যতোই আইন, নীতি-নৈতিকতা, সভ্যতা-ভব্যতা ও মানবিকতা পরিপন্থী হোক না কেন। সেই পরিকল্পনা নিয়ে জয় সাহেবরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য একটাই বিরোধী মতশূন্য বাংলাদেশ। কিন্তু শক্তি প্রয়োগ করে জনগণের বিজয়কে কেউ দমাতে পারেনি। এজন্য জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন-“মিথ্যাবাদীর শাস্তি এই নয় যে, তাকে কেউ বিশ্বাস করে না, সে নিজেই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না”।
জনাব জয় লিখেছেন-“কিন্তু ভয়াবহ নৃশংসতা সংঘটনকারী এসব ষড়যন্ত্রকারীরা ৪০ বছরেরও বেশি সময় বিচারের হাত থেকে পালিয়ে ছিল”। জনাব জয় এখানে দারুণ ভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছেন। এজন্য শেখ সাদি-বলেছেন-“যুক্তিতে না পারলে শক্তিতে দেখে নেব, এটাই বর্বর নীতি”। জনাব জয় কি ভূলে গেছেন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর সাথে একত্রে রাজপথে আন্দোলন করেছে? কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একসাথে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করেননি? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ নেতা জনাব তোফায়েল, আমু ও আব্দুর রাজ্জাক সাহেবরা জামায়াত নেতাদের সাথে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নে দফায়-দফায় লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক ও একত্রে খাওয়া-দাওয়াসহ পরস্পর অনেক উঠাবসা করেননি?
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদে আওয়ামীলীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দারকে সমর্থনের প্রস্তাব নিয়ে আওয়ামীলীগের নেতারা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের কাছে ধরনা দেননি?। জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব করেননি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেদিন যদি জামায়াত তাদের সাথে সরকার গঠনে রাজি হতো তাহলে হয়তো আজকে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হতো না। তারও আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের সাথে স্বৈরশাসক আইয়ুব ও ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনে COP, DAC, PDM-গঠন করে এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকা- যুগপৎভাবে পরিচালনা করেছে এই জামায়াত নেতৃবৃন্দই”। ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সব ভুলে গেলেও দেশের জনগন কিন্তু ইতিহাস ভুলে যায়নি যাবেও না। কথায় বলে- “এক মাঘে শীত যায়না” আর ক্ষমতাও চিরস্থায়ী নয়।
প্রধানমন্ত্রীপুত্র আরো লিখেছেন-“১৯৭০-এর দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা পুনর্গঠন করেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে তার রাজনৈতিক শত্রুরা হত্যা করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওই উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিল”। হ্যাঁ এ কথা সত্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান নিয়েছিলেন। তদন্ত করে যুদ্ধাপরাধীদের ১৯৫ জনের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তালিকাভূক্ত সবাই ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার। কোন বেসামরিক নাগরিকের নাম ঐ তালিকায় ছিল না। বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে যারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিল তাদের বিচারের জন্য দালাল আইন করা হয়। এই আইনে লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার করা হয়। ৩৭ হাজার ৪ শ ৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২ হাজার ৮ শ ৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭ শ ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এদের মধ্যে এই জামায়াত নেতাদের কেউই ছিলেন না।
জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের কোন থানায় কোন মামলা দায়ের তো দূরের কথা একটি সাধারণ ডায়েরীও করা হয়নি। উপরন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় থাকার পরও বর্মতান গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধের যুদ্ধাপরাধ অথবা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেননি। এখন জামায়াত আওয়ামী বিরোধী জোটে আছে বলেই বিচারের নামে নেতৃবৃন্দকে হত্যার এই ঘৃন্য প্রয়াস। শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশের শান্তির কথা চিন্তা করেই সিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক সমাধান করে যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা তা লঙ্ঘন করে তার সাথে দ্ধন্ধে জড়িয়ে পড়ছেন? ইতিহাস হয়ত একদিন প্রমাণ করবে তা উদ্যোগ যথার্থ ছিলনা।
শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সময় রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে কোন দল বা ব্যাক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেনি। মালেক মন্ত্রিসভায় সদস্য এবং পিস কমিটির কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায়ের কোন নেতাকে ওখানে শামিল করা হয়নি। রাজনৈতিকভাবে শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন সবুর খান সাহেব, তাকে বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব নিজেই জেলখানা থেকে মুক্ত করে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেবের নেতৃত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ১৯৫ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অথচ জুলফিকার আলী ভুট্টোই জেনোসাইডের নায়ক। সেই ভুট্টো সাহেব চুয়াত্তরে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং নজিরবিহীন রিসিপশন পেয়েছিলেন। আওয়ামীলীগ কি এসব ইতিহাস অস্বীকার করতে পারবে?
ব্ল্যাক স্টোন-বলেছেন “একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে ভোগানোর চেয়ে দশজন দোষী ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া ভালো”। মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন-“ন্যায়বিচার হলে নিজামী খালাস পাবেন। একই কথা বলেছেন প্রধান আইনজীবী ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাক- “একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বলতে চাই, মানবতাবিরোধী অপরাধে যে চারজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইনের অধীনে বিচার হলে, তাদের কারোরই ফাঁসি হতো না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে বিচার করতে বলেছে, সেভাবে বিচার করা হলে কারোরই ফাঁসি হতো না বলে আমি মনে করি। সকলেই মুক্তি পেতেন।”
জয় লিখেছেন-“আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উত্তম মানদন্ড হলো রোম স্ট্যাটিউট। সে অনুযায়ী শেখ হাসিনা গঠন করেছেন দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এখানে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তা উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। যে কেউ বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন”। এ সম্পর্কে প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদ- যুদ্ধাপরাধের বিচার” শিরোনামে এক কলামের অংশ প্রণিধান যোগ্য। তিনি লিখেছেন- “অনেকে আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তুলনা করতে চাচ্ছেন নুরেমবার্গের বিচারের সাথে। কিন্তু এই তুলনাকে কোনোভাবেই যথাযথ বলা চলে না। কেননা, জার্মানি করেছিল অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ। কিন্তু সাবেক পাকিস্তান ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি রাষ্ট্র। পূর্বপাকিস্তান ছিল তার একটি প্রদেশ। আর এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগে থেকেই ছিল। বিদেশী কোনো বাহিনী হিসেবে নয়, স্বদেশী বাহিনী হিসেবে। ১৯৭১-এ এ দেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনসমষ্টি পাকিস্তান জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল ছিলেন। তারা সমর্থন করেছিলেন তদানীন্তন সামরিক সরকারকেই। তারা ছিলেন ভারতের আগ্রাসনবিরোধী”। (১৮মার্চ-২০১৬ দৈনিক নয়া দিগন্ত)
জনাব সজিব লিখেছেন-”বাংলাদেশের মানুষ নিবিড়ভাবে দেখেছেন ট্রাইব্যুনাল কত স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশের মানুষ এই ন্যায়বিচারের পক্ষে। এ জন্যই এ বিচার বাংলাদেশে এত জনপ্রিয়। তাই এ বিচার অব্যাহত থাকা উচিত”। যে বিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে এত সমালোচনা জনাব জয় এরপর এই বিচার কে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য বলছেন? প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হোক এটাই জনগণ প্রত্যাশা করেন।
এই আইন এতটাই মৌলিক অধিকার হরণ করছে ট্রাইবুনালের বিচারক পর্যন্ত বলেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া আর কত আটকিয়ে রাখা যায়। যদি ও এটি বিচারকরের বিবেকের কথা। এর মাধ্যমে জনমনে দারুণভাবে দেখা দিয়েছে বিচারকরা কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন? এ জন্য এন্ড্রিউ কলিন্স বলেছে-”বিবেকহীন মানুষকে অস্বীকার করে যে কাজ করে, খুব শীগগিরই সে বিবেকের কাছে নতি স্বীকার করে”।
জামায়াতের আমীর নিজামীর আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছেন। এতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, নিজামীর সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে আপনাদের কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। এতে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে কি? এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং হত্যাও সংঘটিত হয়েছে এ বিষয়গুলো তো নিজামীর আইনজীবীরা স্বীকার করেছেন। কিন্তু নিজামী সরাসরি হত্যা, ধর্ষণে জড়িত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আপনাদের কাছে আছে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল আইনে সরাসরি হত্যায় জড়িত থাকতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। এ আইনে হত্যায় কাউকে উৎসাহিত করলে বা উস্কানি দিলে তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রধান বিচারপতি আবারও বলেন, আল-বদর বাহিনীর হয়ে নিজামী বক্তব্য দিয়েছেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণ কোথায়? প্রধান বিচারপতি আবার প্রশ্ন করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ গ্রহণ না থাকলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে কি?
প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ‘৭১-এ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী’ নামক বইয়ে নিজামীর নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় মতিউর রহমান নিজামী উস্কানি দিয়েছেন।’ একই ব্যক্তির দুই রকম বক্তব্য হওয়ায় এতে করে নিজামীর জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তখন কি বইয়ে নিজামীর নাম বলা যেত না? প্রধান বিচারপতি বলেন, নিজামীর ৭১ সালের ঘটনা অস্বীকার করছেন না। কিন্তু সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে উল্লেখ করতে পারলেন না। (সূত্র : শীর্ষ নিউজ) তাই বেকন বলেছে-”আইনের মাধ্যমে অত্যাচার করার চেয়ে বড় অত্যাচার আর নেই”। সেই নির্যাতনই এখন যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে বাংলাদেশে চলছে..