ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে অনেকেই আমাকে লিখতে বলেছেন। কি লিখব?
নির্বাচন হবে উৎসবের। বাঙ্গালী উৎসব প্রিয় জাতি। ১৯৫৪ সালে ভোট দেওয়ার বয়স হয়নি। শিশু ছিলাম। তারপরেও মহা আনন্দে এ কেন্দ্র থেকে সে কেন্দ্রে ছুটে গেছি। প্রার্থীরা বা তাদের এজেন্টরা ধরে ধরে খাইয়েছে চা এবং লাঠি বিস্কুট। মহা আনন্দে কিছুই না বুঝে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে শ্লোগান দিয়েছি। আমার মরহুম আব্বা সরকারি চাকুরি করতেন। তাই তিনি নির্বাচনী প্রচারনায় প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। কিন্তু আমার মামা একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরি করতেন। বিকাল বেলা অফিস থেকে এসে মামা রিক্সায় একটি মাইক নিয়ে সারা গ্রাম চষে বেড়াতেন। সেই মাইকে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাতেন। বগুড়ায় তখন সদর কেন্দ্র থেকে মুসলিম লীগের টিকেটে দাঁড়িয়েছিলেন সেই সময়কার বগুড়ার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি মুজিবুর রহমান ভান্ডারীর মেয়ের জামাই সারওয়ার। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হবে, সকলেই জানতেন। হয়েছিলও তাই। কিন্তু সারওয়ারের জনসভায় কেউ গন্ডগোল করেনি, তার পোষ্টার কেউ ছেঁড়েনি, তার নির্বাচনী মিছিলে কেউ হামলা করেনি। আমার আম্মার সাইডের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মুসলিম লীগের চোঙ্গা ফুঁকত। তাকে সকলে বন্ধু হিসাবে টিটকারী মারতো। কিন্তু কেন সে মুসলিম লীগ করে সেই জন্য কেউ তাকে চোখ রাঙ্গায়নি। যুক্তফ্রন্টের ক্যান্ডিডেট জয়লাভ করলে যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল সেই মিষ্টান্ন ভোজনে আমাদের সেই মুসলিম লীগের আত্মীয়ও শরীক হয়েছিল। এই তো ১০/১২ বছর আগে আমাদের পাড়ার ইউনিয়ন বোর্ড নির্বাচনে বালু বিসা নামের এক লোক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ইলেকশনের পর তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বিসহ সকলকে আপ্যায়ন করিয়েছিলেন।
কিন্তু এবার কি হলো? দুই পর্বের ইলেকশন শেষ হয়েছে। এই দুই পর্বেই দেখলাম লাশের মিছিল। প্রথম পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্ব মিলে নিহত হয়েছেন ৩৮ জন (মানব জমিন: ০২.০৪.২০১৬) দুটি পত্রিকা অবশ্য লিখেছে ৫২ জন। এই ৩৮ জনের মধ্যে রয়েছে একটি শিশু ও একজন ছাত্র। এই ৩৮ টি লাশ দেখার জন্যই কি এই সরকার ইউনিয়ন বোর্ডেও দলীয় ভিত্তিতে ইলেকশন করছে? কেবল মাত্র দুইটি দফার নির্বাচন শেষ হয়েছে। আরো ৪ টি দফা বাকি আছে। প্রতিটি দফায় যদি ১৯ জন করে মারা যায় ( কারণ দুই দফায় ৩৮ জন মারা গেছে) তাহলে ৬ দফায় ১৯দ্ধ৬=১১৪ জন মারা যেতে পারে। তাহলে এই শতাধিক লাশ দেখার জন্যই কি সরকার দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশন দিয়েছে? দুই দফায় ৪ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাহলে ৬ দফায় অন্তত ১২শত ব্যক্তি আহত হতে পারেন। এই সহ¯্রাধিক ব্যক্তির জখম হওয়ার জন্যই কি ইউনিয়ন পরিষদের লেভেলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো? দুই দফায় ৪০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাহলে ৬ দফায় কি ১২০ জন গুলিবিদ্ধ হবেন? এই জন্যই কি ইউনিয়ন বোর্ডেও পার্টি ভিত্তিক নির্বাচন? মঠবাড়িয়ায় পুলিশ কোনো রূপ কাঁদানে গ্যাস না ছুঁড়ে বা কোনো ওয়ার্নিং না দিয়ে সরাসরি গুলি করেছে। মারা গেছে ৫ জন। আগে গোলাগুলি ও মারামারি হতো ঢাকার মহানগরীতে, বড় জোড় বড় বড় শহর গুলিতে। এবার আওয়ামী লীগ সরকার মারামারি, রক্তারক্তি ও খুনাখুনিকে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গেল। এই জন্যই কি ইউনিয়ন পরিষদেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন?
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে অনেকেই আমাকে লিখতে বলেছেন। কি লিখব? ৮৩ শতাংশ ভোট পড়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা বাক্সে। সেই কথা লিখব? তাহলে তো আমাকে লিখতে হয় যে, দেশের ৮৩ শতাংশ লোক আওয়ামী লীগের সমর্থক। বাকি থাকলো ১৭ শতাংশ। এদের কে ভাগাভাগি করে দিন। ১০ শতাংশ পাবে বিএনপি, ৪ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী, বাকি ৩ শতাংশ অন্যান্য ইসলামী ও বামপন্থী দল। এই কথা লিখব? এসব কথা লেখার জন্য আমাদের মতো কলামিষ্টদের কোনো প্রয়োজন নাই। প্রতিদিন এসব খবর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই আমরা আর নতুন করে কি লিখব? আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে এতোই জনপ্রিয় হয়ে গেল যে, প্রথম দফা নির্বাচনে তারা পায় ৫৩৬ টি চেয়ারম্যানের পদ এবং বিএনপি পায় ৪০ টি চেয়ারম্যানের পদ। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ৪২১ টি এবং বিএনপি পায় ৫১ টি। অর্থাৎ এই দুই দফায় আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৯৫৭ টি এবং বিএনপি পেয়েছে ৯১ টি। অর্থাৎ বিএনপি পেয়েছে ৯.৫ শতাংশ আসন এবং আওয়ামী লীগ ৯০.৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে এখন ৯০.৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক, আর ৯.৫ শতাংশ মানুষ বিএনপির সমর্থক। এই কথাও কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? এবং সেটি লিখতে হবে? তাই তো শুরুতে বলেছি, কি লিখব?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন