মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস অতি প্রাচীন। যুগে যুগে আল্লাহর সৈনিকরা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন। অন্যদিকে বাতিল শক্তি সত্যের টুঁটি চেপে ধরে আল্লাহর নুরকে ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। হক ও বাতিলের লড়াই চিরন্তন। ইব্রাহীম (আ.) ও নমরুদের, মূসা (আ.) ও ফেরাউনের, হযরত মুহম্মদ (সা.) ও আবু জেহেলের লড়াই এর ধারা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাদের উত্তরসূরিরা আজোও দেশে দেশে কালেমার ঝাণ্ডাবাহী সৈনিকদের জেল জুলুম ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে স্তব্ধ করে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী সৈনিকরা লড়াই করে আজোও কালেমার দাওয়াত মানুষের কাছে পেশ করছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস বেদনায় ভরপুর রক্তে ভেজা কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস। শহীদ হাসান আল বান্না, শহীদ আব্দুল কাদের আওদা, শহীদ কুতুবের শাহাদাতের ইতিহাস এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে। আমরা অনেক ইতিহাস ও ঐতিহাসিকের নাম জানি। কিন্তু যারা ইসলামী আন্দোলন করতে গিয়ে আল্লাহর রাহে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাদের ইতিহাস ভুলতে বসেছি।
সৃষ্টির সূচনা থেকে ইসলামের সাথে বাতিলের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। যুগে যুগে যারাই সত্য ও ন্যায়ের পথে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন তাদেরই জীবনে নেমে এসেছে অমাবস্যার অন্ধকার। পৃথিবীতে এমন একটি জাতি বা দল আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কি যারা আল্লাহর পথের দাওয়াতের বিনিময়ে গোলাপের পাপড়ি উপহার পেয়েছেন? এটা নতুন কিছু নয়। ইসলামের ইতিহাস এখনও যে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়নি এটাই বিশ্বনিয়ন্তার একান্ত করুণা। ইসলামের অনেক ইতিহাস মিসরের মাটি বালির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। মিসরের মাটিতে হযরত হারুন (আ.), হযরত মূসা (আ.), ইলিয়াস (আ.), হযরত সালেহ (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.), ইমাম শাফী (রাহ.) মতো বরেণ্য অনেক গুণীজন জন্মগ্রহণ করেছেন। যে দেশের মাটিতে নবী রাসূলের স্মৃতি আজোও বহমান সেই দেশে অভিশপ্ত ফেরাউন ও জন্মগ্রহণ করেছে। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যেখানে মুসা সেখানে ফেরাউনের আবির্ভাব হয়েছে। ইসলামের সাথে দুশমনি করার পরিণতি কি হতে পারে তা বুঝানোর জন্য দুনিয়া ও আরশের অধিপতি অভিশপ্ত ফেরাউনের লাশ মমি করে রেখে দিয়েছেন, যাতে করে নব্য ফেরাউনেরা শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর জালেমশাহী স্বৈরাচারেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।
মহান আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা জীবন বিধানের বিরোধিতা করার অপরাধে যে মিসরের নীলনদে ফেরাউন ডুবে মরলো, সেই মিসরে নব্য ফেরাউনের প্রেতাত্মারা আল কোরানের সৈনিকদের সাথে পূর্বের ফেরাউনের মতোই ঘৃণ্য আচরণ করেছে। চাওয়া পাওয়ার এই পৃথিবীতে নানা যুগে বিভিন্ন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। সূর্যের আলোতে অন্য নক্ষত্র দেখা যায় না, কিন্তু রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো ঠিকই ভেসে ওঠে। ঠিক একই ভাবে শহীদ আব্দুল কাদের আওদাহ মিসরের জমিন আলোকিত করেছিলেন। তিনি এক বিস্ময়কর প্রতিভা, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সমকালীন বিশ্বকে কাঁপিয়ে তোলার মতো এক অবিস্মরণীয় নেতা ছিলেন। মিসরে যেমন ফেরাউন জামাল নাসেরের মতো ইসলামবিরোধী অসাধারণ প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তেমনি আব্দুল কাদের আওদার মতো অসংখ্য ইসলামী প্রতিভার জন্ম হয়েছে। মিসরে স্বৈরাচারী সরকার কালের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গুলী করে, ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করেছে। তাদেরই একজন ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা বীর মুজাহিদ শহীদ আব্দুল কাদের আওদাহ (রা.)। দুনিয়ার সকল নির্যাতিত নিপীড়িত, মজুলম পরিবারের জ্ঞাতার্থে তার কিছু কাহিনী তুলে ধরছি:
মানুষের কীর্তি মানুষকে চিরভাস্বর করে রাখে। মৃত্যুর পরেও কিছু মানুষ হয়ে থাকে অমর। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার বয়সের জোরে কেবল মানুষের মনের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে না। মানুষ বেঁচে থাকে তার পূর্ণ গৌরবময় কর্মের দ্বারা। শুধু মিসর বললে ভুল হবে, সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ আজাও সাইয়েদ কুতুব, হাসানুল বান্নার মতো শহীদ আব্দুল কাদের আওদা (রাহ.)র স্মৃতি হৃদয়ে লালন করছেন। পিরামিডের দেশ মিসরে জন্মগ্রহণ করেন ইখওয়ানের প্রথম সারির নেতা বীর মুজাহিদ আব্দুল কাদের আওদাহ। তিনি শহীদী মৃত্যুর পেয়ালা পান করে এক যোগ্য ও আদর্শ নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের উদাহরণ মিসরের মানুষের সামনে রেখে গেছেন। মিসরের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অনন্য ও অদ্বিতীয়, যিনি আদর্শের জন্য লড়াই করতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও ঈমানের জয়গান গেয়েছেন। তাঁকে যখন ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আল্লাহর এই বান্দা নির্ভিক কণ্ঠে উচ্চারণ করছিলেন, ‘আমি কোথায় কিভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি, এটা আমার মাথাব্যথার কারণ নয়। আমি যে মুসলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার সুযোগ পেয়েছি এটাই আমার জীবনের সব চাইতে পরম পাওয়া।
আব্দুল কাদের আওদাহ আইন বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তিনি তৎকালীন মিসর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অত্যন্ত দ্বীনদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সরকারের নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনকারী সময়ে সুয়েজ খালের পূর্বদিকের কলেজ এলাকায় নির্বাচনী পরিদর্শক হিসেবে গেলে দেখতে পান, মিসরের পার্লামেন্টের সদস্য প্রার্থী ইখওয়ানুল মুসলিমীনের নেতা ইমাম হাসানুল বান্নার বিরুদ্ধে সরকার ন্যক্কারজনকভাবে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। নির্বাচনে হাসানুল বান্নার নিশ্চিত বিজয় জেনে সরকার তাকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে হীনপথ অবলম্বন করছে। নির্বাচনের এই অবস্থা দেখে সত্য ও ন্যায়ের পূজারী আবদুল কাদের আওদাহ বীর মুজাহিদের মতো গর্জে ওঠলেন। সশরীরে তিনি হাসানুল বান্নার নির্বাচনী এলাকা ইসমাইলিয়ায় উপস্থিত হয়ে এক বিরাট জনসভার ব্যবস্থা করেন। তিনি সরকারের ন্যক্কারজনক হীন আচরণের প্রতিবাদে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সরকারের পেটুয়া বাহিনী কর্তৃক কোনো রকমের অসুবিধার শিকার হন তাহলে আমি আপনাদের সহযোগিতা করবো।
একজন ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক হিসেবে গোটা মিসরে তাঁর সুনাম সুখ্যাতি ছিল অতুলনীয়। জজ থাকাকালীন সময়ে তিনি কখনো পথভ্রষ্ট বা লোভের বশবর্তী হয়ে কোন রায় দেননি। তিনি সর্বদা বলতেন আমি একদিকে বিচারক আরেক দিকে আমি একজন মুসলমান। যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে বিবেকবান একজন জজের পক্ষে ন্যায় বিচার করা সম্ভব নয়। যেখানে যার লাঠি তারই মেষ নীতি প্রবর্তিত- যেখানে লুটতরাজ জুলুমের বৈধতাকে আইন বলে চালিয়ে দেয়া হয়, জালেমদের ক্রীড়নক হয়ে যেখানে আইনের বাণী নির্জীব হয়ে পড়ে, যেখানে শাসকদের জ্বী হুজুর করার সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, মিথ্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতাকে যেখানে আইন বলে চালিয়ে দেয়া হয়, স্বৈরাচার ও চরিত্রহীনতাকে যেখানে উন্নতির মানদণ্ড বলে গ্রহণ করা হয়, সেখানে একজন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি কি করে নির্বিকার থাকতে পারে? ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কর্মীদের ওপর কায়েমী স্বার্থন্বেষীদের নির্মম বর্বরতা দেখে আবদুল কাদের আওদাহ (রাহ.) বলেন, একটি দেশে ইসলামের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও সরকার ও শাসকবর্গ যেখানে ইসলাম বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকবে, সেখানে কোনো সুস্থ বিবেকবান জজ বিচার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে না। তিনি আরো বলেন, যে দেশের জনগণ নিজেদের জীবনকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, সে দেশের ইসলামী আন্দোলনও বিলীন হয় না।
ইখওয়ানের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছে রাষ্ট্রশক্তি তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। একদিকে বিপ্লবী সরকার ফেরাউন, নমরুদ, চেঙ্গিস ও হালাকু খানের স্মৃতি সজীব করে তুলছিল। অপরদিকে ইখওয়ানের হাজারো বন্দী নেতাকর্মীরা বেলাল, খোবাইব এবং সাঈদ বিন জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো ইসলামের পতাকাকে মিসরের বুকে উড্ডীন করে রাখার জন্য জীবন দিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৫০ সনে মিসরের জালিম স্বৈরাচার শাসক অন্যায়ভাবে ইখওয়ান মুসলিমীনকে বেআইনী ঘোষণা করে। তাদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। তখন আবদুল কাদের আওদাহ ছিলেন বিচারপ্রতি। ইখওয়ানুল মুসলিমীন সরকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে আদালতে পিটিশন দায়ের করে। আবদুল কাদের আওদাহ মামলার শুনানি গ্রহণ করে ইসলামী আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের পক্ষে রায় দিয়ে মিসরের জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন। মহান আরশের অধিপতির করুণায় তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিস্তারিত কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত হয়ে ইখওয়ানে যোগদান করেন। শুধু যোগদান করেই তিনি নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে বিচারপতির আসন ত্যাগ করে উকিল হিসেবে কোর্টে যোগদান করলেন। কারও কারও মনে অবিশ্বাস্য হতে পারে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শহীদ আবদুল কাদের আওদাহ দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে এক আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় সব কিছু ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরকম দৃষ্টান্তের নজির যদি আজোও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা দিতে পারে, তাহলে তাদের বিজয় হবেই ইনশাআল্লাহ।
শহীদ আবদুল কাদের আওদাহর ন্যায় নীতির ইতিহাস: শহীদ আবদুল কাদের আওদাহ ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব প্রজ্ঞা ধৈর্য্য ও খোদাভীরুতার সাথে পালন করেছেন। তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হলো-ইসলামের ফোজদারী আইন (আততাশরীহুজ জিনায়িল ইসলামী) এটি দুটি বৃহৎ খণ্ডে সমাপ্ত। এই গ্রন্থটি পৃথিবীর আইনজীবী মহলের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে।
তিনি এ গ্রন্থ ১৯৫১ সালে রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিশেষ অবদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, লেখককে ‘ফয়াদুল আউয়াল’ পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। কিন্তু এ গ্রন্থের লিখিত দুটি কথার উপর মিসর সরকারের অবজেকশন ছিলো। সরকারের পক্ষ থেকে আবদুল কাদের আওদাহর উপর চাপ প্রয়োগ করে শর্ত আরোপ করা হলো গ্রন্থ থেকে দুটি বাক্য বাদ দিতে হবে। একটি হলো- ইসলামে রাজতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। অপরটি হলো, ইসলামে কোন বিচারকই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ইসলামী আন্দোলনের এই বীর মুজাহিদ স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি যা লিখেছেন, তা কোরআন হাদীস অনুযায়ী লিখেছেন। সে জন্য তিনি এই বাক্যগুলো মুছে ফেলতে অস্বীকার করেন। এবং সরকারি পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন। যার মূল্য ছিল তৎকালীন মূল্যে এক হাজার মিসরীয় পাউন্ড।
ফাঁসির মঞ্চে আবদুল কাদের আওদাহ : শহীদ আবদুল কাদের আওদাহ দুনিয়ার পূজারী ছিলেন না। তিনি মিসরের জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দখল করতে পেরেছিলেন। একজন সরকারি জজ হয়েও মিসরের প্রচলিত আইন কানুনের সমালোচনার ঝড় তাঁর বক্তব্য বিবৃতির বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলতেন মিসরের জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলামী আইনের বাস্তব রূপায়ণ। তিনি যখন জজ ছিলেন তখন প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে আদল, ইনসাফও সুবিচারের ফর্মুলায় ফেলে বিচার করতেন। যুগে যুগে যারাই ইসলামের কথা বলেছে তারই রাষ্ট্রশক্তির রোষানলের শিকার হয়েছে। এ ইতিহাস নতুন কিছু নয়। তবে মিসরের স্বৈরশাসক জামাল নাসেরের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার ইখওয়ানের হাজারো নেতাকর্মী।
ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তা নাসের কল্পিত অভিযোগ এনে তাদেরকে জেলের কুঠরিতে বন্দী করে রাখে। সত্য পথের যাত্রীদের জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার নির্মম কালো এক অধ্যায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলাম মিসরের জালেমশাহী সরকার বিচারের নামে প্রহসন করে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের জেল ও ফাঁসি দেয়া শুরু করে।
মিসরের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে যে সকল মুজাহিদ ফাঁসির রশিকে হাসি মুখে গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে শহীদ আবদুল কাদের আওদাহ ছিলেন অন্যতম। তার মৃত্যুর এত বছর পরও আমরা পৃথিবীবাসীরা তাকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। কারণ আবদুল কাদের আওদাহ একটি নাম একটি জীবন্ত ইতিহাস। অবিনাশী এক শক্তির নাম।
১৯৫৪ সনে নাসের সরকার ইখওয়ানকে বেআইনী ঘোষণা করে। সে সময়ে আব্দুল কাদের আওদাহকেও বন্দী করা হয়। কারণ মিসরের জনগণ তাকে খুব সম্মানের চোখে দেখতো। কিন্তু আল্লাহর এই বান্দা ইসলামের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে বাধ্য হয়ে তখন জেনারেল নজীব ও কর্নেল নাসেরের মধ্যে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন।
জেলখানার ভেতরে ইখওয়ানের নিরীহ নেতাকর্মীদের উপর যেভাবে জুলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয়েছে ঠিক একই কায়দায় ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ শহীদ আবদুল কাদের আওদাহর উপর নির্যাতন চালানো হয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ এনে বিচারের নামে অবিচার করা হয়। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের শাহাদাত সম্পর্কে মিসরের বিখ্যাত দৈনিক ‘আল-মিসরী’র সম্পাদক আহমদ আবুল ফাতাহ রচিত গ্রন্থ ‘জামাল আবদুন নাসর’ থেকে একটি উদ্ধৃতি পাঠকদের খেদমতে পেশ করছি। কারণ তার ক্ষুরধার লেখনির মধ্যে বিচারের নামে যে প্রহসন করা হয়েছে তা ফুটে উঠেছে। আহমদ আবুল ফাতাহ লিখেন: ‘‘গ্রেফতারকৃত ইখওয়ানদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালিত হয় সে আদালতে, জামাল আবদুন নাসের যার নাম পিপলস কোর্ট (মাহকামাতুশ শা’বা) অভিহিত করে। এ আদালত ছিল তিনজন জজের সমন্বয়ে গঠিত। আর এই তিনজনই ছিল জামাল নাসেরের সহকর্মী এবং বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। প্রকাশ থাকে যে, এ ধরনের বিচার কার্যক্রম লজ্জাজনক নাটক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আরোপ করা হয়। কিন্তু তারা যখন আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন তখন তাদের দেহ ও মুখম-লের ওপর পাশবিক নির্যাতনের চিহ্ন সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো। অথচ ‘জজ’রা একবারও আদালতে এ নির্মম শাস্তি নির্যাতনের বিষয় উত্থাপন করেনি।”বিচারে নামে যে অবিচার করা হয়েছে তা আহমদ আবুল ফাতাহার লেখনির মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ কথা তো দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধিতার কারণে ইখওয়ানের নেতাদের ফাঁসির রশিতে ঝুলতে হয়েছে। যে আদালতের মাধ্যমে নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছিল, সে আদালত নাসেরের আজ্ঞাবহ আদালত ছিল।
আদালত সাত ব্যক্তিকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন আবদুল কাদের আওদাহ। তিনি ছিলেন ইখওয়ানের আধ্যাত্মিক নেতা। নাজীব ও ইখওয়ানের মাঝে তিনিই ছিলেন মধ্যস্থতাকারী। আদালতের ভেতর তিনি আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিত বক্তব্য পেশ করেন এবং তাকে যখন মৃত্যুর পরওয়ানা শোনানো হয়, তখন তিনি মুচকি হেসে কৃতজ্ঞ চিত্তে তা গ্রহণ করেন। ইতিহাস সাক্ষী আল্লাহর এই বান্দা দুনিয়ার আরাম আয়েশের চেয়ে পরকালের মুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। ফাঁসির মঞ্চের দিকে যাওয়ার সময় আরবী কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন তিনি। যার মর্ম হলো-‘আমি যদি আল্লাহর পথে জীবন দিতে পারি, তবে আমার কোনো কিছুর পরওয়া নেই।’
তিনি তার মাথা উঁচু করে আরো বলেছিলেন- ‘ আমার রক্ত বর্তমান সরকারের জন্য অভিশাপে পরিণত হবে।’ আবদুল কাদের আওদাহ ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই আল্লাহর রাহে নিজের প্রিয় জীবনটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। ঈমানদার ব্যক্তি কখনও বিপদে আপদে ধৈর্য হারায় না। জীবনের চরম মুহূর্তে সে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। যে কোনো ধরনের বিপদই আসুক না কেন ঈমানদারেরা কেবল আল্লাহর ওপরে ভরসা করে থাকে। দুনিয়ার কল্যাণের চেয়ে আখেরাতের কল্যাণকে বেশি পছন্দ করে ঈমানের বলীয়ান থাকে বীর মুজাহিদ। কারণ ঈমানদার এ কথা জানে যে, বিপদের মধ্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
আম্বেয়ায়ে কেরামগণের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাই, যারাই ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করে কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন তারাই যড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। মহান অধিপতির নিকট প্রার্থনা করছি তিনি যেন শহীদ আবদুল কাদের আওদার দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন