২০১৬ সালের মার্চের সন্ধ্যায় ২৩ বছর বয়সী রাশিয়ান নারী কাতিয়া কোতোভা প্রথমবারের মস্কো ক্যাথেড্রাল মসজিদে প্রবেশ করেন। তার মিশন ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া।
.............................................
রাশিয়া বিয়ন্ড দ্য হেডলাইন্স অবলম্বনে মো. রাহল আমীন
কাতিয়া দ্বিতীয়বারে মতো কোনো মসজিদের ভিতরে পা রাখেন। প্রথমটি ছিল ৩ বছর বয়সে তার জন্মস্থান বাসকোটোস্থানের একটি মসজিদ। ওই সময় তার নানী তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল।
কাতিয়া বলেন, ‘আমার সেই দৃশ্য স্পষ্ট মনে আছে। নারীরা উপরতলায় নামাজ আদায় করছিল এবং আমি কাছাকাছি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচতলার পুরুষদের নামাজ আদায় দেখছিলাম।’
বাসকোটোস্থানের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা হল ‘জাতিগত’ মুসলিম। ঐতিহাসিক কারণেই সেখানকার অধিবাসীরা ইসলামের ধর্মীয় নিয়ম-কানুন পালন করে আসছে। অতীতের নাস্তিক সোভিয়েতের আলোকে আধুনিক রাশিয়ায় এটি একটি সাধারণ অবস্থা। কাতিয়ার বাবা-মা ধর্মনিরপেক্ষ। তার পিতা রাশিয়ান এবং জাতিগতভাবে অর্থোডক্স। অন্যদিকে তার মা তাতার জনগোষ্ঠীর এবং জাতিগতভাবে একজন মুসলমান।
তাদের আগের প্রজন্ম আরো বেশি ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ছিল। কাতিয়ার মুসলিম নানী তাকে ইসলামী রীতিতে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছিলেন এবং তার দাদী ছিলেন একজন গোঁড়া খ্রিস্টান। কাতিয়া কোনো অর্থ বুঝা ছাড়াই কোরআনের বিভিন্ন সূরা মুখস্থ করে।
কাতিয়া বলেন, ‘কিছু কারণে যখনই আমি একজন শিশুর মতো ভয় পাই তখনই আমি সূরাগুলো স্মরণ করি।’ শৈশবের পুরোটা সময় কাতিয়া উভয় ধর্মের প্রার্থণার বিষয়গুলো পড়ে ঘুমাতে যেতেন।
১৩ বছর বয়সে তিনি উপলব্ধি করেন যে, একই সঙ্গে দুটো ধর্মানুশীলন করা ঠিক নয়। কাতিয়া অর্থোডক্স খ্রিস্টান হিসেবে একজন বাপ্তিজ এবং স্কুলে প্রায়ই বলা হতো ‘তুমি রাশিয়ান’। একারণে তিনি মুসলিম প্রার্থনা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং গলায় ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি পরেন। এছাড়াও কাতিয়ার বড়ভাইয়ের গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মায় এবং আজো সে বিশ্বাসই মেনে চলছে।
সময়ের ব্যবধানে কাতিয়ার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় যার উত্তর কেউ দিতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, কাতিয়া এই ধারণা মেনে নিতে পারছিলেন না যে, যিশু কোনো নবী নয়, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বর এবং ধ্বংসাবশেষ এর উপাসনার মতো কিছু গোঁড়া রীতিনীতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি।
এসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কাতিয়ার বয়স এখন ১৮ বছর। মস্কোর রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটির আইনের ছাত্রী। তার ইচ্ছা একজন আইনজীবী কিংবা একজন তদন্ত কর্মকর্তা হওয়া। কাতিয়া তার হোস্টেল রুমে একজন মুসলিম মেয়ে সঙ্গে থাকেন এবং তাদের মাঝে প্রায়ই ধর্ম সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক হতো। এজন্য কাতিয়া খ্রিস্টান এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথে ইসলামের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতে থাকে।
স্নাতক পাশের কয়েকমাস আগে কাতিয়া ‘ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি’ বিষয়ে ইন্টার্নশীপ সম্পন্ন করেন এবং এ বিষয়ে কাজ শুরুর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। একই সময়ে কাতিয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
তিনি বলেন, ‘ইসলামের সৌন্দর্য আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে।’
হিজাব পরে ইনভেস্টিগেটিভ কমিটিতে কাজ কিছুটা কঠিন। তাই কাতিয়া তার ভবিষ্যতের বিকল্প বিবেচনা করে একটি ছোট বিরতির সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল তার জীবনের অন্যতম সমস্যাগ্রস্ত একটি সময়।
তিনি এখন একটি দাগেস্তানি হালাল ক্যাফেতে একজন ওয়েট্রেস হিসাবে কাজ করছেন। দাগেস্তানে রাশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার বাস। সে বাড়িতে ফিরে যেতে চায় কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান।
কাতিয়া বলেন, ‘মস্কোতেই আমি নিরাপদ বোধ করছি। এখানে আমি আমার হিজাব নিয়ে ভীত নই। এখানে আমাকে নিশ্চিতভাবেই প্রায়ই কিছু অশ্লীল কথা শুনতে হয় কিন্তু কোনো ধরনের শারীরিক আগ্রাসনের শিকার হতে হয় না। একারণে মস্কো ছাড়ার আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। মস্কো ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে আমি তাতারস্থানে যাব। যেখানে অনেক বেশি মুসলমান ও অধিক সংখ্যক হিজাবি নারী রয়েছে এবং অনেক হালাল স্থাপনা রয়েছে।’
তিনি সাহসী ও স্বাধীন নারীর গল্পে অনুপ্রাণিত হন। আলাপচারিতায় সে আইরিনা সেন্ডলারের গল্প বলেন যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘ওয়ারশ ঘেটো’ থেকে ২,৫০০ জন শিশু উদ্ধার করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম নারী মহাকাশচারী ভালেন্তিনা তেরেশকোভা এবং পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাইয়ের গল্প তাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। পরিবার, নারী ও শিশুদের সাহায্য করার জন্য অদূর ভবিষ্যতে তিনি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ান মানসিকতায় বলা হয়, প্রকাশ্যে মলিন লিনেন কাপড় ধোয়া উচিত নয়। এর অর্থ হচ্ছে পারিবারিক সহিংসতাসহ পারিবারিক সমস্যা তেমন কোনো সমস্যা নয়। এটা হচ্ছে নারীর সমস্যা এবং সাধারণত একাই তাদের এটার মোকাবেলা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, পরিবারিক দ্বন্দ্বের রেজল্যুশনে উভয় পক্ষই জড়িত হওয়া উচিত।’
কাতিয়া বলেন, ‘ইসলামে নারীরা মুক্ত। কিছু মুসলিম নারী বাঁধাধরা নিয়মে বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে খাঁচার পাখির মত বাড়িতে আবদ্ধ করছে। প্রথমে তাদের বাবা-মায়ের দ্বারা, তারপর তাদের স্বামীদের দ্বারা এর শিকার হচ্ছে। ইসলাম অনুযায়ী, একজন স্ত্রী চাইলে হালালপন্থায় কাজ করতে পারেন এবং তার স্বামী তাকে সমর্থন করতে বাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি একজন নারীর উদ্দেশ্যে হচ্ছে তার পরিবারে প্রশান্তি আনা।’
এই মুহূর্তে কাতিয়ার প্রধান কাজ হচ্ছে তার পরিবারকে ঠাণ্ডা করা। তার বাবা তার ইসলামে দীক্ষিত হওয়া এবং হিজাব পরার সিদ্ধান্তে কিছুটা ক্ষুব্দ। কাতিয়ার ভয় এ নিয়ে হয়ত তাকে কিছু সমস্যার মোকাবেলা করতে হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমার ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত, রক্ষণশীল পোশাক এবং তাতার অঞ্চলের নারীদের মতো মাথায় হিজাব পরা সম্পর্কে আমার বাবা অবগত আছেন। কিন্তু তারা জানে না হিজাব পরার সময় আমি আমার সমস্থ ঘাড়ও ঢেকে রাখি।’
আসছে নতুন বছরের আগেই কাতিয়া ছুটিতে বাড়ি যাবেন বলে মনস্থির করেছেন।.............................................
রাশিয়া বিয়ন্ড দ্য হেডলাইন্স অবলম্বনে মো. রাহল আমীন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন