ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার: ১৬ অক্টোবর ২০১৩। দিনটি ছিল বুধবার পবিত্র ঈদুল আযহার দিন। তার আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার বেশীরভাগ সময় জুড়েই আমাদের সবার মাঝে চলছিল জল্পনা কল্পনা। আমাদের সবাই বলতে সেই সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের ভাইদের কথা বলছি। আমিও তখন জালিমের কারাগারে বন্দি। আমার ঠিকানা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নাইনটি সেলের ৬৪ নং কক্ষ। শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও তখন কেন্দ্রীয় কারাগারে রজনীগন্ধা ফাঁসির সেলের ৮নং কক্ষে বন্দী ছিলেন। অন্য শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সে সময় ছিলেন কাশিমপুরে। সে সময় আমাদের আরো যে কয়জন ভাই তখন কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন ঈদেও আগের দিন সবারই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একটি। সেটি হল বুধবার ঈদের নামাজে অংশগ্রহনের সুযোগে প্রিয়নেতা শ্রদ্ধাভাজন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা হবে কি? তার সাথে কোলাকুলি, হাত মেলানোর সুযোগ কারাবন্দী জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ভাইয়েরা পাবে কি? কারা কতৃপক্ষ কি ওনাকে নামায পড়ার সুযোগ দিবেন। কারন ঈদের দিন সাধারনত বন্দীদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বিধি নিষেধ থাকেনা। কি কয়েদি কি হাজতী সবাই সবার ওয়ার্ডে যেতে পারেন,ঘুরতে পারেন, এক সাথে সবাই ঈদের নামায আদায় করতে পারেন, বন্দী জীবনে একসাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেন।
অন্যান্য বন্দীদের মত সচরাচর জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাথে বন্দী ভাইদের সাক্ষাতের সুযোগ খুবই কম হয়। কারন একদিকে রাজবন্দীদের সেলে অন্য বন্দীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে রেড এলার্ট জারি থাকে। অন্যদিকে ওনাদের যখন কোর্টে আনা নেয়া হয় তখন সবাইকে দূরে সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে তার পরেই আনা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরই মাঝে দু-একজন নাছোড়বান্দা ভাই কারারক্ষীদের নিষেধ উপেক্ষা করে কোর্টে আনা নেয়ার পথে ওনাদের সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করেন। একবার আল্লামা সাঈদী হুজুরের সাথে হাত মেলানোর অপরাধে কয়েকজন বন্দীকে শাস্তিও দেয়া হয়েছিল। তারপরও বন্দীদের ঠেকায় কে। সুযোগের অপেক্ষায় ওৎপেতে থাকে সবাই। কবে প্রিয় নেতা কোর্টে যাবেন। কবে পাওয়া যাবে হাত মেলানোর পরম সৌভাগ্য। এ যেন এক অনাবিল সুখ জয়ের প্রতিযোগিতা। সবাই এক বুক আশা নিয়ে ঈদের দিন মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একদিকে চোখে মুখে আবেগ ভরা উচ্ছ্বাস আর সাক্ষাৎ লাভের তীব্র আকাঙ্খা। আর অন্যদিকে শংসয় ও শঙ্কা। কারন যদি কারাকতৃপক্ষ ওনাকে তার কক্ষ থেকে বের হতে না দেন। যদি তিনি ঈদের নামাজেই আসতে না পারেন, তাহলেতো সব উচ্ছ্বাস আর আকাঙ্খা মাটি হয়ে যাবে। সাক্ষাৎ লাভের সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার যে সংশয় ও শঙ্কা আমাদের মাঝে দানা বাধছিল তার পেছনে যৌক্তিক কারনও কিন্তু ছিল। যারা কারাগারে পুরাতন তাদের কাছ থেকে শোনা কথা। বিগত কোন এক ঈদের আগের দিন রাতে কারাগারের মাইকে ষোষণা করা হয় যে, আগামীকাল ঈদের জামাতে ইমামতি করবেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হুজুর। এই ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে নাকি পুরো কারাগারে সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহু আকবার বলে উঠে। ঘোষণার পর থেকে কারাগারে সবার মাঝে যেন সত্যিকারের এক ঈদ আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়। পরস্পরের মুখায়বে তাকালে মনে হচ্ছিল সবাই যেন মুক্ত বিহঙ্গ, কেউ আর বন্দী না। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশে কেউ কেউ একে অপরকে জড়িয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করছিল। তাদের এই উচ্ছাসের মূল কারন, বিশ^বরেণ্য আলেমে দ্বীন, সবার প্রিয় মানুষ আল্লামা দেলোওয়ার হোসাইন সাঈদী কিনা আগামী কাল ঈদের জামাতের ইমামতি করবেন।
কিন্তু ঈদের দিন ঘটল ভিন্নরকম ঘটনা। সবাই আবেগ উচ্ছ্বাস নিয়ে ঈদের জামাতে হাজির হয়ে জানলেন ঈদের ইমামতিতো দুরের কথা ঈদের নামাজ পড়তেও অনুমতি মেলেনি আল্লামা সাঈদীর। উপরের নির্দেশই ওনাকে ঈদের দিনও আটকে রাখা হয় তার সেলে । এই ঘটনা শোনার পর থেকে আমার বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। সংশয়টা যেনো আরো প্রকট হতে লাগল, আগামীকাল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ভাইয়ের সাথেও কি তেমনটা করা হবে। মহান আল্লাহর কাছে মিনতি করলাম ‘হে আল্লাহ কালকে একটু মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিও’। আশা আর সংশয় দুটো নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। বাতি জ্বালানো কারাগারের ঘুম আর কেমন হবে। এপাশ-ওপাশ করছি, আর একটু পর পর ঘুম ভাঙগছে। ঘুম ভাঙ্গলেই চোখের সামনে ভেসে আসে মুজাহিদ ভাইয়ের ছবি। আর তাতে কল্পনার রঙ ছড়াতে থাকে। কল্পনা জুড়ে অঙকিত হতে থাকে মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে ঈদের জমাতে একসাথে নামাজ আদায়ের দৃশ্য।
ঈদুল আযহার দিন ফজরের আজানের সাথে সাথেই ৬৪ নং কক্ষে থাকা আমরা ৫ জন বন্দী ঘুম থেকে উঠে ফজরের নাময আদায় করে নিলাম। নামাজ শেষে সবাই মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ লাভের প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে হাত তুলে মোনাজাত করলাম। সময় দ্রুত গড়াতে লাগল। বন্দীদের জন্য বরাদ্ধকৃত অপ্রতুল পানি দিয়ে গোসল সেরে আমরা সবাই ঈদের জামাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। একদিকে চলছে ঈদের জামাতে যাওয়ার প্রস্তুতি অন্যদিকে আমাদের হৃদকম্পন দ্রুত উঠানাম করছিল। না জানি কিসের মধ্যে কি হয়। এরই মাঝে কারাগারের মাইকে বন্দীদের উদ্দেশ্যে একটি নতুন ঘোষনা হল, যার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এমনটা হতে পারে এই সম্ভাবনা মনের ভিতর উঁকি দিলেও যায়গা দিতে চাইছিলাম না। কারাকতৃপক্ষ ঘোষণা করল, যে বন্দী যে এলাকায় থাকেন তিনি সেই এলাকায়ই ঈদের নামাজ আদায় করবেন। অন্য এলাকায় যেতে পারবেন না। এক বন্দীকে অন্য এলাকায় পাওয়া গেলে কেস টেবিলে নিয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। কেস টেবিল হল বন্দীদের অপরাধের বিচার এবং শাস্তি প্রদানের জায়গা। মাইকে ঘোষনার সাথে সাথেই ধক করে উঠল হৃদপিন্ডটা। সবার মুখ থেকেই সমস্বরে বেরিয়ে এল ইন্নালিল্লাহ..। কারণ ঘোষণা যদি সত্যিই বাস্তবায়ন হয় তাহলে মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় এবং সাক্ষাৎ দুটো সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হব। কারণ ৯০ সেলের বন্দীদের নামাজ পড়তে হবে কারা কেন্দ্রীয় মসজিদে আর মুজাহিদ ভাই ঈদের নামাজ পড়বেন রজনীগন্ধা ফাঁসির সেলের পাশে আমদানীর সামনের চত্বরে। এর মাঝে রয়েছে বিশাল দেয়াল, বড় একটি গেইট, সেটাকে মেন্টাল গেইট বলে থাকে। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলে আমদানীর সামনে অনুষ্ঠিত ঈদের জামাতে গিয়ে নামাজ আদায় করার কোনই সুযোগ আমাদের থাকছেনা।
মাইকে বার বার ষোষণা সত্বেও আমরা কয়েকজন নাছোড়বান্দার মত বার বার চেষ্টা করলাম মেন্টাল গেইট পার হওয়ার। এই গেট পার হতে পারলেই আমদানির সামনে ঈদের জামায়াতে মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করা সম্ভব হবে। গেটে দাড়ানো কারারাক্ষীদের কোন ভাবেই ফাঁকি দেওয়া গেল না। আজ মনে হয় তারাও একটু কড়া ডিউটিই করছে। অনেক কাকতি মিনতিতেও কারারক্ষিদের মন গলানো গেল না। শেষ পর্যন্ত ঈদের নামাজ এই এলাকায় অবস্থিত মূল মসজিদেই পড়তে হল। ঈদের দিন মুজাহিদ ভাইয়ের সাক্ষাৎ পাব, কোলাকুলি করতে পারবো, হাত মেলাতো পারবো বলে যে উচ্ছ্বাস আমাদের মাঝে ভর করেছিল তা যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মূল মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করলাম। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। নামাজ শেষে খেয়াল করলাম যারা কয়েদি, রান্নাবান্নার কাজ করেন তারা মেন্টাল গেইট পার হচ্ছেন। কয়েদিদের জন্য গেইট তখন কিছুটা শিথিল করা হয়। সুযোগটা কাজে লাগালাম। তাদের সাথে পার হয়ে আমিও আমদানি চত্বরে চলে আসলাম। তখন আমদানি চত্বরের নামাজ শেষ করে ঈদের খুতবা চলছিলো। খোঁজ নিয়ে জানলাম মুজাহিদ ভাই নামাজে এসেছেন। তবে ওনাকে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। মুজাহিদ ভাই আছেন শুনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম।
খুতবা এবং মুনাজাত শেষে কারারক্ষিরা মুজাহিদ ভাইকে তাগাদা দিচ্ছিল তার সেলের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেওয়ার জন্য। মুজাহিদ ভাইও তাদের তাগাদায় সায় দিয়ে রওয়ানা হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ততক্ষনে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট । ঈদের জামাতে অংশ নেয়া বন্দীরা সবাই ঘিরে ধরেছে ওনাকে। মুজাহিদ ভাই এর সাথে কোলাকুলি না করে কেউ যাবে না। কারারক্ষীরাও অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে দেখল। কারণ এত লোককে সরিয়ে মুজাহিদ ভাইকে নিয়ে যাওয়া তাদের জন্যও কঠিন। শেষে তারাও কোলাকুলির সুযোগ দিতে বাধ্য হল এবং কারারক্ষীদের কয়েকজনকে দেখলাম তারাও মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে ঈদের কোলাকুলি করলেন। জামায়াত-শিবিরের বন্দীরা ছাড়াও শত শত বন্দী কোলাকুলির জন্য জড়ো হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও সেই লাইনে দাঁড়ালাম। মুজাহিদ ভাই একে একে সবার সাথেই হাসি মুখে কোলাকুলি করছেন, সালামের জবাব দিচ্ছেন। অবশেষে এলা আমার পালা। আমি পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, কপালে চুমু খেলেন। আলতো করে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে সংক্ষেপে জানতে চাইলেন কেমন আছি। সবার কাছে দোয়া চাইলেন এবং সালাম পৌঁছে দিতে বললেন। তাঁর উষ্ণ আলিঙ্গনে আমি আবেগ আপ্লুত হলাম। ওনার কাছে দোয়া চাইলাম। সেদিন সবার সাথে একে একে কোলাকুলির দৃশ্যকে মনে হচ্ছিল যেন কোন এক স্বর্গীয় মানুষের সাথে আলিঙ্গনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সারি সারি মানুষের অপেক্ষা । এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাঁর পাঞ্জাবিতে মাখা আতরের শুভ্রতা সবার মাঝেই স্নিগ্ধ অনুভুতি তৈরি করেছিলো। আগে ভাবতাম তিনি শুধু আমাদের মাঝেই প্রিয়। সেদিন দেখলাম সর্বস্তরের বন্দীরা তাঁর সাথে কোলাকুলি করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল।
২০১০ সালের ২৯ জুন নিজ জেলা ফরিদপুরে যাওয়ার পথে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের মিথ্যা ও হাস্যকর অভিযোগে আটক করা হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংগ্রামী সেক্রেটারী জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। একই দিন দলের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিযামী ও নায়েবে আমীর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও আটক করা হয়। জনাব মুজাহিদ ভাইকে ফাঁসির দন্ড দেওয়ার আগ পর্যান্ত তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জালিমের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ওনার বন্দী জীবনের এই সময়ে আমিও দুবারে মোট ১৯ মাস কারাগারে ছিলাম। এই সময়ে অন্যান্ন শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ হলেও মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে এটিই ছিল আমার একমাত্র সাক্ষাৎ। এটিই ছিল শেষ হাত মেলানো ও কোলাকুলি।
এর আগে যেদিন ট্র্যাইবুনাল ওনাকে প্রথম ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করেছিল সেদিন ফাঁসির সেলে প্রবেশের সময় দূর থেকে সালাম এবং হাত নেড়ে সায় দেয়া হয়েছিল মাত্র। সেদিন এর বেশী কিছু করার সুযোগও ছিলনা। দিনটি ছিল ১৭ জুলাই ২০১৩, রমজান মাস, সেদিন সম্ভবত ৭ম রমজান চলছিল। তার মাত্র দু’দিন আগে অর্থাৎ ১৫ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমকে ট্র্যাইবুনাল ৯০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। ২দিন পরেই আবার মুজাহিদ ভাইয়ের রায়। রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে মুজাহিদ ভাইকে সকালেই ট্র্যাইবুনালে নিয়ে যায়। সকাল ১১টা থেকে রায় পড়া শুরু হয়ে পৌঁনে ১টায় রায় পড়া শেষ হয়। অন্যান্যদের মত প্রহসনের রায়ে ওনাকেও ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়। ২দিনে পর পর দুটি রায়। কারাগারে থাকা আমরা সবাই ছিলাম খুবই বিমর্ষ, কারও কারও চোখ থেকে ঝরছিল অঝোর ধারায় পানি। রেডিওর মাধ্যমেই মুজাহিদ ভাইকে দেয়া প্রহসনের রায় আমরা জানলাম।
রায় ঘোষণার পর থেকেই মুজাহিদ ভাইকে কখন কারাগারে নিয়ে আসা হবে তার প্রতীক্ষায় আমরা অনেক বন্দী কেন্দ্রীয় কারাগারের আমদানীর পেছনে ঘোরাফেরা করছিলাম। আমদানীর পাশ দিয়ে রজনীগন্ধা ফাঁসির সেলে ওনাকে নেয়া হবে তাই আমাদের এ ঘোরাফেরা। আমাদের মত সাধারণ বন্দীরাও মুজাহিদ ভাইকে দেখার অপেক্ষায়। এদিকে একটু পর পর কারারক্ষীরা আমদানীর পেছন এলাকা থেকে ঘোরাফেরা করা বন্দীদের সরিয়ে দিচ্ছিল। বন্দী আর কারারক্ষীদের সাথে চলছিল লুকোচুরি। কারারক্ষীরা একবার তাড়িয়ে দেয়তো বন্দীরা আবার এসে জড়ো হয়। দুপরের কিছুক্ষণ পর কারারক্ষীদের হঠাৎ তৎপরতায় বুঝতে পারলাম মুজাহিদ ভাইকে নিয়ে আসা হচ্ছে। কারাগারের মূল ফটক থেকে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা মুজাহিদ ভাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হেঁটে আসছিলেন। সাথে ডেপুটি জেলারসহ ১০/১২ জন কারারক্ষী। পাঞ্জাবীর উপরে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের পোষাক পরানো। পোষাকটি দেখেই বিমর্ষ মনটা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেল। নিষ্পাপ নিরপরাধ জনাব মুজাহিদ ভাইকে পরানো হয়েছে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের পোষাক, কিছুতেই যেন মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। মুজাহিদ ভাই যতই কাছাকাছি আসছিলেন তার চেহারাটা ততই স্পষ্ট হচ্ছিল। তাঁর চেহারার দিকে তাঁকিয়ে নিমিষেই নিজেকে সামলে নিলাম। ওনার হাস্যজ্জোল দৃঢ়চেতা চেহারা দেখে নিমিষেই আমার বিমর্ষতা কেটে গেল। আমি ওনাকে দেখছি আর বিমোহিত হচ্ছি। ওনার দৃঢ় কদম, হাসিমাখা মুখ দেখে একটুও বুঝার উপায় নেই এই মানুষটিকেই একটু আগে ফাঁসির রায় পড়ে শোনানে হয়েছে। কিছু কিছু বন্দী কাছে যেতে চাইলেও কারারক্ষীদের তৎপরতায় সম্ভব হয়নি। দূর থেকে বন্দীরা সবাই ওনাকে সালাম দিচ্ছেন আর তিনি হাসিমুখে সালামের জবাব দিচ্ছেন। আমার কাছাকাছি হলে দূর থেকে আমিও সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়ে হাত তিনি তুলে বুঝালেন সবাইকে দোয়া করতে বলার জন্য। ওনার হাস্যজ্ঝোল চেহারা আর হাঁটার স্বাভাবিক ভঙ্গীর দিকে তােিকয় আশে পাশের বন্দীরা বলাবলি করতে লাগলো “দেখ দেখ মুজাহিদ সাহেবরে একটু আগে ফাঁসি দিছে চেহারা দেখেলতো মনেই হয় না, ডর ভয় কিছুই নাই দেখি”।
আসলে সত্যিকারভাবেই শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন এমনি একজন ভয় ডরহীন সাহসী মানুষ। ২২ নভেম্বর’১৫ দিনপূর্ব রাত ১২:৫৫ মিনিটে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যার পুর্বে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য জল্লাদ যখন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে জম টুপি পরাতে চাইলেন। শহীদ মুজাহিদ তখন জল্লাদকে বললেন, আমাকে জম টুপি পরানোর প্রয়োজন নাই, জম টুপিতো তাদের জন্য যারা মৃত্যু ভয়ে ভীত। আমার মাঝে মৃত্যুকে নিয়ে কোন ভীতি নেই। আমি স্থির এবং স্বাভাবিক আছি। শহীদি মৃত্যু আমার আরাধ্য ছিল, আমাার লক্ষ্য ছিল। আমিতো সেই লক্ষেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমাকে জম টুপি পরানোর প্রয়োজন নাই। আমার মাঝে বিন্দু পরিমান ভয়ও কাজ করছে না।
আজ শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। রাতের অন্ধকারে ঘুম থেকে জাগিয়ে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। ওনার শাহাদাতের পর থেকেই কারাগারে ঈদের দিন ওনার সাথে কোলাকোলির সেই স্মৃতি বারবার আমার হৃদয়পটে ভেসে উঠছে। আমি সেই স্মৃতি স্মরণ করছি আরা চোখের কোনায় মনের অজান্তেই বিন্দু বিন্দু অশ্রু জামাট বাঁধছে। আমার কাছে কেন যানি মনে হচ্ছে শহীদ মুজাহিদ এখনো আমার কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন। শহীদ মুজাহিদের সাথে আমার সেই কারা স্মৃতিকে ধারন করে চোখের অশ্রু মুছে ফেলে আমি সামনে এগুতে চাই। কারন আমার মত বাংলার যুবকদের এখন অনেক দায়িত্ব। যে দায়িত্ব দিয়ে শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানরা আমাদেরকে রক্তের ঋনে আবদ্ধ করে গেছেন। রিভিউ খারিজের পরদিন পরিবারের সাথে সাক্ষাতে শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ফাঁসি দেয়া হোক আর যাই হোক বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন চলবে এবং এদেশে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হবেই ইনশাআল্লাহ। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা বলেছিলেন, আমার রক্তকে কর্মীরা যেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে লাগায়। শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদরা শহীদি মর্যাদা লাভের মাধ্যমে মূলত এই জমিনে ইসলামের বিজয়ের বীজ বপন করে গেছেন। আজ সে বীজকে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। মহান রবের কাছে তাওফীক কামনা করছি আমরা যেন ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করতে, শহীদদের প্রকৃত উত্তরসূরী হিসেবে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দৃঢ় এবং অবিচল থাকতে পারি। শহীদের রক্তে ভেজা এই দেশের মাটিকে ইসলামের ঘাটিতে পরিণত করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন