বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ মানবতার বন্ধু, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি আলোচনার কেন্দ্রে দণ্ডায়মান। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সকল অধ্যায়ের সফল আদর্শ তিনি। গোটা বিশ্বে এখনো তাঁর সফল কর্ম সমানভাবে আন্দোলিত করছে। মানবতার মুক্তিদুত বিশ্বনবী (ﷺ) সংঘটিত বিপ্লবের প্রাণশক্তি ছিল কল্যাণ কামনা ও ভালবাসা। দয়া, মহানুভবতায় কেউই তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি। মুহাম্মদ (সা:)-এর নবুয়াতী জিন্দেগীর যে কয়েকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা তার মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি অন্যতম। হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন “মহানবীর জীবনে হুদায়বিয়ার সন্ধি অপেক্ষা কল্যাণকর কোন ঘটনাই ঘটেনি।”Ernold Twinoby বলেছেন, মুহাম্মদ (ﷺ) ইসলামের মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার বর্ণ, বংশ এবং শ্রেণীগত পার্থক্য সম্পূর্ণরূপে খতম করে দিয়েছেন। কোন ধর্মই এর চেয়ে বড় সাফল্য লাভ করতে পারেনি যে সাফল্য মুহাম্মদ (সা.) এর ধর্মের ভাগ্যে জুটেছে।
“রাসূল (ﷺ) পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ঘটনার ফলে ইসলামী আন্দোলন এক লাফে সার্বজনীনতার পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবার সুযোগ পায়। এই ঘটনা দ্বারা রাসূল (ﷺ)-এর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ। নিকৃষ্টতম ও নিষ্ঠুরতম যুদ্ধরত শত্রুকে তিনি কত সহজে সমঝোতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং কয়েক বছরের জন্য তাদের হাত বেঁধে দিয়েছেন, হুদায়বিয়ার চুক্তি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। ঐতিহাসিক ড. গ্রেফটাউলি “Asib Civilization” গ্রন্থে লিখেছেন, “ইসলামের যে উম্মি নবীর ইতিবৃত্ত বহু আশাজনক। তৎকালের কোন বৃহৎ শক্তি যে জাতিকে নিজের আওতায় আনতে পারেনি, সে উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে তিনি তাঁর আওতায় বশীভূত করেছেন।”
রাসুল (ﷺ) এই চুক্তির মাধ্যমে সকলের মধ্যে একটি সেতু বন্ধন তৈরী করলেন। তিনি এই চুক্তির মাধ্যমে এ আদর্শের সত্যতা, মানবপ্রেম, ধৈয্য ও প্রজ্ঞার এক ঐতিহাসিক উপমা, মানব সমাজের কাছে হাজির করলেন। সুতরাং ইসলামের দাওয়াত সর্বমহলে ছড়িয়ে দিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি এক ঐতিহাসিক মাইল ফলক। মুলত এই সন্ধির মাধ্যমে ইসলামের রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। রাজেৈনতিক গুরুত্বের দিক থেকেও এর রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। রয়েছে অনাগত মুসলিম উম্মাহর করণীয় নির্ধারনে করনীয় নির্দেশনা। এই সফর একদিকে ধর্মীয় সফর ছিল। অপর দিকে এতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকও ছিল অন্তর্ভুক্ত। এ যেন পর্যায়ক্রমে ফুলের কলি থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে ফুলের মত। সকল মানব পেয়েছে এর সুগন্ধি। কিন্তু এর আগ থেকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ব্যতিত কারো জ্ঞানই যেন তা উপলব্ধি করতে পারেনি।
হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি
কা’বা ছিলো ইসলামের মূল কেন্দ্র। এটি আল্লাহর নির্দেমানুক্রমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) নির্মাণ করেছিলেন। মুসলমানরা ইসলামের এই কেন্দ্রস্থল থেকে বেরোবার পর ছয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছিলো। পরন্ত হ্জ্জ ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তারা এটি পালন করতে পারছিলো না। তাই কা’বা শরীফ জিয়ারত ও হজ্জ উদযাপন করার জন্যে মুসলমানদের মনে তীব্র বাসনা জাগলো।
রাসূল (ﷺ) একদিন স্বপ্নে দেখলেন, তিনি তাঁর সাহাবীদের সাথে পবিত্র মক্কা নগরীতে গিয়ে উমরা আদায় করেছেন। রাসূল সাতাঁর স্বপ্নের কথা দ্বিধিহীন চিত্তে সাহাবীদের বললেন এবং সফরের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ছিলনা। বিশেষ গত বছরই ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে বিখ্যাত আহযাব যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষত ছিলো তখনো। অনেকেই মনে করলো এরা মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে!। নবীর (ﷺ) সাথে এ বিপজ্জনক সফরে যেতে ১৪শ সাহাবী প্রস্তুত হলেন।
৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-কা’দা মাসের প্রারম্ভে এ পবিত্র কাফেলা মদীনা থেকে যাত্রা করলো। যুল -হুলাইফাতে পৌঁছে সবাই উমরার জন্য ইহরান বাঁধলেন। এর বর্তমান নাম বি’রে আলী। মদীনার হাজীগণ এখান থেকেই হজ্জ ও উমরার ইহরাম বেঁধে থাকেন। এভাবে কাফেলা লাব্বায়কা, লাব্বায়কা, ধ্বনি তুলে বায়তুল্লাহ অভিমুখে যাত্রা করলো।
নবী করীম (ﷺ) এ পদক্ষেপ কুরাইশদেরকে মারাত্মক অসুবিধায় ও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো এ জন্য যে, যদি তারা মদীনায় এ কাফেলার ওপর হালমা করে মক্কা প্রবেশ করতে বাধা দেয় তাহলে গোটা দেশে হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। যে পবিত্র মাসগুলোকে শত শত বছর ধরে আরবে হজ্জ ও বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্য পবিত্র মনে করা হতো যুল-কা’দা মাসটি ছিল তার অন্যতম । ফলে উমরার জন্য যারা যাত্রা করেছে তাকে বাঁধা দেয়ার অধিকার কারো ছিল না। আরবের প্রতিটি মানুষ বলতে শুরু করবে এটা বাড়াবাড়ী ছাড়া আর কিছুই নয়।
অপরদিকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে এত বড় কাফেলা নিয়ে নির্বিঘেœ আমাদের শহরে প্রবেশ করতে দেই তাহলে গোটা দেশের সামনেই আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হবে। কুরাইশরা নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য যে কোন মূল্যে এ কাফেলাকে শহরে প্রবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
রাসূল (ﷺ) আগে ভাগেই বনী কা’ব গোত্রের এক ব্যক্তিকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি উসফান নামক স্থানে পৌছলে ঐ ব্যক্তি জানালো যে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কুরাইশরা যি-তুয়ায় পৌছেছে এবং তাঁর পথরোধ করার জন্য তারা খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে দুই শত অশ্বরোহী সহ কুরাউল গমীম অভিমুখে অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছে। দুই কুরাইশদের চক্রান্ত ছিল কোন উপায়ে নবীর (ﷺ) সংগী-সাথীদের উত্যক্ত করে উত্তেজিত করা এবং তার পরে যুদ্ধ সংঘটিত হলে গোটা দেশে একথা প্রচার করে দেয়া যে, উমরা আদায়ের বাহানা করে এরা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করার জন্যই এসেছিলো এবং শুধু ধোঁকা দেয়ার জন্যই ইহরাম বেঁধেছিল। এ খবর পাওয়া মাত্র রাসূল (ﷺ) রাস্তা পরিবর্তন করলেন এবং ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দুর্গম একটি পথ ধরে হারাম শরীফের একেবারে প্রান্ত সীমায় অবস্থিত হুদাইবিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন।
কুরাইশদের সঙ্গে আলোচনা
হযরত (ﷺ) সামনে অগ্রসর হলেন এ জায়গাটি মক্কা থেকে এক মঞ্জিল দূরে অবস্থিত। এখানকার খোজায়া গোত্রের প্রধান হযরত (ﷺ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে বললো : ‘কুরাইশরা লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। রাসূল (ﷺ) বললেন : ‘তাদেরকে গিয়ে বলো যে, আমরা শুধু হজ্জের নিয়্যাতে এসেছি, লড়াই করার জন্য নয়। কাজেই আমাদেরকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার সুযোগ দেয়া উচিত।’ কুরাইশদের কাছে যখন এই পয়গাম গিয়ে পৌঁছলো, তখন কিছু দুূষ্টু প্রকৃতির লোক বলে উঠলো : ‘মুহাম্মদের পয়গাম শোনার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। ‘ কিন্তু চিন্তাশীল লোকদের ভেতর থেকে ওরওয়া নামক এক ব্যক্তি বললো: ‘না, তোমরা আমার উপর নির্ভর করো; আমি গিয়ে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সঙ্গে কথা বলছি।’ওরওয়া হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হলো বটে, কিন্তু কোনো বিষয়েই মীমাংসা হলো না।
ফিরে গিয়ে উরওয়া কুরাইশদের বললোঃ আমি কায়সার, কিসরা এবং নাজ্জাসীর দরবারে গিয়েছি। কিন্তু আল-াহর শপথ! আমি মুহাম্মাদের (ﷺ) সংগী-সাথীদেরকে মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রতি যেমন নিবেদিত প্রাণ দেখেছি তেমন দৃশ্য বড় বড় বাদশাহর দরবারেও দেখেনি। এদের অবস্থা এই যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) অযু করলে তারা এক বিন্দু পানিও মাটিতে পড়তে দেয় না, সবাই তো নিজেদের শরীর ও কাপড় মেখে নেয়। এখন চিন্তা করে দেখ, তোমরা কার মোকাবিলা করতে যাচ্ছো?
নবী ( সা.) বিচক্ষণতায় কুরাইশদের অপকৌশল ব্যর্থ-
আলাপ-আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্যে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলো এবং তারা মুসলমানদের হাতে বন্দীও হলো; কিন্তু হযরত (ﷺ) তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। এভাবে কুরাইশরা তাদের প্রতিটি ধূর্তামি ও অপকৌশলে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে থাকে।
হযরত উসমান (রা) কে দূত হিসেবে প্রেরণ
নবী (ﷺ) নিজের পক্ষ থেকে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান। কিন্তু কুরাইশরা মুসলমানদেরকে কা’বা জিয়ারত করার সুযোগ দিতে কিছুতেই রাযী হলো না; বরঞ্চ তারা হযরত উসমান (রা)-কে আটক করে রাখলো।
বাইয়াতে রিযওয়ান
এই পর্যায়ে মুসলমানদের কাছে এই মর্মে সংবাদ পৌঁছলো যে, হযরত উসমান (রা) শহীদ হয়েছেন। এই খবর মুসলমানদেরকে সাংঘাতিকভাবে অস্থির করে তুললো। রাসূল (ﷺ) খবরটি শুনে বললেন : ‘আমাদেরকে অবশ্যই উসমান (রা.)-এর রক্তের বদলা নিতে হবে।’ একথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নীচে বসে পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন। কেননা রসূল (ﷺ)-এর ভাষায় পরিস্থিতি ছিল এ রকম যে, ‘‘উসমান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গেছে।’’ তিনি নিজের এক হাতকে উসমানের হাত বলে আখ্যায়িত করে তার ওপর নিজের পক্ষ থেকে অন্য হাত রেখে বললেন, ‘‘অংগীকার কর।’’ তাঁর সাথীরা এমনিতেই আবেগে অধীর ছিলেন। তারা আন্তরিকতার সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে বায়য়াত ও অংগীকার করতে লাগলেন। কুরাইশদের কাছ থেকে আমরা হযরত উসমান (রা)-এর রক্তের বদলা নেবোই।’ এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুসলমানদের মধ্যে এক আশ্চর্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। তারা শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে কাফিরদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হলেন। এই আকস্মিক মুহূর্তটা ঈমান বৃদ্ধি ও চরিত্র গঠনের উপযুক্ত মুহূর্ত ছিল এবং এ সময় মুসলমানরা নিজেদেরকে এত উচ্চ মানে উন্নীত করে যে, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘আজকের দিন তোমরা সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’’ এই মুহূর্তের ঈমানী জযবা ও আন্তরিকতার দরুন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেন।” কুরআনে পাকের এই শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে সব ভাগ্যবান ব্যক্তি এ সময় রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন।
হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তাবলী
মুসলমানদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা কুরাইশদের কাছেও গিয়ে পৌঁছলো। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গেলো যে, হযরত উসমান (রা)-এর হত্যার খবর সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে কুরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো। এ জন্যে সুহাইল বিন্ আমরকে দূত বানিয়ে পাঠালো। শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলী স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্যে হযরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (ﷺ)-এর তরফ থেকে তখন কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বললো : ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ একথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হযরত আলী (রা) কিছুতেই এটা মানতে রাযী হলেন না। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি তাঁর রাসূল।’ নিম্নোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো-
১. মুসলমানরা এ বছর হজ্জ না করেই ফিরে যাবে। ২. তারা আগামী বছর আসবে এবং মাত্র তিন দিন থেকে চলে যাবে। ৩. কেউ অস্ত্রপাতি নিয়ে আসবে না। শুধু তলোয়ার সঙ্গে রাখতে পারবে: কিন্তু তাও কোষবদ্ধ থাকবে, বাইরে বের করা যাবে না। ৪. মক্কায় যে সব মুসলমান অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কোনো মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেয়া যাবে না। ৫. কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না। ৬. আরবের গোত্রগুলো মুসলমান বা কাফির যে কোনো পক্ষের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। ৭. এ সন্ধি-চুক্তি দশ বছরকাল বহাল থাকবে।
হযরত আবু জান্দালের ঘটনা
সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে কোরায়েশ প্রতিনিধি সোহায়েলের ছেলে আবু জুনদুল শেকল পরা অবস্থায় মক্কা থেকে এসে হাজির হলো। তাকে মারপিট ও নির্যাতন করা হয়েছিল। সে রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের সামনে নিজেকে পেশ করলো। সোহায়েল বিন আমর বললো, প্রস্তাবিত শর্ত অনুসারে আবু জুনদুলই প্রথম ব্যক্তি, যাকে আপনার ফেরত পাঠাতে হবে। রাসূল (ﷺ) বললেন, এখনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। কাজেই আবু জুন্দুলের ব্যাপারটা এর আওতার বাইরে থাকতে দাও। সোহায়েল বললো, তাহলে কোন আপোষ হতে পারে না। এরপর রাসূল (ﷺ) কোমল ভাষায় বুঝিয়ে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, ওকে আমার খাতিরে আমার সাথে মদিনায় যেতে দাও।’’ সোহায়েল মানলো না। বাধ্য হয়ে রাসূল (ﷺ ) বৃহত্তর স্বার্থে এই অন্যায় আবদার মেনে নিলেন। এবার আবু জুন্দুল সমবেত মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললো, ‘‘মুসলমান ভাইয়েরা, তোমরা আমাকে মুশরেকদের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছ। অথচ ওরা আমাকে ঈমান থেকে ফেরানোর জন্য আমার ওপর নির্যাতন চালাবে।’’ আবু জুন্দুলের এ আবেদন ঐ পরিবেশে অত্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ছিল। কিন্তু রাসূল (ﷺ) তখন অতুলনীয় ঠান্ডা মেজাজের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন। আবু জুন্দুলকে নম্র ভাষায় বললেন, “তোমার ও অন্যান্য মযলুমদের জন্য আল্লাহ তায়ালা একটা মুক্তির পথ বের করবেন। একটু ধৈর্য ধারণ কর।’’
রাসুল (ﷺ) ব্যতিত সবাই বিচলিত-
যে সময় সন্ধির শর্তসমূহ নির্ধারিত হচ্ছিলো তখন মুসলমানদের পুরা বাহিনী অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। এ সন্ধির ফলে যে বিরাট কল্যাণ অর্জিত হতে যাচ্ছিলো তা দেখতে পাওয়ার মত দূরদৃষ্টি কারোরই ছিল না। এমন কি হযরত উমরের (রা) মত গভীরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞানীজনের অবস্থা ছিল এই যে, তিনি বলেনঃ ইসলাম গ্রহণের পরে কখনো আমার মনে কোন সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এ যাত্রায় আমিও তা থেকে রক্ষা পাইনি। তিনি বিচলিত হয়ে হযরত আবু বকরের (রা) কাছে গিয়ে বললেনঃ “তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন? আমরা কি মুসলমান নই? এসব লোক কি মুশরিক নয়? এসব সত্ত্বেও আমরা আমাদের দীনের ব্যাপারে এ অবমাননা মেনে নেব কেন?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হে উমর তিনি আল্লাহর রাসূল আল্লাহ কখনো তাঁকে ধ্বংস করবেন না” । এরপরও তিনি ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাঁকেও এ প্রশ্নগুলো করলেন। হযরত আবু বকর (রা) তাকে যে জবাব দিয়েছিলেন নবীও (ﷺ) তাঁকে সেরূপ জবাব দিলেন। এ সময় হযরত উমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যে কথাবার্তা বলেছিলেন তার জন্য তিনি পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ছিলেন। তাই তিনি অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত এবং নফল নামায আদায় করতেন। যাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মাফ করে দেন।
হুদাইবিয়া সন্ধির প্রভাব ও বিজয়
সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হবার পর রাসুল (ﷺ) সেখানেই কুরবানী করার জন্যে লোকদেরকে হুকুম দিলেন। সর্বপ্রথম তিনি নিজেই কুরবানী করলেন। সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর হযরত (ﷺ) তিন দিন সেখানে অবস্থান করলেন। ফিরবার পথে সূরা ফাতাহ নাযিল হলো। তাতে এই সন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করে একে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করা হলো। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্টত প্রমাণ করে দিলো যে, ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিলো একটি বিরাট বিজয়ের সূচনা মাত্র।
“এতদিন মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে পুরোপুরি একটা যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছিলো। উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার কোনোই সুযোগ ছিলো না। এই সন্ধি-চ্ুিক্ত সেই চরম অবস্থার অবসান ঘটিয়ে রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিলো। এরপর মুসলমান ও অমুসলমানরা নির্বাধে মদীনায় আসতে লাগলো। এভাবে তারা এই নতুন ইসলামী সংগঠনের লোকদেরকে অতি নিকট থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেলো। এর পরিণতিতে তারা বিস্ময়কর রকমে প্রভাবিত হতে লাগলো। যে সব লোকের বিরুদ্ধে তাদের মনে ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো, তাদেরকে তারা নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে আপন লোকদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মানের দেখতে পেলো। তারা আরো প্রত্যক্ষ করলো, আল্লাহর যে সব বান্দাহর বিরুদ্ধে তারা এতোদিন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে আসছে, তাদের মনে কোনে ঘৃণা বা শত্রুতা নেই; বরং তাদের যা কিছুই ঘৃণা, তা শুধু বিশ্বাস ও গলদ আচার-পদ্ধতির বিরুদ্ধে। তারা (মুসলমানরা) যা কিছুই বলে, তার প্রতিটি কথা সহানুভূতি ও মানবিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ। এতো যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও তারা বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি সদাচরণের বেলায় কোনো ত্রুটি করে না।
ইসলাম সম্পর্কে অমুসলি মরা কতোখানি ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো, তা তারা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করতে পারলো। এই পরিস্থিতি এমনি এক আবহাওয়ার সৃষ্টি করলো যে, অমুসলিমদের হৃদয় স্বভাবতঃই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। এর ফলে সন্ধির-চুক্তির মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে এতো লোক ইসলাম গ্রহণ করলো যে, ইতঃপূর্বে কখনো তা ঘটেনি। এরই মধ্যে কুরাইশদের কতিপয় নামজাদা সর্দার ও যোদ্ধা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলালো। হযরত খালিদ বিন্ ওয়ালিদ (রা) এবং হযরত আমর বিন্ আস (রা) এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর ফলে ইসলামের প্রভাব-বলয় এতোটা বিস্তৃত হলো এবং তার শক্তিও এতোটা প্রচন্ড রূপ পরিগ্রহ করলো যে, পুরনো জাহিলিয়াত স্পষ্টত মৃত্যু-লক্ষণ দেখতে লাগলো। কাফির নেতৃবৃন্দ এই পরিস্থিতি অনুধাবণ করে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠলো। তারা স্পষ্টত বুঝতে পারলো, ইসলামের মুকাবিলায় তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই অনতিবিলম্বে সন্ধি-চুক্তি ভেঙে দেয়ার এবং এর ক্রমবর্ধমান সয়লাবকে প্রতিরোধ করার জন্যে আর একবার ইসলামী আন্দোলনের সাথে ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তারা খুঁজে পেলো না। এ চুক্তি যে সত্যিই একটা বিরাট বিজয় সে ব্যাপারে আর কারো মনে কোন সন্দেহ থাকলো না।
এ চুক্তির মাধ্যমে আরবে প্রথমবারের মতে ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিল। কুরাইশরা এ যাবত ইসলামকে ধর্মহীনতা বলে আখ্যায়িত করে আসছিলো। তারা এও স্বীকৃতি দিল যে, ইসলাম কোন ধর্মহীনতা নয়। দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হওয়ার ফলে মুসলমানগণ নিরাপত্তা ও শান্তি লাভ করলেন এবং গোটা আরবের আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এত দ্রুত ইসলামের প্রচার চালালেন যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি পরবর্তী দু’বছর লোক মুসলমান হলো সন্ধি পূর্ববর্তী পুরো ১৯ বছরেও তা হয়নি। সন্ধির সময় যেখানে নবীর (ﷺ) সাথে মাত্র ১৪ শত লোক ছিলেন। সেখানে মাত্র দুই বছর পরেই কুরাইশদের চুক্তি ভঙ্গে ফলে নবী (ﷺ) যখন মক্কায় অভিযান চালান তখন দশ হাজার সৈনিকের এক বিশাল বাহিনী তাঁর সাথে ছিল। এটা ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধির সুফল।
মুহাম্মদ (ﷺ)-এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম
হুদাইবিয়ার সন্ধির মাত্র তিন মাস পরেই ইহুদীদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বার বিজিত হয় এবং তারপর ফাদাক, ওয়াদিউল কুরা, তায়ামা ও তাবুকের মত ইহুদী জনপদেও একের পর এক মুসলমানদের কর্তৃত্বধীনে চলে আসে। হুদাইবিয়ার সন্ধি এভাবে মাত্র দু’বছরের মধ্যে আরবে শক্তির ভারসাম্য এতটা পাল্টে দেয় যে, কুরাইশ এবং মুশরিকদের শক্তি অবদমিত হয়ে পড়ে এবং ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
আল্লাহ পাক যে রাসূল (ﷺ) ও মুসলমানদের ওপর স্থিরতা নাজিল করেছেন, তোমাদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছেন, এবং তোমাদেরকে খোদাভীতি ও সংযমের ওপর বহাল রেখেছেন, সেটা ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ। নচেত তোমরাও যদি উত্তেজিত হয়ে যেতে, তাহলে সংঘর্ষ বেধে যেত এবং সহজে যে সুযোগ ও সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল, তা হাতছাড়া হয়ে যেত।
সূরা ফাতাহ শুরই হয়েছে-‘‘ইন্না ফাতাহ্না লাকা ফাতহাম মুবিনা’’ ‘‘আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি’’ এই কথাটা দিয়ে। হযরত ওমর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি যথার্থই সুস্পষ্ট বিজয়? রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই সুস্পষ্ট বিজয়।’
ঐতিহাসিক হোদায়বিয়ার সন্ধি, যা ফলাফলের দিক থেকে একটা মহাবিজয় ছিল। এই চুক্তিতে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতাসুলভ প্রজ্ঞারই পরিচায়ক ছিল। এ সন্ধি রাসূল (ﷺ) এর রাজনৈতিক দক্ষতার এক অতুলনীয় নমুনা এবং তাঁর এক অসাধারণ কীর্তি। এদ্বারা পরবর্তীকালের মুসলমানরাও কেয়ামত পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করতে থাকবে।
এ জন্য জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর "Getting Marred’ গ্রন্থে লিখতে বাধ্য হয়েছেন- "If all the world was to be united under one leader then Muhammad (S.M) would have been the best fitted man to lead the people of various needs dogmas and ideas to peace and happiness." “যদি সমগ্র বিশ্বের ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কোন নায়কের শাসনাধীনে আনীত হতো, তা একমাত্র মুহাম্মদই (ﷺ) সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।” তাই সারা জাহানের অনাগত কালের মানবগোষ্ঠীর জন্য তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন ও উসয়ায়ে হাসানা।
তথ্যসূত্র:
তাফহীমুল কুরআন
মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (ﷺ)
রাসুলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
'চিরভাস্বর মহানবী (ﷺ)
লেখকঃ কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন