আগামী ২০১৮ সালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য। জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে। এতে আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারীতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এদিকে আগামী এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি হিসাবে অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহন করেছিলেন। সুতরাং আগামী ২৪ এপ্রিলে তাঁর মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। এর আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে আগামী জুনে শেষ হবে বর্তমান সেনা প্রধান মেজর জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হকের মেয়াদ। ইতোমধ্যে বিতর্কিত পদত্যাগের কারনে প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য রয়েছে। এই পদটি চলছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দিয়ে। রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপত ও সেনাপ্রধান পদ পূরনে খুবই সতর্কতার সাথে এগুচ্ছে সরকার। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দিয়ে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের নজির বাংলাদেশে নেই। এরশাদ যামানায় একবার সর্বোচ্চ ১২দিন এই পদে ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। এছাড়া আর কখনো এই পদে এত দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্ত থাকার উদাহরণ নেই। সরকার নিজের বিশ্বস্থতায় উত্তীর্ণ একজনকে এ পদে বসানোর লক্ষ্যে কাল ক্ষেপন করছেন। কারন নির্বাচনকালীন ও পরবর্তিতে কোন সঙ্কটের সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ও সেনা প্রধানের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিতে চায় সরকার। ২০০৭ সালে প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মত একজন দুর্বল চিত্তের রাষ্ট্রপতির বদৌলতেই অতি সহজে জরুরী আইন জারি করা সম্ভব হয়েছিল। এই জরুরী আইনের আওতায় বিএনপিকে তছনছ করা হয়। তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ সবকিছুতেই সায় দিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ এরকম দুর্বল চিত্তের অনুগত কাউকে রাষ্ট্রপতি বানাতে চায় না। যে কোন রকমের রাজনৈতিক সঙ্কটে যাতে তাদের সহায়ক ভুমিকা পালন করেন এমন একজনকেই রাষ্ট্রপতি বানাবে আওয়ামী লীগ।
কে হতে পারেন পরবর্তি রাষ্ট্রপতি? এই প্রশ্ন বিশ্লেষকদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা হয়ত: তাঁর নিশানা ঠিক করে রেখেছেন। শেখ হাসিনাই জানেন আগামী বছরের এপ্রিলে কাকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে মনোনয়ন ঘোষণা করবেন। এই পদটিতে বসার জন্য সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ মরিয়া দীর্ঘদিন থেকে। পুনরায় রাষ্ট্রপতি পদে বসে স্বৈরশাক তকমাটি দূর করতে চান তিনি। বিভিন্ন জোটে যোগদানের সময় রাষ্ট্রপতি পদটি থাকত তাঁর অন্যতম শর্ত।
জাতীয় নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতির ভুমিকা ও ক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা বাড়িয়ে বিরোধী জোটের সাথে সমঝোতার কথা শোনা যায়। যদিও সবই এখনো বাতাসি আলোচনা। কোনটারই জোড়ালো কোন ভিত্তি নেই। একটি বিষয় জোর দিয়েই বলা যায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে থেকেই নির্বাচন দেবেন। যদি বিরোধী জোট জোড়ালো আন্দোলনের মাধ্যমে বেশি চাপ সৃস্টি করে তখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা অর্পনের প্রস্তাব উঠতে পারে বিভিন্ন মহল থেকে। তাই রাষ্ট্রপতি বানানোর আগে দশবার চিন্তা করবেন শেখ হাসিনা। কারন শেখ হাসিনা যাকে চাইবেন তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এতে কোন সন্দেহ নাই। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরীষ্ট দলের নেতা তিনি। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরীষ্ট ভোটেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১০৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিচার বিভাগ থেকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। সবাইকে তাক লাগিয়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে তখণ রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছিল। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ছিলেন অত্যন্ত নীতিবান মানুষ। পরবর্তিতে শেখ হাসিনাকে মাশুল দিতে হয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা শুরু হলে দেখা যায় ভরাডুবি হচ্ছে আওয়ামী লীগের। তখন রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করা হয়েছিল সেই ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখতে। এমনকি নির্বাচন বাতিল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে। এনিয়ে পরবর্তিতে কথাও উঠেছিল। শাহাবুদ্দিন আহমদ দৃঢ় অবস্থানে থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। যদিও এনিয়ে টেলিফোনে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল শাহাবুদ্দিন আহমদকে। নীতি ও ভীতির কারনে শাহাবুদ্দিন আহমদ পরবর্তিতে আর মুখ খুলেননি এনিয়ে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনার অনুগত ও পরিক্ষীত আওয়ামী লীগার বিচারপতি (?) খায়রুল হক রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের ভয় শেখ হাসিনার মাথা থেকে সরে গেলে খায়রুল হকই রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। খায়রুল হকও পদটি পাওয়ার জন্য নানা কৌশলে তদবীর করছেন। তিনি তদবীরে এও বলছেন কোন কারনে সরকার পরিবর্তন হলে তাঁকেও কঠিন মাশুল গুনতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রপতি পদটি হচ্ছে তাঁর নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গা। এই পদে না বসতে পারলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশ ত্যাগ করা লাগবে। এজন্য যে কোন মূল্যে রাষ্ট্রপতি পদে বসতে চান তিনি। মুন সিনেমা হলের মামলায় পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা, প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসরের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হচ্ছে খায়রুল হকের অবদান। এর বাইরেও বিচারপতি পদে শপথ নিয়েই প্রথম দিবস থেকে বসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানীতে। পরপর চারটি বেঞ্চ আপিল শুনানী করতে বিব্রত প্রকাশ করেছিল তখন। এক পর্যায়ে হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত বিচারপতি মো: রুহুল আমিন শুনানী করতে সম্মত হন। তাঁর সাথে জুনিয়র বিচারপতি হিসাবে বসতে রাজি হয়েছিলেন খায়রুল হক। তাই বিচারপতি পদে শপথ নেওয়ার দিন থেকেই রুহুল আমিনের সাথে দ্বৈবেঞ্চে বসানো হয়। সেই দিন থেকেই শুরু হয় শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানী। শুনানী শেষে রুহুল আমিন ৫জন আসামীকে বেকসুর খালাস দেন। কিন্তু খায়রুল হক নি¤œআদালতে দন্ডপ্রাপ্ত সকলের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। এর পর থেকে নানা বিষয়ে রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শে প্রশ্ন জড়িত যে কোন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের পক্ষেই রায় দিয়ে গেছেন খায়রুল হক। সেই অবদানের প্রতিদান হিসাবে তিনি এখন রাষ্ট্রপতি পদটি দাবী করেছেন শেখ হাসিনার কাছে।
এর বাইরে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফের নাম রাষ্ট্রপতি পদের জন্য শোনা যায়।কে হচ্ছেন সেনা প্রধান:
বাতাসে নানা গুজব ভাসছে। যে কোন সময় বর্তমান সেনা প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। এমন কথা এখন চাউড় রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। বর্তমান সেনা প্রধান মেজর জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হক ২০১৫ সালের ২৫ জুন দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন। আগামী জুনে তাঁর চাকুরির মেয়াদ শেষ হবে। এর আগেই তাঁকে সরিয়ে হচ্ছে এমনটাই এখন শোনা যায়। সরিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোন পদে নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে তাঁর সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেইটাই বলাবলি হচ্ছে চারদিকে। বর্তমান সেনাপ্রধানকে সরিয়ে শেখ হাসিনা ও ইন্ডিয়ার অতিবিশ্বস্থ একজনকে বসানোর চিন্তা করা হচ্ছে। সেই দিক থেকে সেনা প্রধান হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন ঢাকার ৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর ভাই লে. জেনারেল আজিজ আহমদ। বর্তমানে তিনি সেনা বাহিনীর আর্টডক আর্মি ট্রেইনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড)-এর কমান্ডিং অফিসার (জিওসি)।
লে.জেনারেল আজিজ আহমদের বড় ভাই আনিস আহমদে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের মিজান কমিশনারের ছোট ভাই কামাল হত্যা মামলার আসামী। নি¤œ আদালতের বিচারের ফাঁসির দন্ডাদেশ হয়েছে। পলাতক হিসাবে মালয়েশিয়ায় জীবন যাপন যাপন করছেন। আরেক ভাই হারিছ আহমদ। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে প্রকাশিত ১৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভু একজন হলেন হারিছ আহমদ। একটি হত্যা মামলায় তাঁরও ফাঁসির আদেশ হয়। বর্তমানে পলাতক জীবন যাপন করছেন। তিনিও মালয়েশিয়ায় রয়েছেন বলে জানা যায়। আরেক ভাই তোফায়েল আহমদ জোসেফ। বর্তমানে কারাগারে আটক। একটি হত্যা মামলায় তাঁরও ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। হাইকোর্ট ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। পরবর্তিতে আপিল বিভাগ দন্ড কমিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন করা হয়। লে. জেনারেল আজিজ আহমদ ছাড়া বাকী ৩ ভাই হত্যা মামলার দন্ডপ্রাপ্ত আসামী। তিনি বিজিবির মহাপরিচালক হিসাবে থাকার সময় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার বিশ্বস্থতার পরিচয় দেন। এছাড়া সীমান্ত রক্ষ্মিবাহিনীকে ইন্ডিয়ার অনুগত হিসাবে তৈরি করতে তাঁর রয়েছে বিশেষ ভুমিকা। এখানেও তিনি ইন্ডিয়ার বিশ্বস্থতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মনে করা হচ্ছে।
সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে লে. জেনারেল আজি আহমদ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন ৩ বছর। তখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা শোনা যায়। তারপরও মনে করা হয় আজি আহমদ শেখ হাসিনার অনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মনে করা হয়। পারিবারের ৩ ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত এবং সর্বোচ্চ দন্ডপ্রাপ্ত আসামী হওয়ায় আজিজ আহমদের বিষয়ে নানা আপত্তিও শোনা যায়।
কে হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি
গত ২ অক্টোবর থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহাব মিঞা। দীর্ঘ সময়ে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করে তিনি রেকর্ড সৃস্টি করছেন। সংবিধান অনুযায়ী যদিও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার হচ্ছে রাষ্ট্রপতির। কিন্ত বর্তমান বাস্তবতায় দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। শেখ হাসিনা যাকে চাইবেন রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার বহি:প্রকাশ সেটাই ঘটবে। মোষ্ট সিনিয়র হিসাবে বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞাই প্রধান বিচারপতি হিসাবে মনোনয়ন পাওয়ার কথা। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। এর আগে আওয়ামী লীগের প্যানেল থেকে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের নির্বাচনে সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেন। সুতরাং তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিবারেরই পরীক্ষিত সদস্য। দ্বিতীয় সিনিয়র হিসাবে রয়েছেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনিও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আমলে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত। আপিল বিভাগে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত শেষ হাসিনা যাকে চাইবেন তিনিই হবেন প্রধান বিচারপতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন