বাংলাদেশ বার্তাঃ সৌদি আরবকে কিভাবে কতটা পাল্টাবেন দেশটির ক্রাউন প্রিন্স ও প্রকৃত ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা মোহাম্মদ বিন সালমান। এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সৌদি রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুসারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সালমান বাদশাহ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের কনিষ্টতম যোগ্য প্রিন্স মুকরিন বিন আব্দুল আজিজকে করেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স। আর ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে করেন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স। আর সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোকে দুইভাগে ভাগ করে একটির দায়িত্ব দেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানকে। বয়সের দিক থেকে তিন জন ছিলেন তিনটি ভিন্ন প্রজন্মের। মুকরিনের বয়স ছিল ষাটের কোটায়, মোহাম্মদ বিন নায়েফের বয়স ছিল পঞ্চাশের কোটায় আর মোহাম্মদ বিন সালমানের বয়স ছিল ত্রিশের কোটায়। ক্ষমতাধর সৌদ রাজ পরিবারে দুটি ধারার একটি ছিল সুদাইস মায়ের সন্তানদের ধারা আর অন্যটি ছিল অন্য মায়ের সন্তানদের ধারা। মুকরিন ছিলেন শেষোক্ত ধারার আর দুই মোহাম্মদ ছিলেন প্রথম ধারার। এতে উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একটি ভারসাম্য ছিল প্রথমে।
এই ভারসম্যের সব উলট পালট হয়ে যায় মোহাম্মদ বিন সালমানের অতি মাত্রায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠার কারণে। পিতার উপর তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন যে মুকরিন ক্রাউন প্রিন্স হলেও নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। ইয়েমেনে সৌদি সেনা হস্তক্ষেপের ইস্যু এলে বিন সালমান এর পক্ষে শক্তভাবে অবস্থান নেন। আর অন্য দিকে ইয়েমেনি বংশোদ্ভুত মায়ের সন্তান মুকরিন এটাকে সঠিক মনে করেননি। শেষ পর্যন্ত মুকরিনকে বিদায় নিতে হয়। তিনি অনেকখানি অন্তরালে চলে যান। একই সাথে তার প্রজন্মের রাজ পরিবারের নীতি নির্ধারক পদের অনেকেই বিদায় হয়ে যান। এরপর সালমানের একই মায়ের ভাই নাইফের ছেলে মোহাম্মদ হন নতুন ক্রাউন প্রিন্স। ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স নিযুক্ত হয়ে সিংহাসনের প্রত্যক্ষ দাবিদার হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ বিন সালমান। একই সাথে ক্ষমতা চর্চায় তিনি আরো প্রবলভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী প্রথম বা দ্বিতীয় পদে সালমান তার পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে থাকেন। বিন নায়েফ সব প্রত্যক্ষ করেও নীরব থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি এড়িয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্রাউন প্রিন্স পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করা হয়। এরপর বিন সালমানের ক্ষমতা প্রয়োগের প্রত্যক্ষ ধারা শুরু হয়।
মোহাম্মদ বিন সালমান অতি মাত্রায় ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চাভিলাসি ক্রাউন প্রিন্সের। ইউএই’র এই ক্রাউন প্রিন্সের সাথে মোহাম্মদ বিন নাইফের সাথে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল আগে থেকেই। তার সাথে বিন সালমানের ঘনিষ্টতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিন নাইফ আরো বেশি ক্ষমতাহীন হতে থাকেন । এর এক পর্যায়ে তথাকথিত ব্যথার ওষুধে এডিক্ট হবার কথা বলে বিন নাইফকে পদত্যাগে বাধ্য করে বাদশাহ সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন নিজ পূত্র সালমানকে। বিন সালমানের সরকার প্রথমে মহিলা ড্রাইভারকে গাড়ী চালানোর অনুমতি দেয়। তারপর মেয়েদের স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। আর এখন ক্রাউন প্রিন্স দুর্নীতির সন্দেহের কথা বলে এক দল প্রিন্স ও মন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছেন। প্রশ্ন হলো কোথায় এসবের শেষ হবে? মানবাধিকার, মুক্ত অবাধ নির্বাচন, সমালোচনামূলক গণমাধ্যম ইস্যুর কি হবে? একজন মহিলা কি প্রধান মন্ত্রী হবেন নাকি রক্তাক্ত মৌলবাদী প্রতিবিপ্লব আসবে?
সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ঘটনার নেপথ্যে কারা কেন রয়েছে এ প্রশ্নও উঠেছে। গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস এ অ্যান্ড্রে কোরিবকো লিখেছেন, ‘প্রকাশ্যে তীব্র বিরোধিতার আড়ালে সৌদি আরব ও ‘ইসরাইল’ একে অন্যের খুবই ঘনিষ্ঠ এবং ‘এনইওএম ফিউচার সিটি প্রজেক্ট’-এ কৌশলগত-অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকায় উম্মাহর ঘৃণিত শত্রুকে শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতিও দিয়ে দিতে পারে রিয়াদ। তবে এর মানে এই নয়, তারা একে অন্যের সাথে প্রতিটি নীতিগত ব্যাপারে একসাথে থাকবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলার আগে থেকেই সৌদি আরব ও ইসরাইল পারস্পরিক সহযোগিতা করে আসছে এবং ইরানকে ‘সংযত’ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এবার সম্ভবত দুই দেশের সহযোগিতা আরো বিস্তৃত হয়েছে, সৌদি আরব নেতানিয়াহুর ‘ডিপ স্টেটের’ অভ্যুত্থান দমনে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েছেন। যথাযথভাবে কিংবা ভুলভাবে- যেভাবেই হোক না কেন, দেশটি বিশ্বাস করে বা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে, ইরান বৈদেশিক হুমকি সৃষ্টি করবে। রাজতান্ত্রিক দেশটি আশঙ্কা করছে, পুরো পারস্য উপসাগরে (ইরানের) ইসলামি প্রজতান্ত্রিক মডেল ছড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত সৌদি রাজপরিবারকে উচ্ছেদ করতে পারে, দুই পবিত্র মসজিদের ওপর তাদের অভিভাবকত্বের অবসান ঘটাতে পারে।’
যে সব সংস্কার বিন সালমান আনতে চাইছেন তাতে ভিন্ন মত থাকার কথা নয় যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও পাশ্চাত্যে অন্য দেশগুলোর। এসব সংস্কারের পেছনে রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরাইলের পরামর্শ গ্রহণ সক্রিয় থাক বা না থাক সংস্কারের প্রকৃতিই বলছে সৌদি আরবের সামাজিক ও আইনগত ধর্মীয় বৈশিষ্ট থেকে আধুনিক উদারনৈতিক বৈশিষ্টের দিকে নিয়ে যেতে এসব সংস্কার আনা হচ্ছে। আর সংস্কারের পদক্ষেপ যে উপরি কাঠামোর কোন বিষয় নয় সেটিও স্পষ্ট হয় গত এক দশকে আনীত পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনে। সৌদি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসুচিগুলোতে এমনভাবে সংস্কার আনা হচ্ছে যাতে ইসলামি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হবার অবকাশ না থাকে। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামিস্ট হিসাবে পরিচিতদের বিদায় করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলো থেকেও তাদের বিদায় করে লিবারেলদের বসানো হয়েছে। সৌদি নীতি নির্ধারণে ভুমিকা পালনকারী থিংক ট্রাংক গুলোতেও একই ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সর্বশেষ এবং সামাজিকভাবে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষেত্রটিতে পরিবর্তনে হাত দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। এতদিন দেশটিতে খেলাফতের সময়কার ইসলামী বিচার ব্যবস্থা চালু ছিল। এতে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের প্রাধান্য ছিল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চালু ছিল শরিয়াহ আইন। এখন সেই আইনকে পরিবর্তন করে রোমান আইনী ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও আমেরিকান আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে সমন্বয় করে সৌদি বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক করার কথা বলা হচ্ছে। এর অংশ হিসাবে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস করা হয়েছে। এর আগে এ ধরনের অফিস ছিল না।
মেয়েদের স্টেডিয়াম বা বিপনি বিতানে যাওয়া অথবা গাড়ি চালানোর অনুমতি দেবার চেয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব শিথিল করা অথবা বিচার ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্যকরণের প্রভাব অনেক বেশি সুদূরপ্রসারি। এ কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দেশের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আস্থা রাখা উচিত নয় বলে উল্লেখ করেও বৃটিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা বলেছে, ‘দৃশ্যত অনেক কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের আবহ থাকলেও আজকের সৌদি আরব নিজেই একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ পশ্চিমে এমবিএস নামে পরিচিত বিন সালমানের উদ্যোগগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘সালমানের ৩২ বছর বয়সি পুত্র জানেন যে তাঁর শাসনটি সবুজ জ্বালানি, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং নতুন প্রযুক্তিগুলির আগমনের আগ পর্যন্ত ভালভাবে চলবে। ইতোমধ্যে ফ্র্যাকিং বিপ্লব তেলের দামের উপর বিষণ্ণ প্রভাব ফেলেছে এবং এমবিএস চায় এভাবে, দেশের বাজেট এবং সার্বভৌম সম্পদ তহবিল রাজ্যের সম্পদগুলি দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার করতে। বিলাসবহুল রাজপূত্রদের বিশাল ব্যক্তিগত দুর্নীতি জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে, ‘ আদি ওয়াহাবিজম দ্বারা প্রভাবিত উপসাগরীয় রাষ্ট্রে বিদ্বেষপূর্ণ গতিতে ধর্মীয় নেতারা দীর্ঘকাল ধরে দেশে এবং বিদেশে গভীরভাবে বিভ্রান্তিকর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ইসলামী সন্ত্রাসের নেটওয়ার্কের প্রতি তাদের সহানুভূতিশীল ও সমর্থনকারী হিসাবে সন্দেহ করা হয়।…. সৌদি আরবের ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি বোঝার জন্য চিন্তা করা প্রয়োজন যে দেশটির গৃহযুদ্ধে পতিত হওয়া বা ওয়াহাবীদের অবিচ্ছিন্ন শাসনের অধীনে থাকলে কি হবে। বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক, জি২০ এর সদস্য, লন্ডন এবং নিউ ইয়র্ক অ্যাপল এবং গুগলসহ পশ্চিমা সম্পদের বিপুল শেয়ারের মালিক। এটি অবশ্যই একটি প্লেয়ার, এবং একটি আড়াআড়ি রাস্তায় এসে এটি দাঁড়িয়েছে। এটা স্পষ্টতই একটি আঞ্চলিক মহাশক্তি এবং ভাল বা ক্ষতি করার বিপুল ক্ষমতা তার আছে। অতীতে এটি এই উভয় কাজই করেছে্।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিন সালমানের সংস্কারকে সমর্থন করার কারণ হলো এতে প্রকৃতপক্ষেই দেশটির গভীরে হাত দেয়া হচ্ছে। এর ফলে শুধু মুসলিম ব্রাদারহুড বা রাজনৈতিক ইসলামের উপর হাত পড়ছে তাই নয় একই সাথে ইসলামের সামাজিক অনুশাসন বাদ দিয়ে কেবলমাত্র একান্ত ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর আবেদন সীমিত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। সৌদি সমাজে এটি কতটা করা সম্ভব হবে তা নিয়ে অবশ্য সংশয় রয়েছে।
বর্তমান সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল আবদুল ওয়াহাব নজদির সাথে বাদশাহ আবদুল আজিজের এক চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরবের ধর্মীয় কাজে আবদুল ওয়াহাবের সালাফি ধারার কর্তৃত্ব থাকার কথা । আর রাজনৈতিক বিষয়ে থাকার কথা সৌদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ। বাদশাহ সালমান নিজে বাদশাহ আবদুল আজিজের সুদাইসি পরিবারের স্ত্রীর ঘরের সন্তান। এই স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত থাকার কারণে বাদশাহর এ ঘরের সন্তানের সংখ্যা সর্বাধিক। বিন সালমান সেই ধারার রক্তের উত্তরাধিকার হবার পরও সংস্কারের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই ইসলামি ভাবধারার শেকড় কেটে দেয়ার কাজে শামিল হচ্ছেন। যদিও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবকে ইসলামের দিকে পরিচালিত করার জন্য তার অভিপ্রায় মাঝে মধ্যে প্রকাশ করেন কিন্তু তার কাজগুলিও নির্দেশ করে যে, তিনি তার রাজত্বের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নির্মাণের ব্যাপারে যেমন সচেতন তেমনি পাশ্চাত্যের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নেও সক্রিয়। হয়তো এ কারণেই তার সর্বশেষ প্রিন্সদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আগে ডোনাল্ট ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা ক্লুজনার সঙ্গীদের নিয়ে গোপনে রিয়াদ সফর করে গেছেন্। আর এ কাজে অন্তরালে মৈত্রি হচ্ছে ইসরাইলের সাথে। আর ইয়েমেনের ওপর চালানো হচ্ছে ক্রমাগত যুদ্ধ, কাতারের উপর চাপানো হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল অবরোধ। লেবাননের সাথেও যুদ্ধ শুরু করার কথা বলা হচ্ছে। সবদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ায় একদিকে সৌদি পেট্টো ডলারের ভান্ডার শুন্য হচ্ছে অন্য দিকে দেশটির উপর সন্ত্রাসের হুমকি বাড়ছে।
সৌদি রাজনীতি সব সময় থেকে গোপনীয় ও অস্বচ্ছ - কখনো পাঠ করার মতো তা সহজ ছিল না। সৌদি আরবের উত্তরাধিকারের লাইনটিও কখনও মসৃণ বা সহজবোধ্য ছিল না। আর বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স সেটিকে আরো কঠিন করে শেষ পর্যন্ত পূর্ববর্তীকে বিদায় করে উত্তরাধিকার দখল করেছেন। বিন সালমান তার আত্মীয়স্বজনদের লক্ষ্যবস্তু করে আত্মতুষ্টি ও কিছু রাজনৈতিক লাভ উপভোগ করতে পারেন। তাদের সামরিক ইউনিটগুলির কমান্ড ও সরকারী বিভাগ থেকে সরানো হবে আর তাদের কোটি কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ নিয়ে নেয়া হতে পারে। তবে একক পরিবারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃতিতে দুর্নীতি বাসা বাধে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সক্রিয় থাকে। আর তাতে শাসকের আচরণে কোন ভারসাম্যও থাকে না। বিন সালমান নিজেই অতি ধনী এবং তার কর্মের জন্য কার্যত জবাবদিহিহীন থাকছেন। রাশিয়া সফরে গিয়ে প্রমোদতরী পছন্দ হওয়ায় ৫৫ কোটি ডলার দিয়ে তা কিনে নিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক দুর্নীতির অভিযোগে প্রিন্সদের গ্রেফতারকে তুলনা করেছে অসত্য বলার অভিযোগে ডোনাল্ট ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বরখাস্ত করার সাথে।
সালাফি ধ্যানধারণা বা ইসলামী আদর্শবাদে সংস্কার উদ্যোগে পাশ্চাত্যের অনেকে এই ক্রাউন প্রিন্স আরো উদার ও আলোকিত ধরনের স্বৈরশাসক হবেন বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন। তবে তারা এটিও বলছেন যে কট্টর ইসলামিস্টদের দ্বারা রাষ্ট্রের সর্বশেষ সংস্কারক শাসক ফয়সালের মতো হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারেন অথবা ১৯৭৯ সালে ইরানের শাহের পতনের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন তিনি। আর এ ধরনের পরিবর্তন হতে দিতে চান না বলে তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আগে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। মাত্রাগত ব্যবধান থাকলে মিসরে সিসির নির্মমতার সাথে বিন সালমানের পদক্ষেপের বেশ মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে মুল উপদেশটি তেলআবিবের কট্টরপন্থী নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। এ কারণেই আন্দ্রে কোরিবকো বলছেন, ‘কেউ যদি ফাঁস হওয়া ‘দূতাবাসের’ ক্যাবলগুলো (কূটনৈতিক বার্তা) মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেন, তবে স্পষ্টভাবে দেখা যাবে ক্রাউন প্রিন্সকে বিবেচনা করা হচ্ছে জায়নবাদী নেতার হাতের পুতুল হিসেবে। এই প্রেক্ষাপটেই খবর ছড়িয়ে পড়ে, নেতানিয়াহুর পরামর্শেই মোহাম্মদ বিন সালমান তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছেন। সৌদি আরব এবং ইসরাইল সত্যিকার অর্থেই একে অপরের মিত্র, বিশেষ করে ‘ইরানবিরোধী’ সবকিছুর ক্ষেত্রেই। তবে একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, ইসরাইলের সাথে সুর মিলিয়ে সৌদি আরব ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসী অবস্থান প্রকাশ করছে না, বরং তেহরান, সানা, বৈরুতের ব্যাপারে রিয়াদ ও তেল আবিবের মধ্যে স্বার্থসিদ্ধির বিষয়গুলো একটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন