ডেসমন্ড টুটু থেকে মালালা ইউসুফজাই, সবার সমালোচনার নানা মাত্রার বাণ যেন বিদ্ধ করছে শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিকে। পাশ্চাত্যের কাছে এক সময় কিংবদন্তির মতো রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বার্মার রাজনৈতিক মুক্তির জন্য জীবনের দু’দশকের সোনালি সময় বন্দী অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছেন। বৃটিশ স্বামী বা সন্তানদের সান্নিধ্য কমই পেয়েছেন তিনি। তার এ ত্যাগকে এক সময় যারা উচ্চতার শিখরে তুলে ধরেছিলেন তারাই সু চিকে নিয়ে এখন হিসাব মেলাতে পারছেন না। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছা বর্ণবাদ বিরোধি আন্দোলনের নেতা ডেসমন্ড টুটুর একটি বাক্য সু চির মর্মমূলে বিদ্ধ হবার কথা।
টুটু এক খোলা চিঠিতে বলেছেন, “বার্ধক্য আমাকে গ্রাস করেছে। এখন আমি জরাগ্রস্ত, সবকিছু থেকে অবসর নিয়েছি। ঠিক করেছিলাম সার্বজনীন বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আর কিছু বলব না। কিন্তু আজ তোমার দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের গভীর সংকটে সেই নীরবতা আমি ভাঙছি। হে আমার বোন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোই যদি তোমার নীরবতার কারণ হয়ে থাকে, তার জন্য সত্যিই বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে। আমরা প্রার্থনা করি, তুমি ন্যায়বিচারের পক্ষে মুখ খোল, মানবতার পক্ষে কথা বল, দেশের মানুষের ঐক্যের কথা বল। আমরা প্রার্থনা করি যাতে তুমি এই সংকটে হস্তক্ষেপ কর। ”
শুধু টুটু নন অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ ১৩ নোবেল জয়ী এবং আরো ১০ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সুচির সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। এই ২৩ জন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বরাবর একটি খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তারা উল্লেখ করেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে তা জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বার বার আবেদন জানানোর পরও মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি যেভাবে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ ও সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তা হতাশাজনক। বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও তারা আহ্বান জানিয়েছেন। তারা জাতিসংঘ মহাসচিবকে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে মিয়ানমারে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে ছিলেন- পূর্ব তিমুরের হোসে রামোস হোর্তা, উত্তর আয়ারল্যান্ডের মেইরিড মগুইয়ের, দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, কোস্টারিকার অস্কার আরিয়াস, যুক্তরাষ্ট্রের জডি উইলিয়ামস, ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান, লাইবেরিয়ার লেমাহ জিবোইয়ি, বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনুস ও পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই।
তারা চিঠিতে আরো উল্লেখ করেন, অং সান সু চি মিয়ানমারের নেত্রী এবং এক্ষেত্রে সাহসিকতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি মোকাবেলার প্রাথমিক দায়িত্বটি তারই কাঁধে ছিল। অথচ তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভুতি জানিয়ে কথা বলেছেন।
এসবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আরো একধাপ আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি।
প্রশ্ন হলো সুচি কি ক্ষমতায় গিয়ে বদলে গেলেন। নাকি সু চি এমন এক সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে গেছেন যেখানকার বাস্তবতা এক সময়ের তার শুভাকাঙ্কীরা বুঝতে চাইছেন না। সু চির দেশ মিয়ানমারে ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতার পর থেকে অল্প কয়েক বছর ছাড়া সব সময় সামরিক জান্তা ক্ষমতায় ছিল। ১৩৫টি স্বীকৃত নৃতাত্বিক গোষ্ঠি রয়েছে মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রান্তে। এর মধ্যে একেকটি রাজ্যে একেকটি গোষ্ঠির প্রাধান্য রয়েছে। তাদের অনেকে দশকের পর দশক ধরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে এবং করছে। এ সব গোষ্ঠিকে শান্তির বন্ধনে নিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা নেন সু চি শুরুতেই। কিন্তু সু চি এক ধরনের হাতে পায়ে শৃঙ্খল নিয়ে দেশটির ক্ষমতায় গেছেন। বিদেশি নাগরিকের সন্তানের মা হবার কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। স্টেট কাউন্সিলর হিসাবে দেশ চালানোর কর্তৃত্ব নিজ হাতে নেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার তিন প্রধান মন্ত্রণালয় প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক বাহিনী।
সরকার গঠনের পর থেকে কখন না জানি সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে বসে এমন এক আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়েছে সূ চিকে। স্বাধীনভাবে নীতি নির্ধারণ বা বেসামরিক কর্তৃত্ব সরকারের উপর এখনো পর্যন্ত সামান্যই প্রতিষ্ঠিত হযেছে। অন্য দিকে সু চির উত্থানে যারা সাহায্য করেছে সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি বড় অংশ উগ্র জাতীয়তবাদ প্রচার করছে। উগ্রবাদ সব সময় যেভাবে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে সেভাবে মা বা থা আন্দোলনও দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সু চির দল এনএলডির জনসমর্থনের উপরও। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে অনভিজ্ঞতা এবং পরষ্পর বিরোধি আন্তর্জাতিক চাপ সু চির কাজকে নানাভাবে সঙ্কটে ফেলেছে। বলা হচ্ছেএই বাস্তবতা কোন পক্ষ সেভাবে বুঝার চেষ্টা করেনি।
রোহিঙ্গারা যে অঞ্চলের এক সময় অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা ছিল সেই আরাকানের অতীত ইতিহাসে প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সব সময় সৌহার্দ ছিল না। সাড়ে ৩ শ বছরের বেশি সময় ধরে আলাদা রাজ্য হিসাবে টিকে থাকা আরাকান মিয়ানমারের অংশ থাকার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। এই অঞ্চলটি ছিল বাংলা আর বর্র্মী সমাজ সংস্কৃতির এক সমন্বয় স্থল। মগ ও মুসলিম ছিল এখানকার দুই প্রধান ধর্মবিশ্বাসি দল।
সামরিক জান্তা বার্মার নিয়ন্ত্রণ নেবার পর আরাকানের গরিষ্ট জনগোষ্ঠি রোহিঙ্গাদের ভালোভাবে গ্রহন করতে পারেনি। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আরাকান থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে বার বার। এটিকে সফল করতে রাখাইন মগদের মধ্যে রোহিঙ্গা বিরোধি উগ্র জাতীয়তাবোধকে চাঙ্গা করা হয়েছে। আরাকান রাজ্যকে করা হয়েছে রাখাইন রাজ্য। এ ধরনের এক অবস্থায় নাগরিক অধিকার নিয়ে মাতৃভূমিতে বসবাস করা হয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। অথচ সেখানে তাদের বসতির ইতিহাস ১৫০০ বছরের বেশি সময়ের।
বার্মার সম্মৃদ্ধ এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সামুদ্রিক সম্পদ রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার আরাকান উপকুলে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহত্তম গ্যাস মজুদ আবিস্কার হয়েছে। আরাকানের পাহাড়মালায় রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদের আধার। দক্ষিণ এশিয়ার সাথে দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলও হবে এই এলাকা। ফলে এই কৌশলগত অঞ্চলের উপর নজর পড়েছে আন্তর্জাতিকভাবে অনেকের।
কৌশলগতভাবে যে অঞ্চল যত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব খেলোয়াড়রা হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবার জন্য সে এলাকাকে তত অস্থির করে রাখে। আফগানিস্তান এবং ইরাক-সিরিয়া অঞ্চলের আজকের অস্থিরতার ইতিহাস খুঁজলে যেটি সামনে চলে আসবে আরাকানও তার চেয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আরাকান ও পাশের শিন রাজ্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উত্তর পুর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে সার্বিকভাবে অহিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ট। আর এই অঞ্চলটি হলো অনুৎঘাটিত বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার।এই অঞ্চলের প্রতি নজর রয়েছে পাশ্চাত্যের। এখানে ইহুদিদের হারানো গোত্রের অধিবাস রয়েছে বলে ইসরাইলীরা তাদের নানা গবেষণায় প্রমাণের চেষ্টা করেছে। এখানে সিংল্যাঙ ইসরাইল নামে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও উঠেছে। এর বিপরীতে এই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি চীনেরও তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে।
এসব কারণে আরাকান অঞ্চল কৌশলগত সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সবদেশের সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাধারণভাবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ এই সাধারণ মনোভাবের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন মাত্রার বলে মনে হয়। এই ইস্যূটিকে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির এক উপায় হিসাবে ব্যবহার করা যায়। আবার এখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করে আইএস আলকায়েদার মতো উগ্রপন্থীদের উপস্থিতি সৃষ্টি করা গেলে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়। এখানে আফগানিস্তান বা ইরাক-সিরিয়ার মতো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের অর্থ এই অঞ্চলের জন্য ভয়ানকও হয়ে দাঁড়াতে পারে। চার দশকের আফগান যুদ্ধ পাকিস্তানের উন্নয়ন নিরাপত্তা ও সামাজিক সংহতিকে এক মারাত্বক সঙ্কটে ফেলেছে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের ঘাত সহ্য করার অনেক বড় সক্ষমতা রয়েছে বলে দেশটি ভেঙে পড়েনি। বাংলাদেশের অবস্থা সে রকম নয়। আরাকান বা সন্নিহিত অঞ্চলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হলে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলে এর প্রভাব কতটা কিভাবে পড়ে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ কারণে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির যে দাবি এখন জানানো হচ্ছে তা রোহিঙ্গাদের জন্য আপাত দৃষ্টিতে কল্যাণজনক মনে হলেও ভবিষ্যতে এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা মুশকিল।
আইএস, আল কায়েদা- এসব রহস্যজনক সংগঠন। বিশ্বের যেসব এলাকায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় সেসব অঞ্চলে এগুলোর উদয় হয়। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও ইসরাইলের সাথে তাদের কোন সংঘাতের খবর পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থি জন ম্যাককেইন এরিজোনার সিনেটর এবং কংগ্রেসের সশস্ত্র বিভাগ সংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান। দল নির্বিশেষে সব প্রশাসনের সময় তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকায় ডেমোক্রেট প্রার্থি নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অংশ হিসাবে সম্প্রতি একটি ভিডিও ক্লিপ ছেড়েছেন। সেখানে ম্যাককেইন আইএস গঠনে কিভাবে ভূমিকা পালন করেছেন প্রমাণসহ তার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। এখন উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদের যে দাপট বিশ্বব্যাপি সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে কাদের কি উদ্দেশ্য রয়েছে সেটি এখনো রহস্যাবৃত। আরাকানের সংঘাতেও তাদের আগমণের কথা জোরালোভাবে প্রচার করা হচ্ছে। এটি যে এই অঞ্চলের জন্য সুনামির মতো এক মহা বিপদ সংকেত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। #
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন