এক.
ছাত্রজীবনে সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে যে সভাগুলো করা হতো আমরা সেগুলোকে বলতাম ‘সাধারণ সভা’।
সভা গুলোতে একটি কমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম প্রায়ই,
সেটা হল- ইসলামের নামে এত দল কেন?
ইসলাম পন্থীদের মধ্যে এত বিভক্তি ও বিভেদের কারণ কী?
আপনারা ইসলামপন্থীরা কি সবাই এক হতে পারেননা?
ইত্যাদি ইত্যাদি...।
সাধারণতঃ এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে সুনানে ইবনে মাজাহ’র ৩৯৯২ নম্বর হাদীস এবং তিরমিজি ও আবু দাউদ, রেওয়াতে মেশকাত; ১ম খণ্ড, ১৬৩ কে উদ্ধৃত করা হয়। এই হাদিস অনুযায়ী উম্মতের ৭৩ দলে বিভক্ত হওয়া এবং একমাত্র রাসুল (সঃ) ও তাঁর সাহাবী দের অনুসরণকারী একটি দলই সঠিক হিসেবে বিবেচিত হবেন মর্মে দলিল উপস্থাপন করা হয়।
আমার জানা মতে বাংলাদেশের অনেক ইসলামী দলই নিজস্ব বুঝ অনুযায়ী মনেকরে তাঁরা সঠিক ও সহিহ, বাকীরা ফেতনা ও বাতিল। এই জাতীয় আলোচনায় দলগুলো নিজেদের কার্যক্রমের সাথে রাসুল (সঃ) এর সুন্নাহ’র যেসব মিল আছে সেগুলো তুলে ধরেন আর অন্য ইসলামী দলগুলোর কী কী মিল নাই সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। অর্থাৎ প্রমান করতে চান আমরাই সেই হকপন্থী “আল-জামায়াত” বাকীরা পথভ্রষ্ট ৭২ দলভুক্ত।
দুই.
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় সংশ্লিষ্ট টপিক নিয়ে গবেষণারত একজন বাংলাদেশী স্কলারের সাথে কিছুদিন আগে আমার দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়। তাঁর মতে বাংলাদেশে যে সকল উল্লেখযোগ্য ইসলামী সংগঠন কাজ করছে সেগুলোর বেশীর ভাগই ইসলামী নীতির অনুসারী। আবার প্রত্যেক দলেই রাসুল(সঃ)এর সুন্নাহ’র অল্প বিস্তর ঘাটতি রয়েছে। চুলচেরা বিশ্লেষন করে কেউ নিজেকে একমাত্র ‘হক’ আবার অন্য কাউকে পরিষ্কার ভাবে ‘বাতিল’ বলার কোন সুযোগ নাই।
তার কথায় আমি একটু থমকে গেলাম, পাল্টা প্রশ্ন করলাম- রাসুল (সঃ) তো হক পন্থী ‘একটি’ দলের (আল-জামায়াত) কথা বলেছেন, বাকীরা বাতিল। কিন্তু আপনার কথা অনুযায়ী আমাদের দেশে হকপন্থী দলতো তাহলে অনেক! বরং বাতিলপন্থী কম?
তিনি বললেন, আপনি এগুলোকে দল আকারে দেখছেন বলে সে রকম মনে হচ্ছে। আমি এগুলোকে দল হিসেবে দেখিনা, দেখি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হিসেবে। আমি বলবো যে সকল সংস্থা বা সংগঠন তাওহীদ, রেসালাত, আখিরাত এর উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আমর বিল মা’রুফ নেহি আনিল মুনকারের কাজ করবে তাঁরা প্রত্যেকেই ‘আল-জামায়াত’ গঠনের জন্য কাজ করছে। তাদের কাউকেই বাতিল বলা অনুচিত। রাসুল(সঃ)এর কর্মপন্থা এবং কর্মনীতি-ই আমাদের জন্য একমাত্র মডেল ও হক। রাসুল (সঃ) এর সুন্নাহ কে অনুসরণের চেষ্টায় যারা সংঘবদ্ধ হন তাঁরা হলেন হক পথের অভিযাত্রী। এদের সকলের প্রচেষ্টায় দেশে যখন একটি প্রতিনিধিত্বশীল (খিলাফত) ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই হবে ‘আল-জামায়াত’।
ভদ্রলোকের এরকম মতামতে আমি কনভিন্স নই, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।
তবুও তাঁর উদারনৈতিক (Inclusive) মতামত আমার ভালো লেগেছে। এ ব্যাপারে উম্মাহর বুঝদার, অভিভাবক আলেমদের মজবুত ভুমিকা রাখা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি। যারা ন্যায় ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদের উচিত পরস্পরের দোষ না ধরে একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা। অপরের ভালো গুণের প্রশংসা করতে শেখা।
কনফার্ম না হয়ে অন্যকে দালাল, এজেন্ট, ষড়যন্ত্রকারী, খারাপ বিকৃত নামে না ডাকা। কাউকে মন্দ নামে ডাকা, গালি দেয়া রাসুল (সঃ) এর নীতি (সুন্নাহ) ছিলনা। আজ যে আমার থেকে দূরে আছে, জেনে না জেনে বিরোধিতা করছে, কাল সে আমার কাছে আসতে পারে। হয়ে যেতে আমার সাথী, অনুসারী এবং অকৃত্রিম বন্ধু। যে আমার চলার পথে আজ কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে, আমার প্রত্যুত্তর বা পাল্টা আচরণের উপর নির্ভর করবে কাল সে পথে বিষ্ঠা ছিটাবে না ভুল বুঝতে পেরে আমার কল্যানাকাঙ্খী হবে!
তিন.
বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইসলামের রয়েছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান।
এর কারণ কি?
একটা সময় ইসলামপন্থীদের এই মজবুত অবস্থান ছিলনা। তাঁদের অবস্থান ও মূল্যায়ন ছিল খুবই সীমিত জায়গায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁদের এ অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে হল এই উন্নয়ন ও পরিবর্তন?
এই পরিবর্তন দেখানোর জন্য আমি কোন ডাটা এনালাইসিস বা উন্নয়ন সূচকের কম্পারিজনে যাচ্ছিনা। সে কাজের দায়িত্ব ইসলাম কে উৎখাত নীতির খাদেম শ্রদ্ধেয় আবুল বারাকাত ভাইয়েরাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
আমি আ’ম ইসলামী জনতার উদ্দেশে মোটা দাগে কিছু খাস কথা বলতে চাই।
বাংলাদেশে সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আলীয়া মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা, ইসলামিক স্কুল, হাফেজী মাদ্রাসা, মক্তব ইত্যাদি বিকল্প ইসলামী শিক্ষার একটি মজবুত স্রোতধারা তৈরী হয়েছে। এরই সুত্র ধরে একাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চতর ইসলামী গবেষণার নানা প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার চর্চা ও গবেষনার ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি বিকল্প ইসলামিক সংস্কৃতির বিকাশ, সমাজে ইসলামী অর্থনীতির শক্তিশালী প্রায়োগিক রূপ এবং নানা ইসলামিক সামাজিক সংস্থা ও রাজনৈতিক দল ।
দেশে আজ ইসলামী ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স খুবই জনপ্রিয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শ্রমজীবী প্রায় সকল পেশা ও কর্মক্ষেত্রে ইসলাম কে সমর্থন করার প্রচুর জনসমষ্টি গড়ে উঠেছে।
হেফাজত ইসলাম কে নিয়ে চলছে টানাটানি। ইসলামী ব্যাংক গুলো দখল করার হিড়িক চলছে, ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটে নেয়া বা জোট থেকে বাদ দেয়ার দাবী ও প্রচেষ্টা নিরলস ভাবে সক্রিয়। ইসলামী দল এবং তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা, হয়রানী, গণগ্রেফতার, মামলা, জেল, রিমান্ড, গুম, ফাঁসী সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের ভয়েজ দমিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদের অনুকুল গণমাধ্যম বন্ধ করা, কণ্ঠরোধ করা- সর্বোপরি ইসলামের উত্থান ঠেকানোর জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণায় এটাই প্রমাণিত হয় ইসলাম এখন কায়েমী স্বার্থবাদী-গদীনশীনদের জন্য চ্যাঁলেঞ্জিং রাজনৈতিক উপাদান।
এই প্রসঙ্গে আমার দুইটি কথা,
ক) ইসলামের আজকের এই অবস্থান ইসলামপন্থীদের কারও একার অবদান নয় বরং সবার সম্মিলিত প্রয়াসের ফল- ইসলাম সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা বুঝতে হবে। অনুরুপ ভাবে বিপদ যেটা মাথার উপর ঘুরছে, সেটা কারও একার বিপদ নয় ক্রমান্বয়ে ইসলামপন্থী সবাইকেই সে বিপদ স্পর্শ করবে। আমি মনেকরি মসজিদের যে মুয়াজ্জিন প্রতিদিন আজান দেন, মক্তবে আরবী পড়ান, যিনি রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে জীবিকা হিসেবে অর্থ সহ কোরআন বিক্রয় করেন, যে ভাই বা বোন জীবন ঘনিষ্ঠ ইসলামিক কোন পোষ্টে লাইক দেন-শেয়ার করেন এরা কি আমার সহকারী বা সহযাত্রী নয়! হতে পারে তাঁর অন্য কোন দোষ আছে। হতে পারে প্রকৃত বুঝের অভাবে সে অন্য কোন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম বিলং করেন। মাওলানা ভাসানী আওয়ামীলীগের মূল নেতাদের একজন, পরবর্তীতে ন্যাপ এর মত দল তৈরি করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দেয়া ও বাকশাল সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে তিনি কী মুখ্য ভুমিকা পালন করেননি? মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হবার পর বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত সেকুলার (প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নাস্তিক্যবাদ) রাজনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারনা নিয়ে তিনি কী মুসলিম চেতনার শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেননি? ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন যিনি প্রথম বাংলায় কোরআন তরজমা করেন- এদের কারও সাথে কী আমাদের কোন সম্পর্ক নাই? শুধু যারা আমার মুরিদ হয়েছেন, শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন, শপথ নিয়েছেন কিংবা দলীয় ফরম পুরন করেছেন কেবল তারাই কী আমার বন্ধু সহযাত্রী! বাকীরা কেউ নন?
খ) বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানে ইসলামী নীতির অনুসারীরা সবচেয়ে বেশী বঞ্ছিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। এমতাবস্থায় হালাল, হারাম, জায়েজ, নাজায়েজ, হানাফী, মালেকী, সালাফী, সুন্নী, ওহাবীবাদ, মউদুদীবাদ ইত্যাদি বিতর্ক তুলে আমরা আসলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ রেখা টানছি। এই রকম পরিস্থিতিতে রাসুল (সঃ) এর কর্মনীতি কী হতো?
উনি কী- কে আসল, কে হক এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হতেন?
আমি আলেম নই, নিজের জ্ঞান অপ্রতুল বলে জটিল আলোচনার বিষয় এড়িয়ে চলি। তবুও আমার সীমিত জ্ঞানে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মদীনা সনদ কে এক্ষেত্রে খুবই চমৎকার গাইড লাইন বলে মনে হয়। আমরা বাংলাদেশের ইসলামপন্থী ও ন্যায়পন্থী চেতনায় উজ্জীবিত ব্যক্তি এবং দলগুলো কী সবাই মিলে একটা “ঢাকা সনদ” তৈরি করতে পারিনা?
চার.
গেল সপ্তাহে এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের দুইজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং খ্যাতিমান আলেমের সাথে দেখা হল। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে লম্বা আলোচনা করতে গিয়ে তাঁরা কেন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে গেলেন তার একটা বিশদ বর্ণনা দিলেন। তাঁদের ক্ষোভ এবং অভিমান ছিল মুলতঃ জোট নেত্রীর বিরুদ্ধে। হেফাজতের আন্দোলনে তাঁদের যে ত্যাগ ও কুরবানী তার তেমন কোন সমবেদনা বা সহমর্মিতা তাঁরা জোটের কাছে পাননি বলে জানালেন। জোটের প্রধান দল তাদেরকে কেবলমাত্র ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবেই দেখে কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেয়না বলে তাঁদের অভিযোগ।
আমি একটু মজা করে বললাম, আমরা ইসলামপন্থীরা তাহলে সিঁড়ি হওয়া বাদ দিয়ে দিই না কেন?
মানে?
মানে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোন সরলপথ নাই আছে জটিল কঠিন পথ। বাংলাদেশে বিএনপি কী হেসে খেলে ক্ষমতায় এসেছে না আওয়ামীলীগ? ৫মে’র মত ট্র্যাজেডি কী তাদের ফেস করতে হয়নি?
আমাদের যেমন ৫মে, ২৮ অক্টোবর আছে তাদেরও আছে ১৫ আগস্ট, ৩রা নভেম্বর, ২১ আগস্ট বা ৩০ মে।
আমি খুব বিনয়ের সাথে বললাম, আপনারা ইসলামী দলগুলো এক হন। নিজেদের দোষ গুণের বয়ান বাদ দিয়ে মৌলিক পয়েন্টে নিজেরা একটা বৃহত্তর এলায়েন্স গঠন করেন। তারপর দেখেন বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মূল্যায়ন আপনাদের কাছে কেমন হয়। তাঁরা উভয়ে এবং উপস্থিত আরও কয়েকজন ঠিক ঠিক বলে সায় দিলেন।
তাঁদের সেই ঠিক ঠিক উচ্চারণ উপলব্ধি এবং কার্যকারিতার জায়গায় কতটুকু সঠিক আমি জানিনা তবে এতটুকু জানি উদারনীতি, বাস্তব ভিত্তিক আত্মমূল্যায়ন এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে সঠিক কাজটি সময়মত না করলে ইসলামী ঐক্য এবং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ বাংলাদেশে কেবল স্বপ্নই থাকবে, বাস্তবে রূপ পাবেনা কখনো।
Source Face Book
Source Face Book
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন