বাংলাদেশ বার্তাঃ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর প্রসবীনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার সূর্যসন্তান মেজর নাজমুল হক। এই গৌরবময় তথ্য যদি আমাদের নুতন প্রজন্ম না জানে, তাহলে এর দায় বর্তায় আমরা যারা জানি, তাদের উপর। এই বোধ থেকে লেখা।
.
মেজর নাজমুল হক (১ আগস্ট, ১৯৩৮ - ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ডাকনাম টুলু। ৭নং সেক্টরের মধ্যে ছিল সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের অংশ বিশেষ (দিনাজপুরের রাণী শঙ্কাইল, পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ ও রংপুরের পলাশবাড়ি-পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ)। নাজমুল হকের মৃত্যুর পর সুবেদার মেজর এ. রব ও তারপর মেজর কাজী নূর-উজ্জামান এই সেক্টরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল তরঙ্গপুর। প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই সেক্টরে যুদ্ধ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার এবং সাড়ে বারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল গণবাহিনীর সদস্য। এই সেক্টরের আটটি সাব সেক্টর ছিল।
.
মুক্তিযুদ্ধের সময় নাজমুল হক পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি রাজশাহী জেলা, পাবনা জেলা, বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গড়ে ওঠা ৭ নং সেক্টরের কমান্ডার পদে ১৯৭১ এর এপ্রিল থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। তরংগপুর ছিল তাঁর হেডকোয়ার্টার। তাঁর সেক্টরে তিনি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতেন যারা প্রথাগত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলো না। প্রায় পনের হাজার মুক্তিযোদ্ধা এ সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর তাঁর অধীনেই যুদ্ধ করেন।
.
১৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে মেজর নাজমুল হককে নওগাঁয় ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে পরদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে নওগাঁ মহকুমাকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলার অংশ ঘোষণা করেন তিনি। স্থানীয় যুবকদের হাতে তিনি তুলে দেন অস্ত্র। স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ইপিআর মুজাহিদ বাহিনী। সেই বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই তিনি নওগাঁ ও বগুড়ার পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প দখল করে শত্রুমুক্ত করেন গোটা বগুড়া জেলা। ২৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে তাঁর বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে হানাদাররা। দিনাজপুরের ধনধনিয়াপাড়ায় ১৮ জুন, ১৯৭১ তারিখে বড় রকমের এক যুদ্ধের পর ওই এলাকা মেজর নাজমুলের বাহিনীর দখলে আসে। এতে ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
.
তখন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মেজর নাজমুল হক ভারতে গেলেন। শিলিগুড়িতে সেই সম্মেলন হওয়ার কথা। যদিও সেই সম্মেলনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগ দেয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি নিজের কর্মব্যস্ততার কারণে সেখানে যেতে পারেননি। সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য মেজর নাজমুল হককে পাঠানো হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি ৩৩ কোর সদর দপ্তরে কোর কমান্ডার লে. জেনারেল মোহন লাল থাপনের সভাপতিত্বে ছিল সেই সম্মেলন। ভারতীয় অফিসারদের সাথে ভিন্ন গাড়িতে মালদহ ফিরছিলেন মেজর নাজমুল হক। তাঁর সামনের গাড়িতে ছিলেন ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল। পথের মধ্যে হঠাত্ করে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। পাহাড়ি আঁকা-বাকা পথে তখন যাত্রা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন গাড়িটি। মাঝ পথে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি পাহাড়ি পথ ছেড়ে কয়েকশ' গজ নিচে খাদে পড়ে যায় এবং তাত্ক্ষণিক মৃত্যু হয় তাঁর। জেনারেল গিল তাঁর মরদেহ ও আহত ড্রাইভারকে উদ্ধার করেন।
মেজর নাজমুল হকের মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার অকৃত্রিম ত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বাদ তিনি উপভোগ করে যেতে পারেন নাই। বিজয়ের মাত্র ৭৯ দিন আগে এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যুদ্ধ করেছেন মেজর নাজমুল হকের ৭ নম্বর সেক্টরেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও তাঁর প্রিয় কমান্ডার মেজর নাজমুল হক।
.
মেজর নাজমুলের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট লোহাগাড়ার আমিরাবাদ গ্রামে। তাঁর পিতা মরহুম এডভোকেট হাফেজ আহমেদ, এম.এ. বি.এল. তত্কালীন জেলা লয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা জয়নাব বেগম ছিলেন গৃহিণী।
.
পিতার বদলীর চাকুরির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে। মেজর নাজমুল হক কৃতিত্বের সঙ্গে কুমিল্লার পেশোয়ারা পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই যোগ দেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে।
.
গ্রামের কিছু মানুষ মেজর নাজমুলের স্মৃতিরক্ষায় কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে এস এম মঞ্জুরুল হক, আহমেদ মনির (সাংবাদিক), গাজী খায়ের আহমেদ ও শামীম আহমদের প্রচেষ্টায় আমিরাবাদ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মেজর নাজমুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
.
মেজর নাজমুল হকের দুই মেয়ে ইশরাত জাহান সুরভী ও নওরীন সাবা শিউলী। সুরভী স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন, শিউলী থাকেন ঢাকার উত্তরায়। নওরীন সাবা শিউলী বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র ১১ মাস। শুনেছি বাবা আমাকে খুব আদর করতেন।’
.
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমার বাবা একজন সেক্টর কমান্ডার, অথচ তাঁকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়নি। তাঁর নামটাও এখন উচ্চারিত হয় না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে—এটা খুব কষ্ট দেয় আমাদের।
.
মেজর নাজমুলের ভাই আজিজুল হক বলেন, ‘গত ৩৭ বছরে কোনো সরকারই মেজর নাজমুলের পরিবারের খোঁজ নেয়নি। ১৯৭২ সালে অনেক চেষ্টা করে ১৩০ টাকা পেনশন জোগাড় করেছিলাম। এরপর আর কেউ খবর রাখেনি।’ সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন