বাংলাদেশ বার্তাঃ সাততলা ফ্ল্যাটের কোন এক কিচেনের ফাক গলে দুম্ করে আছড়ে পড়ল গিট্টুমারা পলিথিনের পোটলাটা। শব্দের রেশ ধরেই উপরের দিকে ঘাড় বাঁকালেন সাদিক সাহেব। কিন্তু সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে। বহুদিনের পুরনো টিনের ছাওনি। জংধরা টিনের বেরসিক আচড়ে পলিবেগের নরম শরীর ফেড়েচিড়ে একাকার। বুঝে উঠতে না উঠতেই একগাদা আলুর খোসা, ডিমের খোল আর মুরগীর তাজা ছাল হুড়মুড়িয়ে পড়ল সাদিক সাহেবের গায় চাপানো ধবধবে জামাটায়। দেখে এখন আর বুখার উপায় নেই, জামাটা নিরেট সাদাই ছিলো। এখন ওটা যেন কোন শিল্পীর আকা দুর্বোদ্ধ পেইন্টিং। গতকালই কিনা সাবিহা শরীরের জ্বর উপেক্ষা করে ধুয়ে রেখেছিলেন জামাটা।
যতটা না মেজাজ বিগড়ালো তার চে অধিক রিরি করে উঠলো পুরো গা। সাবিহার চাপাচাপিতে সাত সকালে পেটে দেয়া ব্রেকফাস্ট যেন উদর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নগরীর কাকের মতো মানুষগুলোও যে কত বেপরোয়া সাদিকের অজানা নয়। তবুও কিছু কিছু ঘটনায় তাল সামলাতে পারেন না সাদিক। আজকের বিষয়টা খুব ব্যথিত করলো তাকে। আরো তিন তিনজন নিকট প্রতিবেশীর বসবাস মহল্লায়। ভাগ্যের কী নির্মম খেয়াল, কইতরের বিষ্ঠা কিংবা বেল্কুনিতে দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুর ছেড়ে দেয়া হিসুর ছিটেফোটাও স্পর্শ করে না তাদের।
চোখের সামনেই ঘটলো ব্যাপারটা। রাগে দু:খে শরীরে আগুন ধরে যায় সাবিহার। শিকার ধরা বাঘের মত কটমট করে তাকান সাদিকের দিকে। কষ্টের প্লাবন কান্না হয়ে বেরোয় সাবিহার দুচোখ বেয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ দমাতে চান কিন্তু পারলেন না। কাপা কাপা গলায় বলে ওঠেন, "বুঝুন সাদিক সাহেব...। সততা সহমর্মিতা আর পরোপকারের মেওয়া হাল আমলে এভাবেই সম্বর্ধনা জানায়! জানতাম নগর জীবনে লোক দেখানো সৌজন্যতা রেওয়াজ কিছুটা পাল্টেছে। এতোটা যে পাল্টে গেছে আন্দাজ করিনি। আরো যে কত সৌজন্যের তেতো স্বাদ বরাতে আছে আল্লাহ মালুম।" খোসা ছেঁড়া পেয়াজের ঝাঝ মেশানো কথাগুলো সাদিকের কানে ঠিক বিছুটি পাতার মতো ঠেকলো। এ মুহুর্তে কথার পিঠে কথা আগুনে ঘি ঢালার শামিল। বুঝেই চুপ মেরে থাকলেন সাদিক সাহেব। জেদের চুলোয় বুদ্ধির পানি ঢালতেই খুব নিরবে ঘরে ঢুকে গেলেন সাবিহার অলক্ষে।অনিচ্ছায় গায় চাপালেন ঘামের অত্যাচারে ঠাসা শার্টটা। যা কিনা ধুয়ে দেবে ভেবে ময়লা কাপড়ের স্তুপে রেখেছিলেন সাবিহা।
এই জ্যামের শহরে ভাগ্যটা ভালই বলতে হয় সাদিক সাহেবের। রাস্তায় দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পেয়ে গেলেন বাস। যুৎসই জায়গা দেখে বসে গেলেন নিরবে। মিনিট দুই যেতে না যেতেই মথা চাড়া দিয়ে ওঠলো সকালের কান্ডটা। নিজের অজান্তেই নাক কুচকালেন বার দুয়েক। সবার অলক্ষে ঘড়ের কাছটায় শুঁকে দেখতেই ব্রয়লার মুরগীর উটকো গন্ধটা ঝাপটা মেরে গেলো নাকের ডগায়। এক ধরনের অপরাধবোধে খচখচ করতে লাগলো ভিতরটা। গন্ধটা বুঝি তার শরীর বেয়ে মুহুর্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো বাস্টায়। মনের অস্বস্তি কাটাতেই কি না বার কয়েক তাকালেন পাশে বসা লোকটার দিকে। আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়ার ভাব দেখেই বুঝলেন গন্ধটন্ধ কিছু পাচ্ছে না লোকটা। আস্তে করে নেমে যায় সাদিকের বুকে চেপে বসা সন্দেহের পাথরটা । অবাক ব্যাপার তার কাছেও এখন আর গন্ধ-টন্ধ লাগছে না!
যোহরের নামায শেষে খেতে খেতেই মনে পড়লো কথাটা। গতরাতে সাবিহার কন্ঠে ভারী ভারী শোনাচ্ছিল কথাগুলো- জানো রাবুর বাপ, আজ না পাশের ফ্ল্যাটের জলিল সাহেবের মিসেস মানে রেহনুমা ভাবী এসেছিলেন।
চিনতে পাড়লেন না সাদিক। বরাবরের মতোই জিজ্ঞেস করলেন, "কোন জলিল সাহেব?"
প্রশ্ন শুনে ক্ষেপে যান সাবিহা।
- বলি... এ মহল্লার কয়জন জলিলকে চেনো তুমি?চেনো তো অফিস আর অই পড়ার টেবিল। তোমার অফিস কলিগ জলিল সাহেবের স্ত্রীর কথা বলছি। উনি আজ যুক্তিহীন বেশ কটা বাজে কথা বলে গেলেন।
- বাজে বকবেন কেনো? গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চায় নাকি?
- ঝগড়া কী না জানিনা। তবে একটা কিছু যে বাধাতে চান, তা তার কথায় স্পষ্ট। কাল তার মেয়েকে দেখতে এসেছিলো ধানমন্ডির এক পরিবার। আমেরিকা প্রবাসী ছেলে।পিএইচডি শেষে সেখানেই সেটেল্ড। মেয়ে তাদের পছন্দ। সমস্যা অন্য জায়গায়।আমাদের জরাজীর্ণ টিনশেডই নাকি যত্ত অনিষ্টের মূল!
খানিকটা চিন্তায় পড়ে যান সাদিক। হিসেবটা ঠিক মেলাতে পারেন না। মেয়ে ওদের অথচ সমস্যা আমার টিনশেড!
- কী যে বলো রাবুর মা। রীতিমতো হাসি পাচ্ছে আমার। ওরা সাত তলার মানুষ। আর আমি...! আমার টিনশেডই কি আর ছন শেডই কি! ওরা তো আর আমার মেয়েকে নিচ্ছে না যে জাত যাবে?
- এই তো সরল মনের তরল উত্তর। জনাব, তোমার সাধের টিনশেড সাত তলার জানলা দিয়ে তাকালে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন বলে মনে হয় ভেবে দেখেছো একবার! তোমার এ কবুতরের ছাপড়া জঞ্জালের চাইতে বেশি কিছু না।
- বাদ দাও ওসব। এতো রাতে তোমার সাথে তর্কে যেতে চাইনা। ঘুমাও দেখি। সকাল সকাল আবার অফিস দৌড়াতে হবে।
সাদিক সাহেবের এ কথায় আরো রেগে যান সাবিহা।
- সাত সকালে কেনো কেবল তোমাকেই অফিস দৌড়াতে হয়? জলিল সাহেবরা তো তোমার অফিসেই চাকরি করে। কই তারা তো তোমার মতো দৌড়ঝাপ করেন না। দৌড়ঝাপের পরও কি না লেটকামার খেতাব জোটে তোমার কপালে!
- ওদের মতো কাড়ি কাড়ি টাকা থাকেনা আমার পকেটে, যে রিক্সায় চড়ে চিপাচাপা দিয়ে চলে যাবো। আমার থাকতে হয় লোকাল বাস কৃপায়। রাজ্যের জ্যাম ঠেলে তবে না অফিস।
- রেহনুমা ভাবীর সাফ কথা। হয় তুমি ফ্ল্যাট বানাবে অন্যথায় জায়গা বেচে দেবে অদেরই কাছে। আমাদের কারণে ওদের প্রেস্টিজ হ্যাম্পার্ড হতে দেবে না। ওরা ফ্ল্যাট মালিকরা নাকি একজোট হয়েছে।
ধৈর্য আর কুলায় না সাদিক সাহেবের। গলার স্বর স্বাভাবিকতা হারিয়ে চড়ে যায়।
- জায়গা বেচার তো প্রশ্নই আসে না। আর তুমি তো জানো সাবিহা, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ একচিলতে জায়গা বাপমার স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। গলা ধরে আসে সাদিকের। ওদের বলে দিও অত দেমাগ আল্লাহ সইবে না। আরে এতো আমার অক্ষমতা নয়! এ আমার অহংকার। একই চাকরি একই সুযোগ সুবিধা! অথচ ওরা থাকে সাত তলায় আর আমি.....!
একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কি জানি কি ভেবে কিচুক্ষণের জন্য চুপ মেরে যান তিনি। নিরবতা ভাঙেন সাবিহাই।
- রাবুর বাপ আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম! মেয়েটার কথা ভেবেও তো ভাগে ফ্ল্যাটটা করে ফেলা যায়। তোমার প্রভিনেন্ট ফান্ড, আমার একাউন্টের যতসামান্য আর ব্যাংকলোন মিলালে তো হয়েই যায়।
- নাহ সাবিহা। অই কালোটাকার কুমিরদের সাথে তোমার ঘামের মূল্যে কেনা সঞ্চয় জেনে শুনে মেশাতে পারিনা। তুমি কী ভাবো এই নাগরিক রেসে বার বার হোচট খেতে আমারও খুব ভালো লাগে? লাগে না। কিন্তু কি আর করা...!
কি একটা ফাইলে ডুবেছিলেন সাদিক। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জলিল সাহেব। কাপাকাপা গলায় এক নিশ্বাসে বলে গেলেন কথাগুলো- ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে! আপনার ভাবী হাসপাতালে। তড়িঘড়ি সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আচমকা পড়ে অজ্ঞান। প্রচুর ব্লিডিংও নাকি হয়েছে! আপনার মিসেস'ই মাত্র জানালো। হাতের ফাইল থেকে মুখ তুলে চাইলেন সাদিক সাহেব। জলিল সাহেবের অস্থিরতা বুঝতে পারলেন।
- অস্থির হবেন না জলিল ভাই। আল্লাহ মেহেরবান। কিচ্ছু হবে না ভাবীর। আর হ্যা, আপনার যা অবস্থা। একা ছাড়ার সাহস পাচ্ছি না। চলুন বসের কাছে।
আতকে ওঠেন সাদিক সাহেব। সাবিহা পেশেন্ট বেডে কেনো? সাদিকের অস্থিরতা ভাঙেন সাবিহা নিজেই।
- প্রচন্ড ব্লিডিং হয়েছে ভাবীর। রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো। তাই রিস্ক নিতে দিলাম না। বাইরের রক্তে আজকাল কতরকম সমস্যা।
ওটি থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার।
- সি ইজ আউট অব ডেঞ্জার। চাইলে দেখতে পারেন। পেশেন্ট ঘুমোচ্ছে, জোরে কথা বলবেন না প্লিজ। আর হ্যা অন্তত: আজকের রাতটা পেশেন্টকে এখানেই রাখতে হবে। কেউ থাকলে ভালো হয়। বুঝতেই পারছেন ফিমেল ওয়ার্ড। পুরুষ এলাও না।
জলিল সাহেবের চেহারাটা জ্বলেই দেয়াশলাইয়ের কাঠির মতো দপ করে নিভে গেলো।- কি যে করা এখন। মেয়েটাও বাড়ি নাই। শিক্ষাসফরে রাংগামাটি।
-এতো ভাবাভাবির কিছু নাই জলিল ভাই। আমি তাও আছি।
চটজলদি অভয় দেন সাবিহা।
- আর কত ঋণে জড়াবেন ভাবী?
জলিল সাহেবের মুখের দিকে তাকান সাদিক।
-ঋণ বলছেন জলিল ভাই! কর্তব্য কেন নয়?
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলেন জলিল সাহেব।
- কর্তব্যই যদি হবে সাদিক সাহেব...আমার আড়াই হাত দূরের প্রতিবেশীর জন্য তো সেটা আরো বেশী কিছু! কই রোগীর সাথে আসাতো দূরের কথা ফোনটা পর্যন্ত করলেন আপনার মিসেস!
-ওসব কিছু না। মানুষের কত রকম সমস্যা থাকতে পারে ভাই।সাদিক আলতো করে পিঠ চাপড়ে দেন জলি সাহেবের।
জানলার কাচ গলে শেষ বিকেলের টকটকে লাল আলোটা এসে পড়ছে ঠিক ক্লান্তিতে তন্দ্রায় ঢলে পড়া সাবিহার ফর্সা গালে। জীবনের পদে পদে এতো টানাপোড়েন। তবু যেন কী এক তৃপ্তিরেখা ঝুলে থাকে সাবিহার ঠোঁটের কোণে। দৃশ্যটা রেহনুমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে।
বেশ খানিকটা সময় গড়িয়ে গেছে। রেহনুমা জেগেই আছে। জলিল সাহেবের সংসারে এমন কোন চাওয়া নেই যা পূর্ণ হয়নি রেহনুমার। একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর কাছে আজ কেন জানি নিজেকে বড় বেশী নি:স্ব মনে হয়। সাবিহার এতো বড়ো ত্যাগ আর অকৃত্রিম মহানুভবতার কাছে নিজেকে বড় বেশি দরিদ্র মনে হয়। রেহনুমার বুঝতে পারে ঐশ্বর্যের চাইতেও ঐশ্বর্যময় কিছু মানুষের মধ্যে থাকে যার মূল্য টাকায় পরিমাপ করা যায়না। কাল শেষ বিকেলে সাবিহাকে বলে আসা কথা গুলো যেন আজ রেহনুমার হৃদপিন্ডে বিষকাটালির মতো বিঁধছে। কৃতজ্ঞতা আর নিদারুণ অনুশোচনায় দু'চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে রেহনুমার। চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিও সাবিহার তৃপ্তিতে ঠাসা মুখটি দেখতে সামান্যতম কষ্ট হয় না রেহনুমার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন