সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে তুরস্কের ইস্তানবুলে কনস্যুলেটের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সৌদি আরব। গত ২ অক্টোবর ঘটনার পর থেকে অস্বীকার করে আসলেও শনিবার প্রথমবারের মতো এক বিবৃতিতে বিষয়টি স্বীকার করলেন সৌদির প্রধান প্রসিকিউটর। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুইজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বহিস্কার করাও হয়েছে। বিবৃতিতে সৌদি পাবলিক প্রসিকিউটর বলেন, সৌদি কনস্যুলেটে দেখা করতে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে খাশোগির লড়াই হয়ে। আর তাতেই খাশোগির মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসিত সৌদি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগি গত ২ অক্টোবর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর আর বের হননি। সৌদি আরব এতদিন দাবি করে আসছিল, খাশোগি কনস্যুলেট ভবন থেকে বের হয়ে গেছেন। তবে তুরস্কের পক্ষ থেকে এর প্রমাণ চাওয়া হলে তা সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে রিয়াদ। তুরস্কের দাবি, তাদের তদন্তকারীদের হাতে নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে তুরস্কে আসা ১৫ সদস্যের একটি সৌদি দল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ আঙ্কারার। তুর্কি ও মার্কিন তদন্ত সূত্রে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা থাকার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এবার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে খাশোগিকে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করলো সৌদি আরব। শনিবারের বিবৃতিতে বলা হয়, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে এখনও তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, বহিষ্কৃত দুই কর্মকর্তা হলেন, সৌদির রয়্যাল কোর্টের উপদেষ্টা সৌদ আল কাহতানি ও সহকারী গোয়েন্দা প্রধান আহমেদ আশিরি। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, এই ঘটনার পর রাষ্ট্রের সাধারণ গোয়েন্দা সংস্থার পুনর্গঠনের জন্য যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপর্যায়ের কমিটি গঠনের জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন সৌদি বাদশাহ সালমান।
খাশোগির অন্তর্ধানের ঘটনায় এতোদিন সৌদি আরবের পক্ষে সাফাই গাইলেও বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন,খাশোগি মৃত বলেই আশঙ্কা তারা। এ সাংবাদিককে হত্যার নির্দেশ যদি সৌদি নেতৃত্ব দিয়ে থাকে তবে তাদেরকে চরম পরিণতি বরণ করতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়,মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও রিয়াদ ও আঙ্কারা থেকে ফিরে তদন্তের বিস্তারিত জানানোর পর এমন অবস্থান জানিয়েছেন ট্রাম্প। প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন বার্তা পাওয়ার পর খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হলো সৌদি আরব।
তবে সৌদি আরব হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করার আগেই এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৫ সৌদি নাগরিকের পরিচয় প্রকাশ করেছে তুরস্ক। এই মোট ১৫ জনের ছবিও প্রকাশ করেছে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম। খাশোগি ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এই ১৫ জন সৌদি আরব থেকে তুরস্কে পৌঁছান। আর তুরস্ক ত্যাগ করেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। আসা-যাওয়ার জন্য তারা বাণিজ্যিক বিমান ছাড়াও ব্যবহার করেন দুইটি ব্যক্তিগত বিমান। সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছেন সৌদি আরবের লেফটেন্যান্ট, মেজর থেকে শুরু করে কর্নেলপদমর্যাদার কর্মকর্তারা। এরা মূলত সৌদি যুবরাজের নিরাপত্তা বাহিনী ও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত। তবে বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ও ফরেনসিক প্যাথোলজিস্টও রয়েছেন সন্দেহভাজনদের তালিকায়। তুর্কি-আরব মিডিয়া এসোসিয়েশনের প্রধান তুরান কিসলাকসি একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেছেন, খাশোগিকে হত্যা করে তার লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে।
তুর্কি তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, খাশোগির হাতে সর্বাধুনিক ‘অ্যাপেল ওয়াচ’ ছিল। আর এ ওয়াচের মাধ্যমে সৌদি কনস্যুলেটে তাকে নির্যাতন এবং হত্যার মুহূর্তের অডিও রেকর্ড তার ফোন এবং আইক্লাউডে পৌঁছে গিয়েছিল। এই ফোন ও আইক্লাউড তিনি কনস্যুলেটের বাইরে অপেক্ষমান তার বাগদত্তার কাছে রেখে গিয়েছিলেন। এখন এসব রেকর্ড তার বাগদত্তার হাত থেকে তুর্কিতদন্তকারীদের কাছে পৌঁছেছে। তুর্কি সূত্রকে উদ্ধৃত করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানায় খাশোগির অন্তিম মুহূর্তের অডিও রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করে আশঙ্কা করা হচ্ছে মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
শুরু থেকেই খাশোগিকে হত্যার একটি অডিও প্রমাণ হাতে থাকার দাবি করে আসছে তুরস্ক। ওই অডিও রেকর্ডিং পুরোপুরি শুনেছেন এমন এক তুর্কি সূত্র মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট আইয়ের কাছে দাবি করেন, ২ অক্টোবর মাত্র সাত মিনিটে পুরো হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে। ওই সূত্র দাবি করেছে, খাশোগিকে হত্যার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেনারেল সিকিউরিটি বিভাগের ফরেনসিক প্রমাণ সংক্রান্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালাহ মোহাম্মদ আল তুবাইগিসহ ১৫ জনের একটি দল প্রাইভেট জেটে করে ওইদিন সকালে আঙ্কারা পৌঁছান। দূতাবাসের কনসাল জেনারেলের অফিস থেকে খাশোগিকে টেনে-হিঁচড়ে কনসাল জেনারেলের পড়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় উপরে প্রচণ্ড চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সেখানে নিচতলায় উপস্থিত থাকা এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পর তার চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তাকে চেতনানাশক কিছু দেওয়া হয়েছিল।
সূত্র দাবি করেছে,খাশোগিকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনও আলামত দেখা যায়নি। তাকে হত্যা করতেই স্কোয়াডটি এসেছিল। স্টাডিরুমের টেবিলে ওপর শুইয়ে খাশোগিকে জীবিত অবস্থায় কেটে টুকরো টুকরো করেন তুবাইগি। পুরো হত্যাকাণ্ডটি ঘটাতে সময় লেগেছে মাত্র সাত মিনিট। তুবাইগি যখন খাশোগিকে কাটতে শুরু করেন তখন তিনি ইয়ারফোনে উচ্চস্বরে গান শুনছিলেন। এছাড়া এ সময় তিনি তার সহকর্মীদেরও গান শুনতে উৎসাহ দেন। ওই রেকর্ডে তুবাইগিকে বলতে শোনা গেছে, ‘যখন আমি এ কাজ করি তখন গান শুনি। আপনাদেরও এটা করা উচিত।’
সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন