সংবিধান
দেশের সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধানের ভিত্তিতে। সংবিধানকে
সমুন্নত রাখার এবং সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র
পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশের সরকারের রূপরেখা ও সরকার
নিয়োগ সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের
মেয়াদ ৫ বছর। বর্তমান মহাজোট সরকার কর্তৃক সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী সংসদের
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হতে হবে। একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের এ পদ্ধতি
পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী
নির্বাচনের ময়দান সমতল করার যে আবশ্যকতা, মহাজোট সরকার কর্তৃক সংশোধিত এ
সংবিধানের মাধ্যমে সেটা উপেক্ষিত হয়েছে। কেউ মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য থেকে
নির্বাচনে অংশ নেবেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের সমস্ত ক্ষমতা ইস্তেমাল করবেন,
সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন, আর কেউ তার কিছুই করতে পারবেন না এটা ন্যায় ও
সমতার খেলাপ। সংবিধান ও নির্বাচনের বিধি-বিধানে এমন ব্যবস্থা এবং নিশ্চয়তা
থাকতে হবে, যাতে প্রার্থীদের মধ্যে অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে কোনোরূপ
বৈষম্য না থাকে। সমতল ময়দানে সবাই নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেন, জনগণ
যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন তারাই সরকার গঠন করবেন, ক্ষমতায় যাবেন।
গণতন্ত্রে ক্ষমতার পালাবদলের এটাই উপায় ও নিয়ম। বর্তমান সংবিধানে যে
ব্যবস্থা রয়েছে তাতে নির্বাচনে সমতল ময়দানের নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনকে
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে সংবিধান সংশোধনের বিকল্প
নেই।
নবম জাতীয় সংসদের কথিত শেষ অধিবেশনের মাধ্যমে, সংবিধানে
নির্বাচনকালীন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সংযোজনের কিংবা
নির্বাচনের ময়দান সমতল করার সুযোগ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
২০ নভেম্বর সংসদ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বলেছেন, অধিবেশন শেষ। এখন
নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। বাংলার মাটিতে সেই
নির্বাচন অবশ্যই হবে। সেই নির্বাচন বানচাল করার ক্ষমতা কারোরই নেই।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার
অনুমতি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির পরামর্শেই তিনি ছোট পরিসরের নির্বাচনকালীন
সরকার গঠন করেছেন। এ সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রী
নির্বাচন কালীন সরকার গঠনের যে কথা ঘোষণা করেছেন তাতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ
সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তিনি সংবিধানের কোনো ধারার আলোকে, কিভাবে
রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে প্রাপ্ত হলেন? ‘নির্বাচনকালীন সরকার’, ‘সর্বদলীয়
সরকার’, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকার’ এর কোনোটিরই অস্তিত্ব বর্তমান সংবিধানে
নেই। এসব সরকারের কথা বলে আওয়ামী লীগ মূলত সংবিধান লংঘনের ভূমিকায়
অবর্তীর্ণ হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কোনো দায়িত্ব যদি তাকে
রাষ্ট্রপতি দিয়ে থাকেন তাহলে তা সংবিধানের ভিত্তিতেই হতে হবে। সরকার
পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান নিছক আলাপ-আলোচনার বিষয় নয়। এটি একটি সাংবিধানিক
বিষয়। সংসদ অধিবেশনের সমাপণী ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর ঐ ঘোষণার মাধ্যমেই
দেশবাসী জানতে পারলো দেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছে যা পরবর্তী
নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধানমন্ত্রী কোন বিধির আলোকে, কিভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে এ অনুমতি
গ্রহণ করলেন, রাষ্ট্রপতিই বা কিভাবে তা প্রদান করলেন তা কেউ জানতে পারলো
না। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী এ সরকার গঠন ও তা পরিচালনার অনুমতি প্রদানের
বিষয়টি অবশ্যই সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হতে হবে। এরূপ সরকার গঠনের
আগে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সকল মন্ত্রীকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।
পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতির গেজেট নোটিফিকেশনও
থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কখন, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এরকম
অনুমতি দিলেন কিংবা প্রধানমন্ত্রীই বা কখন পদত্যাগ করলেন অদ্যাবধি কেউ তা
জানতে পারলো না।
সংবিধানের ৫৭(৩) এবং ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি
কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে সরকার পরিচালনার অনুমতি দানের বিধান সংযুক্ত আছে।
প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়া ব্যতীত এ বিধানের সুবিধা নেয়া যাবে না।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি
কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন বলে যে সুবিধা দেয়া আছে তা পেতে হলে সর্বাগ্রে তাকে
পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু আমরা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কোনো ঘটনা
সম্পর্কে কোনো গণমাধ্যম বা অন্য কোনো উপায়ে অদ্যাবধি জানতে পারিনি।
সংবিধানের ৫৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর
সরকার পরিচালনার অনুমতি অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে। কারণ এ ধরনের কোনো
অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের অনুমতির বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত
যোগাযোগের নিছক কোনো বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক সরকার গঠনের আইনী
বাধ্যবাধকতার বিধান। সে কারণেই রাষ্টপ্রতি নামে যেকোনো আদেশকে অবশ্যই
সংবিধানের ৫৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘সত্যায়িত বা প্রমাণিকৃত’ হতে হবে বলে
সংবিধানে বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে।
সংসদের সমাপনী অধিবেশনে
প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত বক্তব্য নিয়ে এক ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে ঘোষণার পূর্বে কোথায় রাষ্ট্রপতি তাকে এ দায়িত্ব
অর্পণ করলেন তা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কেউ অবহিত নয়। তিনি ২০
নভেম্বর সংসদে বললেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার
অনুমতি দিয়েছেন। তার ২ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে
সাক্ষাৎ করেন। ধরে নেয়া যায় রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎকালে তিনি
নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নতুন
সরকার গঠনের সাংবিধানিক ঘটনাটি সরকার কিংবা বঙ্গভবন থেকে জানানো হলো না
কেন? পরদিন রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেন নির্বাচন কমিশনের পুরো টিম। তারা
রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করেন। সেদিনও নির্বাচন
কমিশনকে এ কথাটি জানানো হয়নি। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নির্বাচন কমিশনের
সাক্ষাতের ২ ঘণ্টা পর বিরোধী দলীয় নেতাসহ ১৮ দলীয় জোটের ২০ সদস্যের
প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা রাষ্ট্রপতির নিকট সকল
দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য রাষ্ট্রের
অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন।
রাষ্ট্রপতি তাদেরকে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ১৮
দলীয় জোটের দাবি বিবেচনার জন্য সরকারকে অনুরোধ করবেন। অথচ: মহামান্য
রাষ্ট্রপতি তখনো জানেন না তার একদিন আগেই তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীকে
নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস
সচিব গণমাধ্যমে সরবরাহকৃত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান যে, রাষ্ট্রপতির নিকট
উত্থাপিত দাবিটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য
রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের নির্দেশ দিয়ে থাকলে
রাষ্ট্রপতি কি করে ১৮ দলীয় জোটের দাবি বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয়ে পাঠাতে পারেন?
রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এ সময়ে একাধিক
প্রেস রিলিজ ও বক্তব্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার
পরিচালনার কোনো প্রেস রিলিজ বা গেজেট নোটিফিকেশন অথবা প্রজ্ঞাপন জাতির
দৃষ্টিগোচর হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার
অনুমতি প্রাপ্তির বিষয়টি গোটা জাতির নিকট এক রহস্যজনক ঘটনা। সংবিধানের
সুস্পষ্ট বিধানাবলী ও নির্দেশিকা উপেক্ষা করে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা
করার দায়িত্ব প্রাপ্তির বিষয়টি এক গোলোক ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। দেশের ১৬
কোটি মানুষকে অন্ধকারে রেখে স্বঘোষিতভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে নির্দেশ
পাওয়ার কথা বলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া অবলম্বন আওয়ামী লীগের
একটি নতুন চমক ছাড়া আর কিছু নয়। দেশবাসীর বুঝতে বাকী নেই, প্রধানমন্ত্রী
নিজের রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য রাষ্ট্রপতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে
নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের একটি অভিনব নাটক জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন।
যিনি সংবিধান নিয়ে এ ধরনের দূরভিসন্ধিমূলক ও রহস্যজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে
পারেন তার অধীনে নির্বাচন কিছুতেই অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে
পারে না।
নবম জাতীয় সংসদের অধিবেশন সমাপ্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছ
থেকে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি প্রাপ্তির বায়বীয়
ঘোষণা দিয়ে সরকার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধু রাষ্ট্রবর্গও সকল দলের
অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে আসছেন।
সংঘাত,
সহিংসতা, একগুঁয়েমিতা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অশান্তি থেকে মুক্ত থাকার জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরেপীয় ইউনিয়ন, চীন- সবাই বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ
মানুষের মতই সবদলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য
নির্বাচন চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা
করে একদলীয় নির্বাচনের পথে হাঁটছে। সংবিধান, গণতন্ত্র সবই গণআকাক্সার ফসল।
কিন্তু সেদিকে আওয়ামী লীগ ভ্রুক্ষেপ করছে না। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকার
বা পুনরায় ক্ষমতায় আসার নেশা আওয়ামী লীগকে অস্থির করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ
সরকার চায় না ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। প্রধানমন্ত্রী ও তার
পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও দলীয় নেতৃবৃন্দ যে ভাষায় কথা বলছেন তা
গণতন্ত্রের ভাষা নয়। তারা সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পথ পরিহার করে
একদলীয় নির্বাচনের কথাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যক্ত করছেন। দেশের
শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ একদলীয়
নির্বাচনের ব্যাপারে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তারা স্পষ্টতই
বলেছেন, একদলীয় নির্বাচন বাংলাদেশকে সংঘাত ও সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিবে।
নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ,
উৎকণ্ঠা। বহিঃবিশ্বেও অনুরূপ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ বিরাজমান। অতিসম্প্রতি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয়
ইউনিয়নের পার্লামেন্টে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস্, লন্ডনের
প্রভাবশালী সাময়িকী দি ইকনোমিস্ট-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক
সঙ্কটের জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে
প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমিতা ও হটকারিতার কারণে রাজনৈতিক সঙ্কট ক্রমশই
ঘনীভূত হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান মহাজোট সরকার কর্তৃক সম্প্রসারিত
মন্ত্রিসভাকে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ অথবা যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন
এর কোনো অস্তিত্ব সংবিধানে নেই, জনগণের নিকট এর কোন গ্রহণযোগ্যতাও নেই। এই
অভিনব সরকার গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে দমন করে একদলীয়
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার নীল নকশা প্রণয়ন করেছে মাত্র। এ ধরনের
জবরদস্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কটে নিক্ষেপ
করবে।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতি যে আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন
করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দীর্ঘ ৪২ বছর
পরেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মানুষের জান-মাল এবং সমাজের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হলো ক্ষমতার লোভ, লালসা ও ক্ষমতা
কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়। রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শিতা, অপরিণামদর্শী ও
স্বার্থবাদী ভূমিকা দেশে সংঘাতমূখর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ সরকার যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। দেশের মানুষের ভালো-মন্দ
বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। দলীয় স্বার্থবাদীতা আবহমান কাল থেকে চলে আসা
আমাদের সামাজিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে নি:শেষ করে দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
সম্মান, মর্যাদা নিয়ে বিশ্ব দরবারে কিভাবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে সে চিন্তা
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মহলে নেই।
বিশ্বায়নের এই যুগে তেল, গ্যাস, ও
খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি
হয়েছিল তা রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা দেখা
দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব দেশ ও সংস্থা সরাসরি অবদান রাখেন তারা
তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ও দেশীয়
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন হতে
পারে।
বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশ তার বিশাল জনশক্তির
মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম। বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চল,
সমুদ্র বন্দর ও পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করতে পারতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
দেশকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিরোধী দলকে সমূলে উৎপাটন করার অসৎ
রাজনৈতিক মনোবৃত্তি দেশকে দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহ দেশকে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত
করেছে। প্রতিনিয়তই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রাণ দিচ্ছে নিরীহ
শান্তিপ্রিয় মানুষ। পুলিশ বাহিনীকে পেশাদারিত্বের পরিবর্তে দলীয় উদ্দেশ্য
সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংবিধান স্বীকৃত মিছিল, মিটিং,
সমাবেশের আয়োজন করলেই পুলিশ সেখানে গুলি চালাচ্ছে। পুলিশ ফৌজদারী অপরাধ
দমনের চাইতে রাজনৈতিক দমন, পীড়নে ব্যস্ত। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, চোখ তুলে
ফেলা, গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়াসহ নির্যাতনের বিভিন্ন
কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক
আন্দোলন সংগ্রামকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
সরকারের নিবর্তনমূলক ভূমিকায় জনজীবন আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। সর্বত্রই
অস্থিরতা।
কোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বা নেতা জাতিকে অন্ধকার
গহ্বরে নিক্ষেপ করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের নিকট দেশ, দেশের মানুষ ও
জনগণের উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি বড় কথা নয়। ক্ষমতাই তাদের মুখ্য। ক্ষমতায়
যাওয়ার নেশা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন