গত ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপি মানুষ শরীর নিয়ে যে সকল সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন তন্মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে ডায়াবেটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বিশ্বে প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে। বিশ্বে ১৯৮৫ সালে যেখানে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, ২০১৪ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশংকা প্রকাশ করেছে যে, ২০৩০ সালে গিয়ে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৬০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ডায়াবেটির রোগীর সংখ্যা ৮৪লাখ। দেশের জনসংখ্যা যদি ১৬ কোটি হয়, তাহলে প্রায় প্রতি ১৯জনে একজন ডায়াবেটিস রোগী। অবশ্যই এটা ভয়াবহ সংবাদ।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা অবশ্যই নিতে হবে। তবে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে রোগ প্রতিরোধ করার। একটু সচেতন হলে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের প্রথমে জেনে নিতে হবে ডায়াবেটিসের লক্ষণ।
ডায়াবেটিসের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ উপসর্গগুলো নিম্নরূপ :
১. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ। বিশেষ করে রাতের বেলায়।২. অতিরিক্ত ক্ষুধা। ৩. অতিরিক্ত পিপাসা। ৪. ঠিক মত খাওয়া দাওয়ার পরও শরীর শুকিয়ে যাওয়া, ৫. শরীরের ওজন কমে যাওয়া। ৬. অকারণে শরীর অবসাদগ্রস্ত হওয়া ও ক্লান্তিবোধ করা। ৭. শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশিতে ব্যথা। ৮. হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া বা ঝাপ্সা দৃষ্টি। চোখ ব্যথা করা বা চোখের বিভিন্ন সমস্যা।
৯. পায়ে আড়ষ্টতা ও ঝিনঝিনে ব্যথা। পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। ১০. নানা ধরনের সংক্রমণ এবং সহজে ঘা না শুকানো বা শুকাতে বিলম্ব হওয়া।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয় :
এখনো পর্যন্ত স্থায়ীভাবে ডায়াবেটিস নির্মূলের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বসে নেই, নিরন্তর গবেষণা চলছে। পুরোপুরি আরোগ্য সম্ভব না হলেও এ বিষয়ে সবাই একমত যে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায় বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। একটু সচেষ্ট হলেই এর জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া। এর জন্য খাদ্যাভ্যাস ও জীবন যাপন পদ্ধতি একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতরে নিয়ে আসতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সর্বদা তিনটি ঊ গুরুত্বপূর্ণ।
এই ঊ তিনটি হচ্ছে ঊধর্ণ, ঊধ্রডধযফধভণ এবং ঊরলথ. অর্থাৎ খাদ্য, নিয়মানুবর্তিতা ও ওষুধ। প্রথম দুটি অর্থাৎ খাদ্য ও নিয়মানুবর্তিতা একেবারে শিশুবেলা থেকেই। তৃতীয়টি অর্থাৎ ওষুধের ব্যবহার রোগ শনাক্ত হবার পর রোগীকে ওষুধের ব্যবহারে সর্বদা সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।
মনে রাখা দরকার, যাদের জীবনে উপরের তিনটি বিষয়ে কঠোর অনুশীলন নেই, তাদের ডায়াবেটিস হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাও যদি উপরোল্লিখিত বিষয় তিনটির ব্যাপারে সচেতন থাকেন, তাদের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা বা ডায়াবেটিসের জটিলতা প্রতিরোধ অনায়াসে সম্ভব।
খাদ্য ব্যবস্থা : ডায়াবেটিস প্রতিরোধে খাদ্য গ্রহণের জন্য অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে। শরীরের পুষ্টি চাহিদা ডায়াবেটিস আগে যেমন থাকে, পরেও তেমনই থাকে। খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ভাল রাখা। খাবারের পরিমাণ এবং সময় দুটোই খেয়াল রাখতে হবে। অধিক মাত্রায় যেমন খাওয়া যাবে না, তেমনি দীর্ঘক্ষণ না খেয়েও থাকা যাবে না। অনেকে কাজের চাপে বা নানাবিধ কারণে প্রায়ই খাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করে থাকে, আবার অনেকে খাওয়ার টেবিলে বসে যা পায়, তাই খায়, কোনরকম বাছবিচার করে না। এটা মোটেও উচিৎ নয়। অনেকে আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড জাতীয় এবং ঘন ঘন চা, কফি, কোমল পানীয় ইত্যাদি গ্রহণের মাধ্যমে খাবারের চাহিদা মিটিয়ে ফেলে। এটা খুবই মারাত্মক। জেনে রাখা ভাল- অনেকে মনে করেন চিনি-মিষ্টি জাতীয় খাদ্য দ্রব্য গ্রহণের ফলে ডায়াবেটিস হয়। এটা ভুল ধারণা। তবে একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে অবশ্যই এসব পরিহার করতে হবে। ফ্যাট জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। স্বাস্থ্য সম্মত খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যতটা সম্ভব পরিশ্রশুত শ্বেসার জাতীয় খাদ্য কম খেতে হবে এবং আঁশ জাতীয় খাবার বেশী করে গ্রহণ করতে হবে। নাইট্রোসামাইন রাসায়নিকযুক্ত খাবার প্যানিক্রিয়াসের বিটা কোষসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। তাই এজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। বেশী পরিমাণে পানি পান করতে হবে, দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস।
নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হবে, একই নিয়মে খেতে হবে। কোন বেলা কম, কোন বেলা বেশি, কোন বেলা খাবার বাদ দেয়া ইত্যাদি অনিয়ম পরিহার করতে হবে। দীর্ঘ রাত জাগা পরিহার করে পরিমাণ মত ঘুমাতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে।
নিয়ম -শৃঙ্খলা : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলা অপরিহার্য একটি বিষয়। শুধু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে নয়, মানব জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে শৃঙ্খলার প্রয়োজীয়তাকে অস্বীকার করা যায়। শৃঙ্খলা ব্যতীত সুস্থ-সুন্দর জীবন অকল্পনীয়। তাই কাজের সময় কাজ, ঘুমের সময় ঘুম, খাবারের সময় খাবার, খেলার সময় খেলা, গল্পের্ সময় গল্প এজাতীয় নীতি কথাগুলো মেনে চলতে হবে। সবকিছু হওয়া উচিৎ রুটিন মাফিক এবং পরিকল্পনাভিত্তিক। ডায়াবেটিস হওয়ার পর যারা এধরণের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ কোন সমস্যাই নয়।
ওষুধ : ডায়াবেটিস রোগীকে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে মাত্রা, পরিমাণ ইত্যাদির ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া আরো কিছু নিয়ম আছে যা সবারই পালন করা উচিৎ। যেমন - সাধ্যমত দৈহিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম।
ব্যায়াম : যারা দৈহিক পরিশ্রম করেন না, অথচ মানসিক পরিশ্রম করেন তাদের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তাই যাদের ডায়াবেটিস হয়নি বা যাদের হয়েছে প্রত্যেকের উচিৎ প্রয়োজন মত ব্যায়াম করা, দৈহিক পরিশ্রম করা। ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রমে মাংসপেশীর জড়তা দূর হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়, শরীর সুস্থ থাকে। গৃহস্থালী টুকিটাকি কাজ করা, বাজার করা, বাগান করা, যতটা সম্ভব হাঁটা-চলা করা শরীরের জন্য ভাল। কিছু পথ রিক্সা বা গাড়িতে না গিয়ে একটুখানি যদি হাঁটা যায়, অফিসে লিফট পরিহার করে সিঁড়ি ব্যবহার করা খুব ভাল। যদি সম্ভব হয় বাসায় বাথরুম বাদ দিয়ে পুকুরে গোসল করা উপকারী। কারণ সাঁতার শরীরের জন্য একটি উপকারী ব্যায়াম। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য কমপক্ষে একটানা ৪০/৫০ মিনিট হাঁটা খুবই জরুরি। হাঁটা বলতে গল্পচ্ছলে পা ফেলতে ফেলতে সময় পার করা নয়, বরং তা হতে হবে ঘাম ঝরানো এবং একটানা বিরতিহীন। একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
দীর্ঘ রাত জাগা যেমন ক্ষতিকর তেমনি দীর্ঘক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকাও ভাল নয়। মাঝ রাতের পর বিছানায় যাওয়া এবং ৭টা/৮টা পর্যন্ত ঘুমানো উচিৎ নয়। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভোরের মুক্ত বাতাস একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করা উচিৎ। আজানের পর হেঁটে মসজিদের গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করা ডায়াবেটির প্রতিরোধে একটি উত্তম পন্থা।
শিশু পরিচর্যা : শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। জন্মের পর পরই শাল দুধ খাওয়াতে পারলে খুবই ভাল হয়। বুকের দুধ খাওয়ানো মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই উপকারী। প্যাকেটজাত বা টিনজাত দুধ স্বাস্থ্যৃসম্মত নয়, এতে নানাবিধ রোগ তৈরির সম্ভাবনা থাকে। শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। গো-দুধের বোভাইন সেরাম অ্যালবুমিন শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটা প্যানিক্রিয়াসের বিটা কোষপুঞ্জ ধ্বংস করে দেয়। যে সব শিশু গো-দুগ্ধে প্রতিপালিত হয়, তাদের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি। শিশুর জন্য আদর্শ খাদ্য মায়ের দুধ। মনে রাখতে হবে- মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই।
ধূমপান ও মাদকদ্রব্য সেবন থেকে সাবধান : ধূমপান থেকে সাবধান। ধূমপানে অভ্যস্ত ডায়াবেটিস রোগীর চোখ, ফুসফুস, হ্রদযন্ত্র, কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অর্গানগুলি আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ায়। মদপান থেকে বিরত থাকতে হবে। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। মদ ও মাদকদ্রব্য শরীরে রক্তচাপ বাড়ায়, মেদবৃদ্ধি ও স্থুলত্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। নিয়মিত ওজন দেখতে হবে। শরীরের ওজন বেড়ে গেল তা কমিয়ে আনতে হবে, আবার কমে গেলে তা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করতে হবে। ওজন যাতে স্বাভাবিক নিয়মের চাইতে বৃদ্ধি না পায় বা কমে না যায়, সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মেদবহুল মোটা শরীর এবং ক্ষীণ দুর্বল স্বাস্থ্য দুটোই ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। অন্যথায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আছে।
মোটা হওয়া-চিকন হওয়া : আমাদের দেশে একশ্রেণির তরুণ-তরুণীকে দেখা যায়, তারা মোটা হবার জন্য বা চিকন হবার জন্য (বিশেষ করে বিয়ের আগে) খুবই তৎপর হয়। প্রায়ই পত্রিকায় ‘চিকন স্বাস্থ্য মোটা’ করার বা ‘মোটা স্বাস্থ্য িম ফিগারে’ পরিণত করার আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এসব খুবই মারাত্মক। এ জাতীয় বিজ্ঞাপন থেকে সাবধান।আপনার সন্তানকে শিশুকাল থেকেই সুশৃংখল জীবনে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলুন,ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন